ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভালই আছে দশ মাসের সেই শিশুটি

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৯ আগস্ট ২০১৭

ভালই আছে দশ মাসের সেই শিশুটি

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ মাথায় কোঁকড়া চুল। টানা টানা দুটি চোখ। মুখে উপচে পড়া হাসি লেগেই আছে। মাত্র ১০ মাস বয়সী শিশু ফাতেমা যেন তার বয়সী অন্য শিশুদের চেয়ে একটু আলাদা। শিশুটিকে একনজর দেখলে যে কেউ বিদেশী শিশু মনে করে ভুল করতে পারে। নিষ্পাপ এ শিশুটিকে ফেলে গেছে তার মা! একটি শিশুর জন্য মা কত আপন তা বোঝার মতো বোধশক্তি হয়নি ফাতেমার। তবে মাত্র ১০ মাস বয়সেই শিশু ফাতেমা কিনা মায়ের অমানবিক আচরণের শিকার। তবে এর কোন প্রভাব পড়েনি তার ওপর। কান্নাকাটি নেই, দিব্যি খাচ্ছে, হাসছে ফাতেমা। খেলতে খেলতে ঘুমিয়েও পড়ছে। ফাতেমার চাহিদা পূরণের চেষ্টার কোন কমতি রাখেনি ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট এ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন্স সেন্টার। বলছিলাম গত ৮ জুলাই বিমানবন্দরে ফেলে যাওয়া সেই শিশুটির কথা। সে বর্তমানে রাজধানীর তেজগাঁও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রয়েছে। গত এক মাস ধরে শিশুটিকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের নারী পুলিশ সদস্যরা দেখভাল করছেন। তারাই শিশুটির নাম ‘ফাতেমা’ রেখেছেন। ডিসি, এডিসি, এসি, ইন্সপেক্টরসহ সবার সার্বিক সহযোগিতা ও যত ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে ভাল আছে ফাতেমা। মঙ্গলবার ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সরেজমিন দেখা যায়, ভবনের দ্বিতীয় তলার চারদিকে লোহার গ্রিলে ঘেরা প্লে গ্রাউন্ড। সেখানে বেবি সাইকেল, কাঠের ঘোড়া ও দোলনা সাজানো। বেবি সাইকেলে খেলছিল ফাতেমা। হাসছে আর খেলছে সে। উইমেন সাপোর্ট এ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন্স সেন্টারের উপ-কমিশনার (ডিসি) ফরিদা ইয়াসমিন মঙ্গলবার শিশুটি সম্পর্কে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বাবা-মায়ের সন্ধান না মেলায় এখনও শিশুর নাম কাগজে-কলমে ফাতেমা। ওর জন্য ডাক্তার, নার্স রয়েছেন। পরিচর্যা জন্য আলাদা লোকও রয়েছে। এত লক্ষ্মী বাচ্চা পাওয়া যায় না! কখনও কান্না করে না। ঠিকমতো খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, খেলা করছে। পুলিশ সদস্যরা ওর এখন পরিচিত মুখ। এমন একটা হাস্যোজ্জ্বল শিশুকে যে কেউ দেখলেই মায়া হবে। কিন্তু মায়ের চম্পট দেয়ার পেছনে এখনও রহস্য রয়ে গেছে।’ গত ২৫ জুলাই (মঙ্গলবার) ঢাকার শিশু আদালতের বিচারক মোঃ হাফিজুর রহমান পুলিশকে ফাতেমার প্রকৃত মা-বাবা খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন। পুলিশের জোর তৎপরতার পরও খোঁজ মেলেনি শিশুটির অভিভাবকের। সবাই এতদিন অপেক্ষা করছিলেন হয়ত তার জন্মদাত্রী মা তাকে নিতে আসবেন। কিন্তু এ এক মাসে কেউ না আসায় আদালতের মাধ্যমে নিঃসন্তান কোন দম্পত্তির কাছে হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে, শিশু ফাতেমার অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নিতে আবেদন করেছেন ৩০ দম্পতি। প্রকৃত বাবা-মাকে খুঁজে বের করা সম্ভব