ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিনেমা শিল্পে ধস, নেত্রকোনায় টিকে আছে ১টি প্রেক্ষাগৃহ

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ৭ আগস্ট ২০১৭

সিনেমা শিল্পে ধস, নেত্রকোনায় টিকে আছে ১টি প্রেক্ষাগৃহ

সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা ॥ নেত্রকোনা শহরের বাসিন্দাদের চিত্তবিনোদনের জন্য পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত প্রধান কেন্দ্র ছিল বিজয় টকিজ সিনেমা হল। জেলা শহরের অজহর রোডের এ প্রেক্ষাগৃহটি তৎকালীন পরিচালনা করতেন প্রকৃত মিত্র ও হিরণ মিত্র নামের দুই ব্যবসায়ী। পরবর্তীতে এর মালিকানায় যুক্ত হন আবদুল হালিম মিয়া নামে আরও একজন। ১৯৬৩ সালে মালিকপক্ষ এটি বিক্রি করেন। তখন ক্রয়সূত্রে এ প্রেক্ষাগৃহের মালিক হন নওয়াব আলী মিয়া। বিজয় টকিজের পরিবর্তে তিনি নতুন নাম রাখেন ‘হাসনা টকিজ’। ‘হাসনা টকিজ’ এর জমজমাট ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নওয়াব আলী মিয়া ১৯৭০ সালে শহরের কোর্ট স্টেশনের পেছনে ‘হীরামন’ নামে আরও একটি প্রেক্ষাগৃহ তৈরি করেন। নওয়াব আলী মিয়ার ছেলে আব্দুল কাদির মিয়া এটি পরিচালনা করতেন। ‘হাসনা টকিজ’ ও ‘হীরামন’ হলে সিনেমা দেখেননিÑ নেত্রকোনা শহরে এমন প্রবীণ মানুষ পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু নতুন প্রজন্মের অনেক তরুণ-তরুণীর অনেকেই আছে যারা একদিনও হলে গিয়ে সিনেমা দেখেনি। কারণ, একুশ শতকের শুরু থেকে সিনেমা ব্যবসায় ধস নামতে শুরু করে। বন্ধ হতে থাকে একের পর এক হল। এ রকম নানা বাস্তবতায় জেলার ২০টি সিনেমা হলের মধ্যে ১৯টিই বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে শুধু ‘হীরামন’ চালু আছে। আবদুল কাদির মিয়ার ছেলে শেখ সুলতান তপু এটি পরিচালনা করছেন। শহরের মোক্তারপাড়া এলাকার প্রবীণ নাগরিক হায়দার জাহান চৌধুরী জানান, ‘পাকিস্তান আমলে সিনেমা হলগুলোতে বোম্বের হিন্দী ও পাকিস্তানের উর্দু ভাষার সিনেমা প্রদর্শিত হতো। মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে দু-একটা বাংলা সিনেমা আসত। তখন প্রতিদিন হলগুলোতে তিন-চারটি করে শো চলত। শো চলাকালে তিল ধারণের জায়গা হতো না। লম্বা লাইন ধরে টিকিট কাটতে হতো। এদিকে বর্তমানে চালু থাকা জেলার একমাত্র সিনেমা হল ‘হীরামন’-এ চলতি সপ্তাহে গিয়ে দেখা গেছে, দর্শক প্রায় নেই বললেই চলে। ৭শ’ আসনের হলটিতে মাত্র ৫০-৬০জন দর্শক নিয়ে শো চলছে। এসব দর্শকের বেশির ভাগ নি¤œ আয়ের মানুষ। কোন নারী দর্শকরা এখন আর সিনেমা হলে যান না। এদিকে নেত্রকোনা শহরের পাশাপাশি জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরেও সিনেমার রমরমা ব্যবসা ছিল। ‘রাজমহল’, ‘দিলশাদ’, ‘মিতালী’ ও ‘কংকন’ নামের চারটি সিনেমা হল চালু ছিল সেখানে। সদ্য মুক্তি পাওয়া সিনেমা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা চলত ওই হলগুলোর মধ্যে। কালের আবর্তে চারটিই এখন বন্ধ। ‘রাজমহল’ এখন কমিউনিটি সেন্টার। আর ‘দিলশাদ’ গোডাউন। বাকি দুটির অবস্থাও তথৈবচ। এদিকে পূর্বধলার শ্যামগঞ্জ বাজারেও জমজমাটভাবে চালু ছিল তিনটি সিনেমা হল। হলগুলোর নামÑ ‘আশা’, ‘তরঙ্গ’ ও ‘হলি’। এখন একটিও চালু নেই। একইভাবে বন্ধ হয়ে গেছে- কলমাকান্দার ‘বনানী’, ‘সমতা’, বারহাট্টার ‘মধুমিতা’, কেন্দুয়ার ‘সাথী’, রামপুরের ‘আনন্দ’, দুর্গাপুরের ‘অনামিকা ছবিঘর’, ‘সাগরিকা’, মদনের ‘লিপি’, পূর্বধলার ‘রিয়া’, চৌরাস্তা ও হুগলা বাজারের আরও দুটি হল এবং আটপাড়ার ‘খেয়া’ ও মঙ্গলসিদ্ধ এলাকার একটি হল। চালু থাকা একমাত্র হল ‘হীরামন’ এর পরিচালক শেখ সুলতান তপু জানান, বর্তমান সময়ে সিনেমা ব্যবসা একেবারেই মন্দা। দর্শকরা এখন আর হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে চায় না। ডিস এন্টেনা, সিডি, ভিসিডি, মোবাইল ফোনসহ নানা প্রযুক্তির বদৌলতে দর্শকরা ঘরে বসেই সিনেমা দেখতে পারছে। এছাড়া একটি সিনেমা মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে পাইরেটেড কপি বেড়িয়ে যাচ্ছে। এ সবই সিনেমা ব্যবসায় ধস নামার কারণ। তিনি বলেন, একটি প্রযোজনা সংস্থার সহায়তায় হলটি কোন রকমে চালু রাখা হয়েছে। লভ্যাংশের একটি অংশ তারা নিয়ে যাচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এবং আর্টফিল্ম জাতীয় সিনেমা প্রদর্শন করলে কিছু দর্শক সমাগম হয়। এছাড়া দুই ঈদের সময় দর্শকসংখ্যা একটু বৃদ্ধি পায়। বাদবাকি সময়ে দর্শকের সংখ্যা একেবারেই কম থাকে’। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর জেলা সংসদের সাবেক সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ’৯০-এর দশকের পরবর্তীকালে বাংলা চলচিত্রে অশ্লীলতা প্রদর্শনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এক সময় এটা চরম আকার ধারণ করে। অত্যন্ত নি¤œমানের এবং রুচি বিবর্জিত সিনেমা তৈরি হতে থাকে। এসব কারণে ভদ্রলোকেরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। বিশেষ করে নারী দর্শকরা সম্পূর্ণভাবে হল বিমুখ হয়ে পরে। এখন মাঝে মাঝে কিছু ভাল সিনেমা নির্মিত হয়। কিন্তু হলগুলোর সেই পরিবেশ নেই। সবাই ঘরে বসে দেখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অথচ অতীতে যে কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানের সঙ্গে সিনেমা দেখার কর্মসূচী থাকত। বাড়িতে কোন আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে এলেও তাকে নিয়ে সিনেমা দেখানো হতো। স্থানীয় আবু আব্বাছ ডিগ্রী কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র শফিকুল ইসলাম জানায়, এ পর্যন্ত মাত্র দুবার হলে গিয়ে সিনেমা দেখেছে সে। একটি ‘আয়নাবাজি’। অপরটি ‘মনপুরা’। দুটোই আর্টফিল্ম ধরনের সিনেমা। এ রকম সিনেমা আসলে আবার দেখতে যাবে বলে জানায় সে। অন্যদিকে নেত্রকোনা সরকারী কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী নওরিন আক্তার বলেন, হলে গিয়ে কোনদিনই সিনেমা দেখিনি। একবার একটি সিনেমা দেখতে কয়েক বান্ধবী মিলে হলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু অভিভাবকরা সম্মতি দেননি। তারা জানান, হলে গিয়ে সিনেমা দেখার মতো নাকি পরিবেশ নেই। পরে আমরা সিডি সংগ্রহ করে কম্পিউটারের সাহায্যে বাসায় বসে দেখেছি। নওরিনের মতো বর্তমান প্রজন্মের এমন অনেকেই আছেÑযারা কোনদিন হলে গিয়ে সিনেমা দেখেনি। অথচ, দু’দশক আগেও সিনেমা ছিল বিনোদনের সেরা মাধ্যম। বিকেল হতেই হলগুলো কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেত। অনেক সময় কাউন্টারে টিকিট পাওয়া যেত না। কালোবাজারীদের কাছ থেকে বেশি দামে টিকিট কিনতে হতো। আবার অনেকের এক ছায়াছবি বার বার দেখেও যেন তৃপ্তি মিটতো না।
×