ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চোখের বালির বিনোদিনী

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ৪ আগস্ট ২০১৭

চোখের বালির বিনোদিনী

নাজনীন বেগম ।। সৃজনশীলতা দীর্ঘ যাত্রাপথে বহুমাত্রিক আঙিনায় রবীন্দ্রনাথের দীপ্ত বিচরণ ছিল অব্যাহত, নিরন্তর এবং অনেকাংশে কঠিন সমাজ আর জীবননির্ভর। সেই বিবেচনায় উপন্যাসেও তিনি একজন সিদ্ধ পুরুষ। উনিশ শতকের সাহিত্যিক অঙ্গনে উপন্যাসের বিস্তৃত বলয় বঙ্কিমচন্দ্রের একচ্ছত্র আধিপত্যে পরিপুষ্ট, আলোচিত এবং প্রভাবিত। বিদ্যাসাগরের নারীবিষয়ক বহুবিধ কর্মযোগে বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ হওয়া, নারী শিক্ষার অবাধ গতি পাওয়া, বাল্যবিবাহ রোধ করা তৎকালীন বাঙালী সমাজকে নতুন পথের সন্ধান দেয়। ইউরোপীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি সভ্যতার প্রভাব বাঙালীর মন ও মননে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রাখে। জ্ঞানী গুণীর মহাসম্মিলনে ঠাকুরবাড়ির সমৃদ্ধ পরিবেশ বঙ্গীয় রেনেসাঁসের আর এক সফল সংযোজন। এসব মিলিয়ে রবীন্দ্র চেতনায় যে ‘উপন্যাস ভাবনা’ তা সঙ্গত কারণেই উনিশ শতকের সামাজিক বলয়ের এক বাস্তব প্রতিফলন। ‘চোখের বালি’ উপন্যাসও সেই সম্ভাবনায় দিক নির্দেশক। ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ সাল ধরে লেখা উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘চোখের বালি’ শুধু রবীন্দ্র সাহিত্যেই নয় সমগ্র বাংলা সাহিত্যে এক বিশিষ্ট মাইলফলক। আধুনিক এবং সনাতন ব্যবস্থায় ঘুরপাক খাওয়া এই উপন্যাসের সামাজিক আবেদন ভিন্নমাত্রার দাবি করে। বিভিন্ন চরিত্রের মনোরাজ্যের নানাবিধ সংকট, অন্তর্দ্বন্দ্ব, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনায় পরিপূর্ণ চোখের বালি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনস্তাত্ত্বিক আলেখ্য হিসেবে খ্যাত, সমাদৃত। নব্য সংস্কৃতি এবং প্রাচীন ধারার পুষ্ট ‘চোখের বালি’ সমাজের অলিগলিতে যেমন সদর্প পদচারণ একইভাবে মনোজগতের সূক্ষ্ম অনুভবের স্পর্শকাতর চেতনার শৈল্পিক বৈভবে রবীন্দ্রনাথ শুধু সফল উপন্যাসিকই নন, একজন বিচক্ষণ মনোসমীক্ষকও। সমাজ ও মনের বিচিত্র সমন্বয়ে ‘চোখের বালি’ কবির সৃষ্টিসম্ভারের এক বিশিষ্ট যোগ। পুরো গ্রন্থটিতে যার দৃপ্তচারণা পাঠককে প্রলুব্ধ ও বিস্মিত করে সেই বিনোদিনীই চোখের বালির মূল আকর্ষণ, এমন কি প্রাণশক্তিও বটে। শুরুতে নবজাগরণের সিক্ত আঙিনায় পথ চলা ধীরে ধীরে প্রাচীনপন্থায় আত্মসমর্পণ করা। সত্যিই এক অভিনব নারীসত্তা যা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ঐশ্বর্যে সযতেœ গড়া হয়। নতুন-পুরনোর দ্বন্দ্বই শুধু নয়, মনের নিভৃত সরোবরে পরিপূর্ণ অবগাহন। বইটির ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য তুলে ধরেনÑ বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ উপন্যাসের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এর ব্যতিক্রমী কিছু করা যায় কিনা সে সম্পর্কে সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করেন। বিকল্প বিষয় হিসেবে মনোসংসারে বিচরণ করাকে অপেক্ষাকৃত শ্রেয় বলে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস। যা বাংলা সাহিত্যেও নতুন ধারা তৈরিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখবে। সঙ্গত কারণেই ধরে নেয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষের’ কুন্দনন্দিনী কিংবা ‘কৃষ্ণকান্ত উইলের রোহিনী চরিত্র থেকে অনেকটাই