ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

জামাই খালি সস্তা খোঁজে!

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ৭ আগস্ট ২০১৭

জামাই খালি সস্তা খোঁজে!

কথায় বলে, সস্তার তিন অবস্থা। মানে অল্প দামে ভাল জিনিস মেলা ভার। একটু ক্লেশ স্বীকার করে খোঁজ নিয়ে দেখবেন, কিছু কিছু মানুষ আছে, যারা কিনা সস্তার খোঁজে জীবনপাত করে। এসব করে তাদের লাভের লাভ কিছুই হয় না, বরং আখেরে ভাল রকম পস্তাতে হয়। তবু তারা দশ টাকার জিনিস দুই টাকায় পেতে আগ্রহী। ভাবখানা এমন যেন সে বড় একখানা দাঁও মেরেছে। অবশ্য অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই! আক্রার বাজারে আমরা অনেকেই কষ্ট ছাড়া কেষ্ট পেতে বদ্ধপরিকর। কব্জির মোচড়ে দুচার টাকা এদিক সেদিক করতে পারলে ক্ষতির কিছু নেই। বরং শর্টকাটের দুনিয়ায় মুফতে যদি কিছু পাওয়া যায় তো মন্দ কী! কেউ কেউ আছে দেখবেন তরমুজ খেতে চায় কিন্তু গরমে নয়, বরং যেদিন অঝোরে বৃষ্টি নামে, তরমুজের বাজারে খদ্দের থাকে না, সেদিন গিয়ে সস্তায় তরমুজ কিনে আনবে। কলা খাবে, তবে বেছে বেছে ঝরা ও দাগঅলা কলা কিনবে, তাতে দুটো টাকা বেঁচে গেল। মনে সুখ এলো। এদের যে টাকা-পয়সা একেবারেই নেই তা নয়, বরং এদের স্বভাবটাই এমন। মোটা দামে ভাল কিছু কিনবে না। এরা বড্ড কৃপণ, তাই মনপ্রাণ ভরে কৃচ্ছ্রসাধন করে থাকে। এই সুযোগে সেই কৌতুকখানা বলে নিই। এক লোক নিজেকে বড্ড চালাক মনে করে। ঈদের মুখে নিজের জন্য নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি বানাবার জন্য এক টুকরো কাপড় নিয়ে গেছে দরজির কাছে। দরজি তার মাপ নিল। বলল, একহপ্তা পরে আসুন। কাপড় যা এনেছেন, তাতে আপনার টেনেটুনে হয়ে যাবে। তবে একটু আঁটসাঁট হতে পারে। কিপটে লোকটার কেমন সন্দেহ হলো। দরজি তার কাপড় মেরে দেবে না তো! বলল, আচ্ছা ভায়া, কাপড় যা আছে তাতে আমার ছেলের একটা ফতুয়া বানানো যায় না? যায় তো, বলুন তার কলারের মাপ কত। চালিয়াত লোকটা খুব খুশি। যাক, একের খরচে দুটো জিনিস হয়ে গেল। বুদ্ধি করে এটুকু না বললে তো ব্যাটা দরজি তার দামী কাপড় মেরেই দিত। তবু তার খুঁতখুঁতানি যায় না। বাড়ি গিয়ে আবার ফিরে এলো। বলল, ভায়া, আমার ছোট ছেলের জন্য একটা কুর্তা কি হতে পারে এই কাপড়ে? পারে তো। নিয়ে আসুন ছেলে। বানিয়ে দিই। দরজি মুচকি হেসে বলল। হাড়কেপ্পন চালিয়াত লোকটা একপিস কাপড়ে নিজের জন্য, বড়ছেলে ও ছোটছেলে, সঙ্গে