ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অবশেষে টানা ৯ ঘণ্টার অপারেশনে আলাদা হলো তোফা ও তহুরা

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২ আগস্ট ২০১৭

অবশেষে টানা ৯ ঘণ্টার অপারেশনে আলাদা হলো তোফা ও তহুরা

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ তোফা ও তহুরা এখন আলাদা। জন্মের সময় জোড়া অবস্থায় তারা পৃথিবীর আলো দেখে। দশ মাস পর ওদের শরীরে অস্ত্রোপচারের পর আলাদা করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে জরুরী বিভাগের তৃতীয় তলার অপারেশন থিয়েটারে টানা নয় ঘণ্টা জটিল অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে ওদের আলাদা করে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পেরেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা। বাংলাদেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি বিরল ঘটনা। শিশু সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘পাইগোপেগাস’ শিশু আলাদা করার ঘটনা এটি প্রথম। এর আগে অন্যান্য হাসপাতালে তিন জোড়া শিশুকে অস্ত্রোপচার করে আলাদা করা হয়েছে। তাদের ধরন ছিল আলাদা। মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক কানিজ হাসিনা শিউলি সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। তিনি জানান, ওরা দু’জন এখন আলাদা। দু’জনের অবস্থাই স্থিতিশীল। এখনও ওদের আলাদা শরীরের কিছু সংস্কারের (রিপোর্টিংয়ের) কাজ বাকি আছে। আরও দুই-তিন ঘণ্টা সময় আমাদের লাগবে। অধ্যাপক ডাঃ কানিজ হাসিনা জানান, আমরা দীর্ঘ সাড়ে ৬ ঘণ্টা অপারেশন চালিয়ে তোফা ও তহুরাকে আলাদা করেছি। বর্তমানে তারা সুস্থ ও স্বাভাবিক রয়েছে। প্রতিটি মুহূর্ত তাদের পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আপাতত আর কিছু বলা যাচ্ছে না। পরে বিস্তারিত জানানো হবে। এ সময় অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসেন কয়েক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। চিকিৎসক রাজিউল হাসান, এস এম শফিকুল আলম, অসীত চন্দ্র সরকার, আশরাফুল হক, আব্দুল হানিফ অধ্যাপক কানিজ হাসিনার সঙ্গে সুর মিলিয়ে সাংবাদিকদের জানান, দুই শিশুর স্পাইনাল কর্ড, মেরুদণ্ড, পায়খানার রাস্তা ও প্রস্রাবের রাস্তা আলাদা করা হয়েছে। জন্মের পর থেকে ১০ মাস তোফা ও তহুরা একসঙ্গে বড় হয়েছে। পিঠের কাছ থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত তারা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। দু’জনের পায়খানার রাস্তা ছিল একটি। তবে মাথা-হাত-পা ছিল আলাদা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এর আগে জোড়া শিশু তোফা ও তহুরার অপারেশনের প্রক্রিয়া শুরু হয় সকাল ৮টার দিকে। ঢামেক হাসপাতালের জরুরী বিভাগের তৃতীয় তলায় নিউরোসার্জারি বিভাগের অস্ত্রোপচার কক্ষে এই অপারেশন হয়। ৯টা ৪০ মিনিট থেকে ১৬-১৭ জনের বিশেষজ্ঞ টিম তাদের শরীরে অস্ত্রোপচার শুরু করেন। অপারেশন চলমান অবস্থায় বেলা ১২টার দিকে চীফ এ্যাডভাইজার ও বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে। তিনি অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের জানান, কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে এত বড় অপারেশনের কথা ভাবা যেত না। আপনারা বেশি করে প্রচার করুন। আমাদের চিকিৎসকরা কত বড় অপারেশন করতে পারে। আপনারা দেখান। দুই শিশুর বাবা মোঃ রাজু জানান, তার বিশ্বাস তাদের দুই শিশু তাদের কাছে ফিরে আসবে। আমিতো গরিব মানুষ। ক্ষেতে কাজ করি। কারও কোন ক্ষতি করি না। খোদাও আমাগো দেখবে। অস্ত্রোপচার চলমান অবস্থায় অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন দুই শিশুর নানা শহীদুল ইসলাম ও সঙ্গে ছিল তাদের পাঁচ বছর বয়সী ভাই শাহাদাত। শিশুদের নানা শহীদুল