না হলে আবেদন করা দম্পতিদের মধ্য থেকে যে কোন ভাল এক দম্পতির কোলে ফাতেমাকে তুলে দেবে আদালত। শিশুটির ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিতে ইতোমধ্যে সেলিনা আক্তার, শ্যামলী আক্তার, লায়লা নূর, নিঝুম আক্তার, শাহনাজ বিনতে হান্নান ও দুলসাদ বেগম বিথি নামে ছয় দম্পতি আবেদন করেছেন। এরপর উইমেন সাপোর্ট এ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন্স সেন্টার বরাবর আরও ১২ দম্পতি অভিভাবকত্ব নিতে আবেদন ও যোগাযোগ রাখছেন। তাদের আবেদনের কাগজপত্রও আমরা আদালতে পাঠিয়েছি। তিনি আরও বলেন, তথ্য পেয়েছি আরও ১২-১৩ দম্পতি শিশু ফাতেমার অভিভাবকত্ব নিতে আদালতেও আবেদন করেছেন। মোট ৩০ জনের মতো। যারা অভিভাবকত্ব নিতে আবেদন করেছেন আমরা তাদের খোঁজখবর নিচ্ছি। আদৌ তাদের অভিভাবকত্ব নিতে শারীরিক ও আর্থিক সক্ষমতা রয়েছে কি-না বা অন্য কোন উদ্দেশ্য রয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জানা গেছে, গত ৮ জুলাই জর্দান থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে দেশে ফিরছিলেন জয়দেবপুর নিবাসী স্বপ্না বেগম। স্বপ্না জর্দানে গৃহকর্মী হিসেবে গিয়েছিলেন দুই মাস আগে। একই বিমানে শিশুটি ও তার মা ফিরছিলেন। বিমানের মধ্যেই শিশুটির মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল স্বপ্নার। এমনকি শিশুটিকে সে কোলেও নিয়েছিল। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের পর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে কাস্টমস থেকে মালপত্র নিয়ে বের হতে বিমানবন্দরের ক্যানোপি পার্কিং এলাকায় স্বজনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন স্বপ্না। এ সময় বিমানে পরিচয় হওয়া শিশুটির মা তাকে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আপা আমার শিশুটাকে একটু ধরেন। ভেতরে মালপত্র রয়েছে, নিয়ে আসছি।’ আগে কথা হওয়ায় সরল বিশ্বাসে শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেও আর ফেরেননি অজ্ঞাত ওই মা। পরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সদস্যদের সহযোগিতায় শিশুটিকে বিমানবন্দর থানা হেফাজতে নেয়া হয়। ওই দিনই বিমানবন্দর থানায় একটি জিডি হয়। এরপর শিশুটিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠানো হয়। উপ-কমিশনার (ডিসি) ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘কোন মা তার সন্তানকে ফেলে চলে যেতে পারেন বলে বিশ্বাস করা যায় না। তবে হয়ত এমন কোন সমস্যা তৈরি হয়েছিল যে কারণে ওই শিশুকে নিয়ে পরিবার, আত্মীয়স্বজনের মুখোমুখি হতে সমস্যা হচ্ছিল। এমনও হতে পারে যে, শিশু কিংবা ওই মায়ের জীবনে কোন ধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে ভেবে মা শিশুকে রেখে চলে গেছেন। সেদিন জর্দান থেকে প্রায় ৭০ জন গৃহকর্মী ওই ফ্লাইটে ফিরেছিলেন এবং সবাই বোরকা পরা ছিলেন। আমরা বিমানবন্দরের ভিডিও ফুটেজেও দেখেছি কিন্তু বোরকা পরা থাকায় সেভাবে কাউকে ফাতেমার মা হিসেবে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা ফাতেমাকে যত্ন সহকারেই দেখভাল করছি। যতদিন না আদালত শিশুটির জন্য ভাল দম্পতি বাছাই করছে ততদিন সে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারেই থাকবে।’
×