বউয়ের জন্যও কিছু অর্ডার দিয়ে খুশি মনে বাড়ি এলো। যেদিন ওগুলো ডেলিভারি দেবার কথা, গিয়ে তো তার চক্ষু চড়কগাছ! দরজি এসব কী করেছে! পাজামা-পাঞ্জাবি-কুর্তা সবই তো পুতুলের পোশাক বানিয়ে রেখেছে ব্যাটা দরজি। কোনটাই কারও গায়ে গলেনি। এ কি সাড়ে সর্বনাশ হলো তার! অমনি কাঁদতে বসলো অতিচালাক খদ্দের। সস্তায় খাস্তা লুচি খেতে গিয়ে অনেকের জিভ পোড়ে। শর্টকাটে বড় দাঁও মারতে গিয়ে আম-ছালা দুটোই খোয়াতে হয় অনেক সময়। একজনের কথা বেশ মনে পড়ে। তার চাকরি চাই। মেলা দিন দোরে দোরে ঘুরেও তার ভাগ্যে শিকে ছেড়েনি। আসলে চাকরি পাবার যোগ্যতাই নেই, যদিও নিজেকে সে বিদ্যার জাহাজ মনে করে বসে আছে। চাকরি তার চাই, তাও সরকারী চাকরি। এই চাকরির নিরাপত্তা বেশি। পাওয়া কঠিন, তবে যাওয়া নাকি আরও কঠিন। চামড়ার জুতোর মতোন টেকসই। পায়ে দিয়ে যেমন আরাম, প্রয়োজনে জুতিয়ে আবার কারও মুখও লম্বা করে দেয়া যায়। কিন্তু চাকরি পাওয়া কি মুখের কথা! বেকাররাই কেবল বোঝে চাকরির মর্ম। অবশ্য এককালে কোন এক বিশিষ্ট নেতা বলেছিলেন, বেকারের কাজ খোঁজাও নাকি একটা কাজ। সেই অর্থে দুনিয়ায় কেউই আসলে কর্মহীন নয়। কেউ চাকরি করছে, আবার কেউ চাকরি খুঁজছে। কঠিন রসবোধ তার, এ-কথা মানতেই হয়। তো যা বলছিলাম, সেই বিদ্যার জাহাজ চাকরি করবে বলে কিছু টাকা নিয়ে ঘুরছে। সে শুনেছে টাকা ছাড়া নাকি চাকরি মেলে না। টাকায় টাকা আনে, তাই সে টাকা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু যুতসই দালাল তো চাই। অবশেষে পাওয়া গেল একজন। এর রকমসকম বুঝে দালাল চাকরির দাম একটু বেশিই হাঁকল। কিন্তু সে তো বিদ্যার জাহাজ, তাই সে বুদ্ধি করে বলল, এখন কিছু নাও। চাকরি হয়ে গেলে বাকিটা পাবে। দালালটা কে! সে কিন্তু ওই অফিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ নয়। ফালতু বা ‘কানামনা’ বলে কিছু লোক কোন কোন অফিসে থাকে অবশ্য। কাজ নাই মজুরি নাই, সংক্ষেপে কানামনা। এরা ভারি ধুরন্ধর। নইলে কি আর চাকরি ছাড়াই অফিসে ঢুকতে পারে! আবার নাকি তারা চাকরিও জুটিয়ে দেয়। অনেকটা সেই ফুটপাথের ওপর টিয়া পাখিঅলার মতো। টিয়া দিয়ে চিঠি তুলিয়ে কত লোকের ভাগ্য ফিরিয়ে দেবে বলে সে আশ^স্ত করে। অথচ নিজের ভাগ্যটাই শুধু ফেরাতে পারল না! তো সেই চাকরিপ্রত্যাশী খালি সস্তা খোঁজে। টাকা নিয়ে মেলা দেন-দরবার করে। ফালতুও বেশ চালাক। সে বেশি দর কষাকষিতে না গিয়ে যা পেল তাই নিয়ে