ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কামাল লোহানী

খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর এবং নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ার প্রশ্ন

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৯ জুলাই ২০১৭

খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর এবং নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ার প্রশ্ন

‘ম্যাডাম’ খালেদা জিয়া ‘ভিশন ২০৩০’ প্রকাশ্যে পাঠ করার পরও প্রাণে স্বস্তিবোধ করছিলেন না। তাই তিনি চোখ এবং পায়ের ‘চিকিৎসার’ অজুহাতে সাত সাগর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে বিলেতে পৌঁছেছেন। উঠবেন ‘পলাতক’ বড় ছেলে তারেক রহমানের বাসভবনে। থাকবেন দেড় মাস। ম্যাডামের সহচরী এক বিএনপি নেত্রী লন্ডন সফরের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘ভাঁড়ার ঘরে কে, না আমি কলা খাই না’ অনেকটা এমনই ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন লন্ডনে যখন যাচ্ছেন তখন দলীয় সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তদীয় সুপুত্র তারেক জিয়ার সঙ্গে আলোচনাও করবেন। এটা খুবই স্বাভাবিক। কিছুদিন পরে একজন আইনজীবী নেত্রী বললেন, তাঁর চোখে ছোট্ট একটা অপারেশন করতে হবে তাই তিনি লন্ডন যাচ্ছেন। তাঁর পুত্রবধূ অর্থাৎ তারেক স্ত্রী একজন চিকিৎসক। সুতরাং এই অপারেশন করার সময় নিজের একজনকেও চিকিৎসক হিসেবে কাছে পাবেন। এটাও বুঝি তাঁর স্বস্তি, তবে সাধারণের কাছে অজুহাতটি মন্দ নয়। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ থেকে বিত্তশালী ধন্যাঢ্য ব্যক্তিও- সবাই না হলেও অধিকাংশই ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল অপারেশন করে থাকেন। মাদাম খালেদা জিয়ার চোখ বলে কথা, তাঁর অপারেশন তো অবশ্যই নিশ্চিত ও নিরাপদ পরিবেশেই করাতে হবে। কারণ তাঁকে প্রায় দেড় বছর পেরিয়ে যে জাতীয় নির্বাচন আসছে, তার দিকে এখন থেকে তাকাতে হচ্ছে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার, যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি দানে পারঙ্গম সরকারকে বিরোধিতা করতে হলে তাঁকে তো চক্ষুষ্মান হতেই হবে। তাই তিনি কোমড়ে আঁচল গুজে স্মার্ট হয়ে জনগণের সামনে উপস্থিত হওয়ার জন্যে জখমি পায়েরও নাকি চিকিৎসা করাবেন। যা হোক, এ তো আমার, আমাদের, এমনকি জাতির কাছেও একটি সুখবর! এমনি একজন ‘নেত্রী’ যিনি দাবি করেন তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীরও ভূমিকা পালন করেছেন সংসদে গিয়েও না গিয়েও, তার পক্ষে তো অসুস্থ থাকলে সামনের নির্বাচনী লড়াই লড়াটা কঠিন হয়ে যাবে। যদিও প্রতিপক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী নেত্রী শেখ হাসিনা অনেক দৃঢ়প্রত্যয়ী এবং জনমনে তাঁর শাসনে প্রভূত উন্নয়নের ‘কারিশমা’ দেখিয়ে যাচ্ছেন, তাঁকে লড়বেন কি করে? অবশ্য ম্যাডামও কম যান না। তিনি তো বিলেতে গেছেন সহায়ক সরকারের পরিকাঠামো এবং শব্দাবলী কি হবে তা নির্মাণের জন্য। কারণ, এখন তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয় ভাষা পালটে বলছেন সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। তিনি বলেই গেছেন শেখ হাসিনাকে বাদ না দিলে নাকি ‘লেভেল প্লেইং গ্রাউন্ড’ হবে না। সুতরাং দেশে বসে তিনি তার দল, তার মহাসচিব, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব, উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্যÑ সবাই না হলেও কয়েকজন ‘হরবলার’ মতো নানাভাবে সহায়ক