আলাদাভাবে তৈরি করতে চান বিনোদিনীকে তার স্রষ্টা। সমাজ নির্ধারিত অন্যতম নিয়মবিধি আবর্তে পড়া বিধবার জীবনধারাই নয়, তার অন্তরের সূক্ষ্ম অনুভূতি মনের গভীরে লালন করা দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা আর আনন্দের বিচিত্র টানাপড়েন সবই ধরা পড়ে লেখকের মনোদৃষ্টিতে। মানবচেতনায় তিনি অবগাহন করেন বিনোদিনীর অন্তরের গভীর অনুভবে যেখানে সে শুধু বিধবাই নয়, একজন পূর্ণ নারীসত্তা, আখ্যানটির সূচনাপর্ব থেকেই নব্যধারায় সিক্ত বিনোদিনী কবির সচেতন নান্দনিক সত্তায় বিকাশ লাভ করে। নারী হিসেবে তার সমস্ত আবেগ, উচ্ছ্বাস, আশা, আকাক্সক্ষা লেখকের সযতœ স্পর্শে প্রাণবন্ত হয়, গতি পায় এবং পরিণতিতে স্বপ্নচ্যুতির, আশাভঙ্গের তাড়নায় বিদ্ধ হয়। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, স্বাধীনচেতা, গৃহস্থালিতে সিদ্ধহস্ত, কর্মে নিপুণ, পরিশ্রমী বিনোদিনী রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সম্ভারে এক অপূর্ব রমণীয় নারীসত্তা। কিন্তু সাংসারিক টানাপড়েনে যখন জীবন ও মনের ওপর ভাঙনের খেলা শুরু হয় তখন লেখক নিজেও বিনোদিনীর পরিণতি নিয়ে শঙ্কিত। ফলে শুধু আশা-মহেন্দ্রের জীবন থেকেই নয় অবিবাহিত বিহারীর থেকেও ছিটকে পড়ে কবির মাধুরী দিয়ে তৈরি করা তাঁর আকাক্সিক্ষত নায়িকা। আলোচক, সমালোচকদের ধারণা রক্ষণশীল সমাজ কবির পথরোধ করে। আর তাই বিধিবদ্ধ সামাজিক অনুশাসনের পীড়ন থেকে গল্পের নায়িকাকে নতুন করে জীবন গড়ার পথ দেখাতে ব্যর্থ হলেন। তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায় বিনোদিনী নিজেই কি অন্য জীবনে পা দিতে চেয়েছিল যেটা তার স্রষ্টা তাকে দিতে পারলেন না পাঠক লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে গৃহদাহের আগুন জ্বালানেও নায়িকা প্রচলিত সমাজ সংস্কারের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেনি। এমননি প্রচলিত রক্ষণশীল শৃঙ্খলকে ভাঙতেও চায়নি। লেখক নিজেই এখানে তার নায়িকার গতি প্রকৃতি নির্ণয় করে দিয়েছেন যেখানে পরিণতি ও নিয়মমাফিক হয় বলে অনেক রবীন্দ্র গবেষকের ধারণা। এখানে বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ সনৎ কুমার সাহার বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেন- সাহিত্যের ন্যায় খ-িত হয়, যদি লেখকের নিরাসক্তি ভেঙে যায়, যদি তাদের মাঝখানে বাইরে থেকে নিজেকে আরোপ করে ঘটনার স্বাভাবিক গতি যেমন খুশি পালটে দিয়ে তাদের হয়ে ওঠার সঙ্গত পরিণতি থেকে তিনি তাদের সরিয়ে আনেন।’ কাহিনীর গতিপথ নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে স্রষ্টাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। এর ব্যত্যয় হলে সাহিত্যিক শুদ্ধ চেতনার অঙ্গহানি হয়। বিনোদিনীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ঘটনাপরম্পরায়, মনোজাগতিক টানাপোড়েন ব্যক্তিত্ব আর আদর্শের নির্মোহ আবেগে বিনোদিনীর গন্তব্য কাহিনীর সাবলীলতায় সেখানেই পৌঁছেছে। লেখক সেখানে উপলক্ষ মাত্র। সবশেষে বিখ্যাত রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ প্রমথনাথ বিশীর বিনোদিনীকে নিয়ে তার ব্যক্তিক অনুভূতি তুলে ধরে বলা বলা যায়, বিনোদিনীকে দিয়ে রবীনন্দ্রনাথ যদি আশা-মহেন্দের ঘর ভেঙে দিতেন তা কি খুব আধুনিক হতো না যৌক্তিক না কাক্সিক্ষত? এই প্রশ্ন থেকেই যায়। সুতরাং এ কথাও মেনে নেয়া যায় না রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন পন্থাকে আঁকড়ে ধরে তাঁর নায়িকার যথার্থ পরিণতি ঠিক করতে পারেননি।
×