ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসির সিয়াম

‘বন্ধুত্ব’ উপহার

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৫ আগস্ট ২০১৭

‘বন্ধুত্ব’ উপহার

প্রধান শিক্ষক নাসিমা আক্তার ক্লাস সেভেনে একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন। ছাত্ররা তাকে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে সবাইকে বসতে বললেন তিনি। এরপর সঙ্গে থাকা ছেলেটিকে দেখিয়ে বললেন, আমাদের জেলায় একজন নতুন জেলা প্রশাসক এসেছেন। তারই একমাত্র ছেলে রাহুল। আজ আমাদের স্কুলের ক্লাস সেভেনে ভর্তি হয়েছে ও। আশা করছি, তোমার সবাই ওর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করবে। প্রধান শিক্ষক চলে যাওয়ার পর রাহুল লক্ষ্য করল সবার পেছনের বেঞ্চে একজনের বসার জায়গা ফাঁকা আছে। ও সেখানে বসতে যাচ্ছিল এমন সময় একটা ছেলে হাত ধরে টেনে নিয়ে ওকে তার পাশে বসাল। রাহুল বলল, এক বেঞ্চে তিনজন বসতে অসুবিধা হবে। আমি বরং পেছনে গিয়েই বসি। ছেলেটি উত্তর দিল, নাহ, ওখানে বসো না। দেখতে পারছ না ওখানে জামাল বসে আছে! রাহুল অবাক স্বরে জানতে চাইল, তাতে কি হয়েছে? আমাদের ক্লাসের কেউই জামালের সঙ্গে মেশে না। ও খারাপ পরিবারের ছেলে। ওর বাবা স্টেশনে কুলির কাজ করে। তাছাড়া দেখ কেমন নোংরা পোশাক পরে স্কুলে এসেছে! আর কোন কথা না বাড়ালেও জামালের ব্যাপারে বেশ কৌতূহল জাগল রাহুলের মনে। ছুটির পর দফতরি মামার কাছে জানতে চাইলে ওকে সব খুলে বললেন তিনি। আসলে জামাল খুব ভাল ছেলে। বাবা কুলির কাজ করে ওকে পড়ালেখার খরচ দিতে পারে না ঠিকমতো। তাই নিজের পড়ালেখার খরচ যোগাড় করতে সন্ধ্যার পর থেকে এলাকার একটা চায়ের দোকানে কাজ করে ও। ওর নামে নাকি অনেকে খারাপ ছেলে বলে স্যারদের কাছে নালিশও করেছে! কিন্তু জামাল প্রতিবার পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে সবাইকে নিজের মতো করে জবাব দেয়। পরের দিন স্কুলে এসে জামালের পাশে গিয়ে বসল রাহুল। নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি আমার বন্ধু হবে? রাহুলের কথা শুনে কিছুটা অবাক হলো জামাল। বলল, আমার সঙ্গে তো কেউ মিশতে চায় না। বরং আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে অন্যরা আর তোমার সঙ্গে মিশবে না। -না মিশলেও চলবে, বন্ধু হিসেবে আমার তোমাকে পাশে পেলেই চলবে। রাহুলের এই কথার পর জামালও বন্ধুত্ব মেনে নিল। এরপর রাহুল তার ব্যাগ থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করে জামালের হাতে দিয়ে বলল, এখানে আমার বাড়তি একটা স্কুল শার্ট আছে, যেটা আমি তোমার জন্য নিয়ে এসেছি। দয়া বা আমার বন্ধু নোংরা পোশাক পরে বলে লজ্জা পাব এর জন্য না, আমার বন্ধুর নোংরা পোশাক নিয়ে অন্যরা বাজে কথা বলে সেটা আমি চাই না। এ জন্য বন্ধুর এই উপহার তোমাকে গ্রহণ করতেই হবে জামাল। রাহুলের জোড়াজুড়িতে জামাল শার্টটা নিতে বাধ্য হলো এবং এভাবেই ধীরে ধীরে ওদের দু’জনার মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে শুরু করে। ওরা একসঙ্গে বসে, টিফিনে রাহুলের বাসা থেকে নিয়ে আসা খাবার ভাগাভাগি করে খায়, ছুটির পর বের হয়ে ঘুরতেও যায়। একদিন রাহুলের মা স্কুলে আসলে ক্লাসের অন্য ছেলেরা রাহুলের নামে নালিশ করল যে, রাহুল জামালের মতো খারাপ ছেলের সঙ্গে মেশে এবং ছুটির পর একসঙ্গে ঘুরতে যায় বলে বাসায় ফিরতেও দেরি হয়। সবকিছু শুনে রাহুলের মা রেগে গিয়ে নিজের ছেলেকে অনেক বকাবকি করেন এবং জামালের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করে দেন। কিন্তু রাহুল কোন কথা বলেনি। দেখতে দেখতে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শেষ হয়ে রেজাল্ট দিয়ে দিল। রেজাল্ট কার্ড নিয়ে জামালকে সঙ্গে করে বাসায় ফিরে আসল রাহুল। মা বাবার সঙ্গে জামালকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, প্রতিবারের মতো এবারও জামাল পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। আর আমি সেকেন্ড হয়েছি। ছেলের কথায় রাহুলের মা একটু অবাকই হলেন! মায়ের অবাক হওয়া দেখে রাহুল এবারে হাসতে হাসতে বলতে শুরু করল, আমি পরীক্ষায় সেকেন্ড হয়েছি শুনে তুমি অবাক হয়েছ; কারণ আমি কখনই পরীক্ষায় এক থেকে দশের মধ্যে থাকতে পারিনি, তাই না মা? আমার এই রেজাল্টের পেছনে জামালেরই অবদান। ছুটির পর স্কুলের পেছনের দিকের একটা খোলা জায়গা আছে যেখানে কেউ যাতায়াত করে না, সেখানে বসে আমাকে ক্লাসের পড়াগুলো বুঝতে সাহায্য করত ও। যার জন্যই প্রায় দিনই আমার বাসায় ফিরতে দেরি হতো। রাহুলের বাবাও পড়ালেখায় ছেলের এই উন্নতি দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি জামালকে দেখিয়ে বললেন, জামালের মতো ভাল একটা বন্ধু পেলে জীবনই বদলে যায়। এখন থেকে তোমাদের মিশতে আর কেউ বাধা দেবে না। রাহুলের মাও অবশেষে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। দু’জনকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, আজ তোমাদের আমি ‘বন্ধুত্ব’ উপহার দিলাম। আশা করি তোমরা দু’জনে এই উপহার যতœ করে চলবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ১ম বর্ষ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×