সরকারের কথা বলে চলেছেন। কিন্তু আমরা তো দেখলাম তারা আন্দোলনের যেসব কথা বলেছিলেন তার ধারে কাছেও যাচ্ছেন না এখনও। কথা দিয়েছিলেন রোযার পরে জবরদস্ত আন্দোলনে বর্তমান সরকারকে ফেলেই দেবে। হায়রে রাজনীতির বোলচাল! কত কথা নেতা-পাতিনেতা সবাই বলে চলেছেন প্রচ- ভারি ভারি কথা, বলতে পারেন গর্জন, তারপরে দেখছি ‘বহ্বারম্ভে’। অবশ্য গুলশানে চেয়ারম্যানের অফিসে কিংবা নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে অথবা প্রেসক্লাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানে, বড়জোর প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে, ওহ কী তড়পানিই না দেখছি। তবে আমার কাছে, কিছু মনে নেবেন না ম্যাডাম রাজনৈতিক নেতা অথবা দলীয় প্রধান হিসেবে বক্তব্যের যে উত্থান পতনের ষড়গ্রাম লক্ষ্য করি তা আপনার বক্তব্যে অনুপস্থিত। ভারপ্রাপ্ত কাটিয়ে মহাসচিব হওয়া মির্জা সাহেব একসময় বাম ঘরানার লোক ছিলেন, তিনি যখন বক্তব্য দেন তখন সেইকালের শেখা শব্দ এবং বাক্য দিয়ে নিজের ভাব প্রকাশ করেন। তবে তার ধার তেমন থাকে না। কিন্তু নয়া পল্টন অফিসে খাঁচায় স্বেচ্ছাবন্দী রুহুল কবির রিজভী সাহেব ‘বাম’ প্রশিক্ষণে আয়ত্ত করা শব্দাবলী যেভাবে ক্রোধের সঙ্গে প্রকাশ করেন তা সত্যিই ‘প্রশংসা’র যোগ্য। তবে তাঁর কথামালা কেবলই প্রতিপক্ষের প্রতি বৈরী আক্রমণে ঋদ্ধ। এঁরা সকলেই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুক্তি এবং বাস্তবের ধার ধারেন না। যা বলেন তা কেবল ১৪ দলীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিষদগার। সরকার যদি ভাল কিছু করে তাহলেও তারা অকারণে ভবিষ্যতে ঘটবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে। আর না করলে তো বিষাক্ত বান ছোড়েন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু চৌধুরী ব্যবসায়ী হলেও রাজনীতিতে সফল হয়েছেন তাঁর আচার-আচরণে এবং মন্ত্রীও হয়েছিলেন। ইদানীং মনে হয় চট্টগ্রামের স্থানীয় বিএনপি রাজিনীতিতে এই ভদ্রলোক আরেক বাম ঘরানার দীর্ঘ কালের রাজনীতি করা নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান এবং পরে মীর নাসিরকে ছাড়িয়েও শীর্ষে উঠে এসেছেন তাঁর কথাবার্তা বলার কারণে। ম্যাডামের চোখের ছোট্ট অপারেশন এবং পায়ের চিকিৎসার জন্যে দেড় মাসে লন্ডনে যে থাকবেন, লন্ডন যাত্রায় যারা তাঁর সঙ্গী হয়েছেন তাদের মধ্যে আমির খসরু“চৌধুরী এবং একজন মহিলা ব্যারিস্টারও রয়েছেন। ম্যাডামের চিকিৎসার প্রয়োজনে এদের দরকার না হলেও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে বসে সহায়ক সরকারের কাঠামো নির্মাণে আইনী ও রাজনৈতিক বুদ্ধি পরামর্শ দিতে পারবেন। আমরা জনগণ দেড় মাস অপেক্ষায় থাকলাম। বিলেতে যে মূসিক প্রসব করবে দেড় মাস পরে ম্যাডাম ঢাকায় ফিরলে তার চিৎকার আমরা শুনতে পাব। তবে এটা ঠিক বিএনপি এবারে নির্বাচনে যে আসবে তা তৃণমূল থেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ, নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে বিধান মতে রাজনৈতিক দল হিসেবে তাঁর নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। ভাতটা মুখে তুলছেন বটে কিন্তু সোজাপথে নয় হাতটা ঘুরিয়ে। না হলে অস্তিত্বহীনতার যে ভয়ানক পরিণতি অপেক্ষমাণ, বাইরে প্রকাশ না থাকলেও ভিতরে ভিতরে কিন্তু প্রচণ্ড হৃদকম্পন শুরু হয়েছে। তাই লন্ডন প্রেসক্রিপশন হাতে পেলে এবং ঢাকা পৌঁছলে রোগী-বিএনপি কেমন করে কতটা সেরে উঠে দেশবাসী সেই অপেক্ষায় রইল। ১৬/০৭/২০১৭ লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক
×