সাংবাদিকদের জানান, আমার নাতিনদের জন্য দোয়া করবেন। দেশবাসীকে দোয়া করতে বলবেন। এর আগে সকালে অস্ত্রোপচার শুরুর পর ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ঝুঁকি থাকলেও আমরা আশাবাদী। বাচ্চা দু’টির মধ্যে তোফা বেশি সক্রিয়। আর তহুরা একটু কম সক্রিয়। আশা করছি অস্ত্রোপচারের পর তারা সুস্থ হয়ে উঠবে। বিভিন্ন বিভাগের ৩০ জনের মতো চিকিৎসক দু’টি দলে ভাগ হয়ে দীর্ঘ এই অস্ত্রোপচারে অংশ নেন। অচেতন করাসহ প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষে একদল চিকিৎসক শিশু দুটির দেহ আলাদা করার কাজ শুরু করেন। দুপুর পৌনে ১টার দিকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে বোর্ডের প্রধান শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আশরাফুল হক কাজল সাংবাদিকদের জানান, তোফা ও তহুরার স্পাইনাল কর্ড ও মেরুদণ্ড আলাদা করতে পেরেছেন তারা। এ পর্যন্ত যতটুকু সম্পন্ন হয়েছে। তা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। শিশু দুটি ভাল আছে। দুই শিশুকে আলাদা করার পর দুপুরে চিকিৎসকদের অন্য দলটি শুরু করেন দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। বিকেল ৫টার দিকে চীফ এ্যাডভাইজার ও বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডাঃ সামন্ত লাল সেন জানান, দুপুর আড়াইটার দিকে দুই শিশুকে আলাদা করা হয়েছে। মেজর অপারেশন হয়ে গেছে। তারা এখন সুস্থ আছে। তিনি জানান, আলাদা করার পর দুটো অপারেশন থিয়েটারে রেখে দুই দলে ভাগ হয়ে কাজ করছেন সার্জনরা। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। অস্ত্রোপচারের কাজ শেষ করে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার শাহনূর ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, বিকেল ৫টার দিকে শিশু দু’টির অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে। দুপুর আড়াইটার মধ্যে তাদের আলাদা করে কিছু কাজ বাকি ছিল। আড়াই ঘণ্টার পর বিকেল ৫টা পর্যন্ত পুরো অস্ত্রোপচারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখনও পর্যন্ত শিশু দু’টি সুস্থ আছে। তাদের চেতনা ফিরে এসেছে। তারা এখন কান্নাকাটি করছে। ইনফেকশনের ভয় আছে বিধায় তাদের মাকে আসতে দেয়া হচ্ছে না। তবে কিছুক্ষণ পর তাদের কাছে মাকে দেয়া হবে। তবে বাবা-মাকে তাদের সন্তান তোফা ও তহুরাকে দেখানো হয়েছে। দোয়া করবেন শিশু দু’টি সুস্থ হয়ে যাতে বাড়ি ফিরে যেতে পারে। সহযোগী শাহনূর ইসলাম জানান, গত ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় নিজ বাড়িতে দাইয়ের মাধ্যমে রাজু মিয়া ও সাহিদা আক্তার দম্পতির এই জোড়া শিশুর জন্ম হয়। তিনি জানান, এরপর গত বছরের ৭ অক্টোবর ৯দিন বয়সে জোড়া শিশু দুটিকে চিকিৎসার জন্য গাইবান্ধা সিভিল সার্জনের মাধ্যমে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। পরে জোড়া লাগা শিশু দু’টিকে ভর্তি রাখা হয়। পরবর্তীতে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে জোড়া শিশু দুটির প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা হয়। তখন ছোট একটি অপারেশনের মাধ্যমে তাদের পায়খানার রাস্তা আলাদা করে দেয়া হয়। শিশু দুটির রক্তে সেপটিসেমিয়া ও ওজন ছিল সাড়ে ৪ কেজি। যা অস্ত্রোপচারের জন্য উপযুক্ত ছিল না। এখন জোড়া শিশু ২টির ওজন ১০ কেজি। তাদের অস্ত্রোপচারের জন্য উপযুক্ত করে তোলা হয়। সহযোগী অধ্যাপক শাহনূর ইসলাম জানান, শিশু দুটির অস্ত্রোপচারের জন্য শিশু সার্জারি, নিউরো সার্জারি, ইউরোলজি, রেডিওলজি ও প্লাস্টিক সার্জারিসহ আরও বেশ কয়েকটি বিভাগের চিকিৎসকের সমন্বয়ে ১৬ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। এই মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান ডাক্তার শাহনূর নিজেই এবং এই বোর্ডের মোট সদস্য ৩০ জন।
×