ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

রায়টি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ২১ জুলাই ২০১৭

রায়টি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে

এখনও সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি ভুলতে পারেনি আদুরী। ৪ বছর আগে গৃহকর্ত্রীর পাশবিকতার সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। চোখে-মুখে-শরীরে এখনও দৃশ্যমান ক্ষতচিহ্নগুলো। আদুরির কষ্টভরা এমন জীবনে যেন এক পশলা স্বস্তির সুবাতাস বয়ে গেছে মঙ্গলবার। যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে সেই গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীর। রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে আদুরী ও তার পরিবার। বিশ্লেষকদের অভিমত গৃহকর্মী নির্যাতনের ক্ষেত্রে এ রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এতে গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা বাড়বে। এ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেছেন, এই রায় নির্যাতনকারীদের মনে ভয় জাগাবে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, এ রায় মানুষের মনে স্বস্তি তৈরি করবে। এতদিন এই ধরনের অন্যায় করে যারা পার পেয়ে যেত এই রায়ের মাধ্যমে সবার কাছে নিশ্চয়ই একটি ভীতিকর বার্তা পৌঁছেছে। বহু বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কিশোরী মেয়েরা কাজ করে থাকে। সংসারের সার্বক্ষণিক দেখাশোনা ছাড়াও সন্তান পালন, পানি তোলা, ঘর মোছা, হাঁড়ি-পাতিল-বাসন ও কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করা, সবজি কাটা, বাটনা বাটা যাবতীয় কাজ তারা করে থাকে। বিনিময়ে তারা পায় খাবার, পোশাক-পরিচ্ছদ। অনেক ক্ষেত্রে গৃহকর্তা/কর্ত্রী তাদের তালা দিয়ে বন্ধ করে কর্মক্ষেত্রে যান। ফলে তারা বন্দীজীবন কাটাতে বাধ্য হয়। এই জীবনকে অনেকে ভাগ্যলিপি বলে মেনে নিয়েছে। সমস্যা সৃষ্টি হয় তখনই যখন পান থেকে চুন খসার মতো তুচ্ছ ঘটনা ঘটে। দুটির জায়গায় তিনটি মরিচ পোড়ানোর জন্য, ভাত পুড়ে গেলে, গৃহকর্ত্রীর সন্তান একটু আঘাত পেলে, প্লেট বা গ্লাস ভেঙ্গে ফেললে, আরও নানা তুচ্ছ কারণে একজন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের কেউ কেউ যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়। তাদের ১২-১৫ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। নেই ছুটি, নেই অবসর। এদের বসতে দেয়া হয় মেঝেতে, ঘুমাতে দেয়া হয় রান্নাঘরে। এদেরই একজন ছিল আদুরী। ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকার একটি ডাস্টবিন থেকে ১১ বছর বয়সী আদুরীকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের একটি ফ্ল্যাটে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত আদুরী। শুরু থেকেই তুচ্ছ কারণে প্রায়ই তার ওপর শারীরিক নির্যাতন চলত। একদিন গৃহকর্ত্রীর অগোচরে একজোড়া দুল কানে পরে শখ মেটানোর চেষ্টা করে আদরী। গৃহকর্ত্রী এই অপরাধে তাকে বেদম মারধর করে। ব্লেড দিয়ে কাটা হয় আদরীর শরীর। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে গৃহকর্ত্রী ডাস্টবিনে ফেলে আসে। উদ্ধারের তিনদিন পর এ ঘটনায় গৃহকর্ত্রী নদীসহ পাঁচজনকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন আদুরীর মামা নজরুল ইসলাম। অতীতে গৃহকর্মী নির্যাতন মামলায় আসামিদের প্রাপ্য সাজা হয়েছে এমন নজির নেই। আদালতে এধরনের মামলার অধিকাংশই চূড়ান্ত রায় পর্যন্ত পৌঁছায় না। বেশিরভাগ ঘটনাই লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়। দারিদ্র্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই মামলার বাদীরা অভিযুক্তদের সঙ্গে রফা করে মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন। তবে আদুরীর মামলার ক্ষেত্রে মহিলা আইনজীবী সমিতিসহ সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতায় এই মামলার দৃষ্টান্তমূলক রায় হয়েছে। একথা সত্য যে, সহায়তার অভাবে এ ধরনের মামলার বাদীরা মামলা এগিয়ে নিতে পারেন না। চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে সমঝোতায় রাজি হন। কিছুদিন আগে এক খেলোয়াড়ের বাসায় কাজের মেয়ে নির্যাতনের মামলায় রায় দেখে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছে। কারও কারও ধারণা সেখানে বাদী-বিবাদীর সমঝোতায় মামলার স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়েছে। তাই আদুরীদের মতো দরিদ্র বিচারপ্রত্যাশীদের সহায়তা দেয়া জরুরী। যথাযথ আইনী সহায়তা পেলে দুর্বল বাদীও সমঝোতায় না গিয়ে বিচার নিশ্চিত করবেন। সবাই মনে করে উচ্চ আদালতেও এই রায় বহাল থাকবে। এই রায়ের মাধ্যমে গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের পরিসমাপ্তি হোকÑ এটাই সবার প্রত্যাশা।
×