ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রিফাত-বিন-ত্বহা

লক্ষ্যের চেয়ে বেশি পাটের আবাদ, কৃষকের মুখে হাসি

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৫ আগস্ট ২০১৭

লক্ষ্যের চেয়ে বেশি পাটের আবাদ, কৃষকের মুখে হাসি

নড়াইলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। এতে হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। এখন সোনালি আঁশের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হাজারও কৃষক। পাট বিক্রির পাশাপাশি পাটকাঠিরও কদর রয়েছে। পাটকাঠি দিয়ে জ্বালানির পাশাপাশি গোবরের লাকড়ি তৈরি করি। এছাড়া ঘরের বেড়া, তরকারির মাচাসহ পানের বরজে পাটকাঠি ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে পাটকাঠি পোড়ানো ছাই বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। কৃষক আজিম উদ্দীন। বয়স ৪৭ বছরের কাছাকাছি। বসবাস করেন নড়াইল সদরের সরসপুর গ্রামে। চোখে-মুখে তার স্বপ্ন। ন্যায্য দামে পাট বিক্রি করে সংসারের চাকা সচল রাখার পাশাপাশি নবম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ের পড়ালেখার খরচ যোগাবেন তিনি। তাই প্রতিমণ পাট দুই হাজার টাকা দরে বিক্রির আশা তার। এ বছর ১০ শতক জমিতে পাট চাষ করেছেন। আজিম উদ্দীনের মতো হাজারও কৃষকের শত সহস্র স্বপ্ন রয়েছে সোনালি আঁশকে ঘিরে। যদিও কৃষকদের ন্যায্য দামে পাট বিক্রির দাবির চেয়ে বাজার দরে বেশ পার্থক্য রয়েছে। আঁশের মান ও রং অনুযায়ী বর্তমানে প্রতিমণ পাট এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। কৃষকদের আশঙ্কা, দাম আরও কমে যেতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এ বছর নড়াইলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পাটের ফলন বেশি হয়েছে। পাশাপাশি ফলনও ভাল হয়েছে। ২৩ হাজার ৬১৫ হেক্টর জমিতে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও চাষাবাদ হয়েছে ২৩ হাজার ৭২৫ হেক্টর জমিতে। ফলে ১১০ হেক্টর জমিতে বেশি আবাদ হয়েছে। পাটের উৎপাদন ভাল হওয়ায় হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। সোনালি আঁশে রঙিন স্বপ্ন দেখছেন তারা। এখন ন্যায্য দামের নিশ্চয়তা চায় কৃষকেরা। এদিকে, পাটকাঠির ছাই থেকে অর্জিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। এক্ষেত্রে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করেন কৃষকসহ সচেতনমহল। লোহাগড়া উপজেলার কুচিয়াবাড়ি গ্রামের তরিকুল ইসলাম জানান, ঈদ-উল ফিতরের আগে থেকেই নড়াইলে পাটকাটা ও জাগ দেয়া শুরু হয়েছে; এখন তা পুরোদমে চলছে। মাঠ-ঘাট, গ্রামীণ পথ থেকে শুরু করে সর্বত্রই এখন সোনালি আঁশের গন্ধ; পাট প্রস্তুত করার ব্যস্ততা। তবে, পাটকাটা, জাগ ও আঁশ ছাড়ানোর জন্য শ্রমিক পাওয়া কিছুটা কষ্টকর হয়েছে। বর্তমানে দিনপ্রতি ৫০০ টাকা দরে শ্রমিকের মূল্য দিতে হচ্ছে। এতে পাটের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। একজন শ্রমিক দিনে সর্বোচ্চ নয় শতক জমির পাট কাটতে পারে। তবে, ক্ষেত থেকে বাড়িতে আনা বা জাগ দেয়া সম্ভব হয় না। আর পাটের আঁশ ছাড়ানো, পানিতে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করা এবং শুকানোর জন্য আলাদা শ্রমিক প্রয়োজন হয়। একই গ্রামের জাকির শেখ বলেন, ভাল মানের পাট হলে তিন শতক জমি থেকে এক মণ পাট পাওয়া যায়। সদরের চারিখাদা গ্রামের আসলাম শেখ বলেন, এ বছর পাটের ফলন খুব ভাল হয়েছে। দাম ভাল পেলে আমাদের কোন ক্ষতি হবে না। দলজিতপুরের আব্দুর রউফ বলেন, আমাদের দাবি প্রতিমণ পাটের দাম দুই হাজার টাকা। একই গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম জানান, জমি প্রস্তুত, পাট বীজ ক্রয় ও বপন, নিড়ানি, সার, ওষুধসহ আঁশ প্রস্তুত করতে প্রতিমণ পাটে প্রায় এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা খরচ হয়। এক্ষেত্রে প্রতিমণ পাট দুই হাজার টাকা দরে বিক্রি করতে পারলে কৃষকেরা চাষাবাদে আরও উৎসাহ পাবেন। তিনি আরও জানান, এ বছর তিন বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। ফলনও ভাল হয়েছে। মাইজপাড়া পাট বাজারের বিক্রেতা মোনায়েম শেখ বলেন, বর্তমানে প্রতিমণ পাট দেড় হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ পাটকাটা একজন শ্রমিককেই দিতে হচ্ছে ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা করে। তাই প্রতিমণ পাটের দাম কমপক্ষে দুই হাজার টাকা হলে কৃষক বেঁচে থাকতে পারবেন। তা না হলে দিনে দিনে কৃষক পাট চাষে উৎসাহ হারাবেন। কালিয়া উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকেরা জানান, এ বছর পাটের উৎপাদন ভাল হওয়ায় তারা খুশি হয়েছেন। তবে, বাজার দরটা হঠাৎ করে যেন নিম্নমুখী না হয়, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা। মাইজপাড়া পাট বাজারের ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, বতর্মানে প্রতিমণ পাট এক হাজার ৬০০ টাকা দরে কেনা হচ্ছে। পরবর্তীতে দাম কমতেও পারে, আবার বাড়তেও পারে। লোহাগড়ার এড়েন্দা হাটের পাট ব্যবসায়ী রাসেল শেখ জানান, হাট-বাজারে পাটের আমদানি বেশি হলে দাম কমে যেতে পারে। দাম নিম্নমুখী হওয়া প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা বলেন, হাট-বাজারে পাটের আমদানি বেড়ে গেলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম কমিয়ে দেন। তাই স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে পাট কিনতে বাধ্য হন। এক্ষেত্রে দাম নির্ধারণসহ দরপতন রোধে পাট মন্ত্রণালয়সহ সরকারী হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। এদিকে, পাট বিক্রির পাশাপাশি পাটকাঠিরও কদর রয়েছে। নড়াইল পৌর এলাকার ডুমুরতলার ছমিরন বেগম বলেন, পাটকাঠি দিয়ে জ্বালানির পাশাপাশি গোবরের লাকড়ি তৈরি করি। এছাড়া ঘরের বেড়া, তরকারির মাচাসহ পানের বরজে পাটকাঠি ব্যবহৃত হয়। শুনেছি, বর্তমানে পাটকাঠি পোড়ানো ছাই বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। উড়ানি গ্রামের শামসুর রহমান ও চারিখাদার বাবুল মোল্যা জানান, গত বছর এক কাহন পাটকাঠি (এক হাজার ২৮০টি পাটকাঠি) সর্বোচ্চ ২০০ দরে বিক্রি হয়েছে। অথচ এর আগে এক কাহন পাটকাঠি ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ বছর ভাল দামের প্রত্যাশা করছেন তারা। নড়াইল প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি সুলতান মাহমুদ বলেন, পাটকাঠির ছাই থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। চীনসহ বিভিন্ন দেশে পাটকাঠির ছাই থেকে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি, ফেসওয়াশের উপকরণ, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, প্রসাধনপণ্য, টুথপেস্ট এবং সার তৈরি হচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে। ইতোমধ্যে মাগুরাসহ বিভিন্ন জেলায় পাটকাঠির ছাই উৎপাদন শুরু হয়েছে; যা বিদেশে রফতানি হচ্ছে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় পাটকাঠির ছাই রফতানি বাড়ালে কৃষক যেমন লাভবান হবেন, তেমনি বেশি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি সোনালি আঁশের ঐতিহ্য টিকে থাকবে যুগ থেকে যুগান্তরে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, নড়াইলের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ শেখ আমিনুল হক বলেন, এ জেলার মাটি ও আবহাওয়া পাট চাষের উপযোগী; এক্ষেত্রে নড়াইলকে পাট চাষের আদর্শ জেলা বলা যায়। পাট পচনের (জাগ) ক্ষেত্রেও রয়েছে অনেক ডোবা, নালা, খাল, বিল ও জলাশয়। এ বছর আগাম বৃষ্টি হওয়ায় পাট পচনের ক্ষেত্রে পানির কোন সমস্যা দেখা যায়নি। এছাড়া ফলন যেমন ভাল হয়েছে, তেমনি কৃষকেরা দামও ভাল পাবেন বলে আশা করছি।
×