ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শৃঙ্খলাবিধি করতে মোস্তফা কামালের রায়ের রিভিউ চান আমীর

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৭ আগস্ট ২০১৭

শৃঙ্খলাবিধি করতে মোস্তফা কামালের রায়ের রিভিউ চান আমীর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অধস্তন (নিম্ন) আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট জারি করতে সরকারকে ফের দুই সপ্তাহ সময় দিয়েছে আপীল বিভাগ। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের চার সপ্তাহের সময়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে রবিবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ আদেশ প্রদান করে। শুনানির সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা তো আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসতে চাই। আইনমন্ত্রী অসুস্থ এটা পেপার পড়ে জেনেছি। উনি (আইনমন্ত্রী) অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন নাকি বাসায় ছিলেন। আমরা তো দেখতে যেতে পারতাম।’ এদিকে আইন মন্ত্রণালয়কে ছাড়াই রাষ্ট্রপতির সম্মতি নিয়ে সুপ্রীমকোর্ট অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারে বলে মনে করেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। বিচার বিভাগের সঙ্গে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের টানাপোড়েনের মধ্যে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে তার মত তুলে ধরেন। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রবিবার আরও চার সপ্তাহ সময়ের আবেদন করলে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারকের আপীল বেঞ্চ দুই সপ্তাহ সময় মঞ্জুর করে। এ পর্যন্ত শৃঙ্খলা বিধির গেজেট প্রকাশে আপীল বিভাগ ২৪ বার সময় দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষকে। তবে গত ২ জুলাই রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে আইনমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছিলেন, ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে এ গেজেট চূড়ান্ত হবে। এরপর তিনি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দু’দফায় বৈঠক করেন। ২০ জুলাই এক বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অধস্তন আদালতের বিচারকদের আচরণ ও শৃঙ্খলা বিধিমালা নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে এবং আমরা এ শৃঙ্খলা বিধিমালার গেজেট করার খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। এসব বিষয় নিয়ে একটু খুঁটিনাটি বোঝার প্রয়োজন ছিল এবং যেসব বিষয় নিয়ে দ্বিমত ছিল সেগুলো অনেকাংশে দূর হয়েছে। আগামী সপ্তাহেই (চলতি সপ্তাহে) তা হতে পারে। কিন্তু ২৩ জুলাই সময়ের আবেদনের পুনরাবৃত্তি ঘটে। রাষ্ট্রপক্ষকে এক সপ্তাহ সময়ও দেয়া হয়। গত ২ জুলাই সরকারকে দুই সপ্তাহ সময় দিয়ে আপীল বিভাগ বলেছিল, এটাই ‘শেষ সুযোগ’। যদিও আপীল বিভাগ এর আগে কয়েকবার ‘শেষ সুযোগ’ উল্লেখ করে সময় দেয়ার পরও রাষ্ট্রপক্ষ দফায় দফায় সময় নিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সরকারের প্রণীত খসড়া শৃঙ্খলা বিধি সুপ্রীমকোর্ট তাদের সুপারিশসহ আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। সেই থেকে ধারাবাহিকভাবে সময় নেয় সরকার। ২০১৬ সালের ৭ নবেম্বর বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা ২৪ নবেম্ব^রের মধ্যে গেজেট আকারে প্রণয়ন করতে সরকারকে নির্দেশ দেয় আপীল বিভাগ। আপীল বিভাগের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দুই সচিবকে তলব করেছিল আদালত। তবে ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর রাতে আইন মন্ত্রণালয় এক পরিপত্রের মাধ্যমে জানায়, নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধির গেজেট প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে পরদিন ১২ ডিসেম্বর আপীল বিভাগ দ্বিমত পোষণ করে। আদালত বলেছে, ‘রাষ্ট্রপতিকে ভুল বোঝানো হচ্ছে।’ বিধি প্রণয়ন সম্পর্কে আপীল বিভাগ বলে, ‘এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্ন। এখানে কোন কম্প্রোমাইজ নেই।’ তবে আপীল বিভাগের এ অভিমত সত্ত্বেও বিগত সাত মাসে এ গেজেট জারি করা হয়নি। ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়া হয়। ওই রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল। ১২ দফার মধ্যে ইতোমধ্যে কয়েক দফা বাস্তবায়ন করেছে সরকার। এজন্য বারবার আদেশ দিতে হয়েছে আপীল বিভাগকে। এমনকি ২০০৪ সালে আদালত অবমাননার মামলাও করতে হয়েছে বাদীপক্ষকে। এরপর ২০০৭ সালের ১ নবেম্বর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক ঘোষণা করে। এ অবস্থায় ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ আপীল বিভাগ চার সপ্তাহ সময় দেয় সরকারকে। এরপর গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটি খসড়া শৃঙ্খলা বিধি তৈরি করে সুপ্রীমকোর্টে পাঠানো হয়। কিন্তু তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে না হওয়ায় সুপ্রীমকোর্ট কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠন করে আলাদা একটি শৃঙ্খলা বিধি তৈরি করে। গত ২ জানুয়ারি এ বিষয়ে আপীল বিভাগে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৭ সালের ১০ জানুয়ারি আপীল বিভাগ বিচার বিভাগ পৃথকীকরণসংক্রান্ত চারটি বিধিমালা সাত দিনের মধ্যে গেজেট আকারে প্রকাশের নির্দেশ দেয়। তবে এ সংক্রান্ত মামলাটি এখনও আপীল বিভাগে বিচারাধীন। ১২ দফা নির্দেশনার যেসব দফা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য তাগিদ রয়েছে। ‘বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধি করতে মন্ত্রীর দরকার নেই’ নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালা তৈরিতে আইন মন্ত্রণালয়ের (মন্ত্রীর) দরকার নেই। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে উচ্চ আদালতই (আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগ) এ বিধিমালা করতে পারে।’ রবিবার আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এ সংক্রান্ত এক আবেদনের শুনানিকালে এমন মন্তব্য করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম। শুনানিতে সংবিধান অনুযায়ী কেবল রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে এ বিধিমালা করতে তিনি আবেদন জানান। পরে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ১৭ বছর আগে একই আবেদন করেছিলাম। তখন প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল রায়ে বলেছিলেন, ‘রুলস প্রণয়নে একটি আইনী বাতাবরণ থাকা দরকার। ১৭ বছর পরেও এসে আবেদন করে বলেছি, বিচারপতি মোস্তফা কামালের ওই রায়ের অংশ পুনঃবিবেচনা (রিভিউ) করতে হবে। কারণ, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ মতে বিচার বিভাগে দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে।’ তিনি বলেন, এজন্য সুপ্রীমকোর্ট এ রুলস প্রণয়ন করে শুধু রাষ্ট্রপতির কাছে নিয়ে দেখিয়ে এলেই হয়। এখানে মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের দরকার নেই। সংবিধানের ‘অধস্তন আদালতসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা’ শীর্ষক ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুর) ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রীমকোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে।’
×