ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গৃহকর্মী লাইলীর মৃত্যু ॥ বাড়ির মালিক ও দারোয়ান রিমান্ডে

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৬ আগস্ট ২০১৭

গৃহকর্মী লাইলীর মৃত্যু ॥ বাড়ির মালিক ও দারোয়ান রিমান্ডে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ গৃহকর্মীর মৃত্যু নিয়ে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে তুলকালাম কা- ঘটার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। নেপথ্যে থেকে ইন্ধন যুগিয়েছে সরকারবিরোধীরা। পরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতেই এমন ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ঘটনার পর থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই এলাকার কোন বাড়িতে কাজ করতে যাননি গৃহকর্মীরা। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন অনেকেই। গৃহকর্মীরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি করেছেন। এমন ঘটনার নেপথ্যে গভীর ষড়যন্ত্র থাকার ইঙ্গিত বহন করছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। গৃহকর্মী মৃত্যুর ঘটনায় দায়েরকৃত হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত বাড়ির মালিক ও দারোয়ানকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে ঢাকার সিএমএম আদালত। বাড়ির মালিকের স্ত্রীকে আদালতের নির্দেশে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশের তরফ থেকে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতারকৃত তিনজনকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। বাড়ির সামনে শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় কয়েক শ’ মানুষকে অবস্থান করতে দেখা গেছে। সেখানে পুলিশের তিনটি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। চেকপোস্টে অতিরিক্ত পুলিশের পাশাপাশি এপিসি মোতায়েন রয়েছে। আর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে ওই বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াতের ওপর। বাড়ির সব মানুষ আতঙ্কে অন্যত্র চলে গেছেন। শুক্রবার সকালে রাজধানীর খিলগাঁও থানার বনশ্রীর জি ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর ছয়তলা বাড়ির মালিক সাবেক কাস্টমস এ্যান্ড ভ্যাট এক্সাইজ বিভাগের কর্মকর্তা মুন্সী মইনুদ্দিনের (৬৯) বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষ থেকে লাইলী আক্তারকে (২৫) ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। বাড়ির মালিক ও দারোয়ান তোফাজ্জল হোসেন টিপু (৩৪) লাইলীকে উদ্ধার করে। দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। লাইলীকে বাড়ির মালিক কুপিয়ে হত্যা করেছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এমন খবর মিথ্যা বলে প্রচারিত হওয়ার পর পাশবিক নির্যাতনের পর লাইলী লোকলজ্জায় আত্মহত্যা করেছে বলে খবর প্রকাশ পায়। এমন খবরে শুক্রবার বিকেল থেকে রাত প্রায় বারোটা পর্যন্ত অন্তত ৫-৭ হাজার মানুষ বিক্ষোভ করে। তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে বাড়ির সব দরজা-জানালার কাঁচ ভেঙ্গে ফেলে। বাড়ির গেট ভেঙ্গে দেয়। বাড়ির সামনে বাড়ির মালিকের মেয়ের জামাতার একটি প্রাইভেটকার পুড়িয়ে দেয়। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্তত ৩৫ জন আহত হন। পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে অন্তত ৫০ রাউন্ড টিয়ারশেল ও শত শত রাউন্ড রাবার বুলেট ছোড়ে। এককথায় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। রাতেই বাড়িটির অনেকেই চলে যান। বাকিরা পুলিশী নিরাপত্তায় থাকার পর সকালে নিরাপদ জায়গায় চলে যান। রাতেই বাড়ির মালিক ও দারোয়ান এবং বাড়ির মালিকের স্ত্রী শাহনাজ বেগমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ বিষয়ে মেয়ের পরিবারের তরফ থেকে শহীদুল ইসলাম বাদী হয়ে লাইলীকে ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় বাড়ির মালিক ও দারোয়ানকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। খিলগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জাহাঙ্গীর কবির খান জনকণ্ঠকে বলেন, গৃহকর্মী মৃত্যুর ঘটনায় পুরো রামপুরা এলাকা একপ্রকার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। কেন এমন ঘটনা ঘটল তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিক্ষোভকারীদের হামলায় পুলিশ কর্মকর্তাসহ অনেকেই আহত হয়েছেন। পুলিশ বাহার (৩৫), ছোট মিয়া (১৮) ও আব্দুল হাকিম (১৫) নামে তিনজনকে আটক করেছে। তাদের প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, গৃহকর্মীর মৃত্যু নিয়ে তুলকালাম কা- ঘটানোর পেছনে বিশেষ ষড়যন্ত্র রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতেই কোন বিশেষ মহল নেপথ্যে থেকে ঘটনাটি ঘটিয়েছে। অন্যথায় একজন গৃহকর্মীর মৃত্যু নিয়ে এতবড় ঘটনা নাও ঘটতে পারত। তারই ধারাবাহিকতায় শনিবার পর্যন্ত উত্তেজনা বিরাজ করছে। শত শত মানুষ বাড়ির চারদিকে অবস্থান করছে। যে কোন সময় বড় ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা- ঘটে যাওয়া বিচিত্র নয়। ধারণা করা হচ্ছে, কোন গোষ্ঠী এর নেপথ্যে ইন্ধন যোগাচ্ছে। ইন্ধনদাতাদের মধ্যে সরকারবিরোধী বা অন্য কোন স্বার্থানেষী মহলের জড়িত থাকাও বিচিত্র নয়। বিক্ষোভকারীরা এতটাই বেপরোয়া ছিল যে, উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাদের পর্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে আহত করেছে। এমন ঘটনা ভিন্ন ইঙ্গিত বহন করছে। ধারণা করা হচ্ছে, পুলিশ কর্মকর্তাদের আহত বা হত্যা করে পুলিশকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে পুরো এলাকাসহ সারাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করার জন্যই এমন হামলা করেছিল বিক্ষোভকারীরা। এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কয়েকটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্ত হচ্ছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে ওই মহিলার মৃত্যু প্রকৃতপক্ষে কিভাবে হয়েছে। সত্যি সত্যিই ওই গৃহকর্মী আত্মহত্যা করেছেন, নাকি তাকে হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে সেটি গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আর ওই গৃহকর্মী যদি সত্যি সত্যিই আত্মহত্যা করে থাকেন তাহলে নিজের বাসা ছেড়ে কেন ওই বাড়িতে গিয়ে আত্মহত্যা করলেন? মহিলার পরিবারের দাবি, পাঁচ মাসের বেতন বকেয়া ছিল লাইলীর। তারই জের ধরে এবং বাড়ির মালিকের লালসার সূত্র ধরে লাইলীর মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে। তবে বাড়ির মালিক এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, কোন বেতন বকেয়া নেই। শুধু জুলাই মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। নিয়মানুযায়ী জুলাই মাসের বেতন ১০ আগস্টের মধ্যে পরিশোধ করার কথা। তবে প্রাথমিক তদন্তে বাড়ির মালিকের স্ত্রীর গৃহকর্মীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কোন গৃহকর্মী সময়মতো কাজে না গেলে এবং অনুপস্থিত থাকলে ওই দিনের বেতন কাটতেন। সময়মতো উপস্থিত না হওয়া এবং অনুপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোন গৃহকর্মী অসুস্থতার কথা বললেও গৃহকর্ত্রী গৃহকর্মীদের বেতন কাটা বন্ধ করতেন না। এ নিয়ে ওই এলাকার গৃহকর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ রয়েছে। আশপাশের বাড়ির মালিকরাও এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সরেজমিন দেখা গেছে, বাড়িটির চারদিকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। সেখানে দুদিকে ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে পুলিশ। পাশেই দাঙ্গা দমনে ব্যবহৃত পুলিশের বিশেষ যান এপিসি (আর্মার পার্সোনাল ক্যারিয়ার) বসানো। পুরো এলাকায় কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। বাড়িটির সামনের গেট ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। বাড়িটির সব দরজা-জানালার কাঁচ ভাঙ্গা। নিচতলায় দারোয়ানের রুমের সামনে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। একটি বাইসাইকেল ও একটি বৈদ্যুতিক মোটর ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। পুরো বাড়িতে বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। বাড়ির বাসিন্দারা অন্যত্র চলে গেছেন। নিহত লাইলী ঘটনাস্থলের মাত্র পাঁচ থেকে ছয় শ’ গজ পূর্বদিকে মেরাদিয়া খালপাড় লাগোয়া হিন্দুপাড়ার বস্তিতে থাকতেন। সেখানে তার সঙ্গে বসবাস করতেন তারই ননদ জাহিনা। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, তারা প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে বস্তির ওই ঘরটি মাসিক তিন হাজার টাকায় ভাড়ায় বসবাস করছেন। প্রায় নয় মাস ধরে লাইলী ওই বাসায় মাসিক ছয় হাজার টাকায় কাজ করতেন। এর মধ্যে পাঁচ মাসের বেতন বকেয়া পড়েছে। শুক্রবার সকালে তার কাছ থেকে ১০ টাকা নিয়ে বিস্কুট খেয়ে কাজে যায়। টাকা নিয়ে ওই দিন রাতে লাইলীর গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। লাইলীর ঘরে মরিয়ম (৫) ও আতিকুর (৩) নামের দুটি সন্তান রয়েছে। লাইলীর বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়ার কালিরহাট বাজারসংলগ্ন সমন্বয়টারী গ্রামে। তার পিতার নাম নজরুল ইসলাম। কাকতালীয় হলেও লাইলীর স্বামীর নামও নজরুল ইসলাম। স্বামীর বাড়ি একই উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের মধ্যকাশিপুর গ্রামে। তিনি আরও জানান, লাইলীর স্বামী দেড় বছর আগে কাজের সন্ধানে ভারতে গিয়ে ধরা পড়েন। সেখানে তার তিন বছরের সাজা হয়। ইতোমধ্যে দেড় বছর সাজা খাটা হয়ে গেছে। আরও এক বছর জেলে থাকতে হবে। নজরুল কোচবিহার জেলা কারাগারে রয়েছেন। প্রসঙ্গত, কারাগারে নয় মাসে বছর। তিনি আরও জানান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে লাইলীর লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গ্রামের বাড়িতে তার দাফন হচ্ছে।
×