নিল। অবশেষে রেজাল্টের দিন এলো। চাকরি তো তার হলো না। এবার সে টাকা ফেরত চায়। ফালতু একগাল হেসে বলল, সে কি ভায়া, চাকরি তো তোমার প্রায় হয়েই গেছিল। টাকা কিছু কম দিয়েছিলে তাই তোমার নিয়োগপত্র টাইপ হতে হতে হয়নি। মাঝপথে টাইপিস্ট গেল ছোট-টয়লেট সারতে, এই ফাঁকে বেচারা বাতাস এসে উড়িয়ে নিল তোমার জয়েনিং লেটার। এবার তুমিই বলো ভায়া, দোষ কার! আমার, তোমার, নাকি বেচারা টাইপিস্টের! এটা স্রেফ গল্পই। পয়েন্ট ইজ দ্যাট, সব কিছুর একটা নিয়মনীতি আছে। মূল্য ও মূল্যায়ন আছে। শর্টকাটে ধান্ধা করতে গেলে না জোটে চাকরি, না আসে সাফল্য। আরেক হাড়কেপ্পনের কথা বলে শেষ করি। লোকটা ভারি নিচুমনের। সকাল বেলা সস্তাদরের টোস্টবিস্কুট পানিতে ভিজিয়ে তাই দিয়ে নাশতা করে। দুপুরে শাকপাতা খায়, কারণ রাস্তার ধারে মেলা কচুশাক জন্মেছে। ওটা মুফতে পাওয়া যায়। বাচ্চাকে পড়তে না পাঠিয়ে নিজের দোকানে বসিয়েছে। এতে খরচ নেই কিন্তু কামাই আছে। তো সেই ছেলের ভীষণ শরীর খারাপ। গায়ে বল পায় না মোটে, হেলেদুলে কেমন নেতিয়ে পড়ে। কবরেজ দেখেটেখে বলল, তুমি বরং তোমার ছেলেকে একটু ঘি খাওয়াও। গাওয়া ঘি হলেই ভাল, মানে যাকে বলে গব্যঘৃত। ঘি খেলে ছেলের শরীরে তাগত আসবে। সে বাজারে গিয়ে দেখে ঘিয়ের গায়ে আগুন লেগেছে। একশগ্রাম ঘিয়ের দাম আশি টাকা। গব্যঘৃত বলে কথা। খাঁটি জিনিসের দাম একটু বেশিই হয়। নাহ, ছেলের জন্য আশি টাকা খরচ করতে সে রাজি নয়। গব্যঘৃত তার চাই না, ওটা কবরেজের বাড়াবাড়ি। তাই মেলা মুলোমুলি করে আশির বদলে আট টাকা দিয়ে হোমিওপ্যাথি ওষুধের ছোট্ট শিশিতে করে একটু ঘি নিয়ে এলো। এনেই ঝাড়–র শলা দিয়ে সেই ছোট্ট শিশি থেকে একটুখানি ঘি তুলে এনে ছেলের জিভে ঠেকিয়ে বলল, কিরে বাপ, গায়ে একটু বল-টল পাস! মেলা টাকার ঘি খাওয়ালুম! আমাদের অনেকের অবস্থা হয়েছে তেমনই। দু-একখানা সেøাগান দিতে পারলেই অমনি তুখোড় নেতা বনে যাই। টুকলি করে পাস, সার্টিফিকেট বাগিয়েই যেন বিদ্যার জাহাজ! গাছে না উঠতেই এক কাঁদি চেয়ে বসি! সেই টিভিসির মতো, বউয়ের আক্ষেপÑ তার জামাই সবখানে সস্তা খোঁজে। হাজার টাকার পাঞ্জাবি যেমন তিনশতে মেলে না, তেমনি বিনা কষ্টে বড় কোন সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। রবিঠাকুর যথার্থই বলেছেন, কষ্ট করে কিছু অর্জন করলে তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যায়। লেখক : কথাসাহিত্যিক ও রম্যলেখক
×