ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৬ জুলাই ২০১৭

১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ

ফিরোজ মান্না/মোস্তাফিজুর রহমান টিটু, গাজীপুর থেকে ফিরে ॥ আকাশ থেকে বার্তা আসবে। সেই বার্তা নিয়ন্ত্রণ ও বিতরণ করার মহাকর্মযজ্ঞ চলছে গাজীপুরের টেলিযোগাযোগে স্টাফ কলেজের পাশেই ৪০ একর জমির ওপর। এখানেই নির্মাণ করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশন। আগামী ডিসেম্বর থেকেই ৪০ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে। দেশে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার হবে। বর্তমানে হংকং ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক স্যাটেলাইটগুলো প্রতিবছর ১২ কোটি টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে। এই ভাড়া থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পাবে। বরং নিজস্ব স্যাটেলাইট দিয়ে অনেক বেশি টাকা আয় করা সম্ভব হবে। শনিবার ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর গ্রাউন্ড স্টেশন পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শনকালে তিনি বলেন, চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হবে। এটি একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। তবে আমেরিকার আবহাওয়া এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে ডিসেম্বরে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হবে কি হবে না। আমেরিকার ফ্লোরিডায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণকাজ চলছে। নির্মাণকাজ ৮৮ ভাগ শেষ হয়েছে। সেখানে যদি আবহাওয়া জনিত কোন সমস্যা না হয় তাহলে, নির্ধারিত দিনে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের জন্য আমরা শতভাগ প্রস্তুত রয়েছি। এই লক্ষ্য নিয়েই আমাদের কাজ এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের কাজ ৮৮ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ নবেম্বরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। গ্রাউন্ড স্টেশনের যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোগত কাজ ৯৫ ভাগ শেষ হয়েছে। জেনারেটর ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ প্রায় একশ’ ভাগ হয়েছে। ১০ টন ওজনের এ্যান্টেনা স্থাপনের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। দুটি এ্যান্টেনা স্থাপন করা হয়েছে। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি রুমের কাজও শেষ। চলছে এনওসিসি (নেটওয়ার্কং ব্রটকাস্টিং রুমের কাজ। আগামী অক্টোবরেই গ্রাউন্ড স্টেশনের কাজ সম্পন্ন হবে। এ স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণের আগে নবেম্বরে পরীক্ষামূলক কাজ করা হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের পর আগামী এপ্রিল হতে আনুষ্ঠানিকভাবে এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হবে। এ জন্য রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে স্যাটেলাইট কোম্পানি। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ব্রডকাস্টিংয়ের ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতা কমানো এবং দুর্গম এলাকায় সেবা বিস্তারের জন্য সরকার মহাকাশের কক্ষপথে বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। স্যাটেলাইটটি চালু হলে দেশে তথ্য যোগাযোগ, ই-লার্নিং, ই-ফার্মিং, স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক উন্নতি হবে। আমরা এখন মহাকাশ জয় করার অপেক্ষায় আছি। মহাকাশে বাংলাদেশ থাকবে এটা একটা অন্যরকম বিজয়। মহাকাশের স্যাটেলাইটটি ১১৯ ডিগ্রীতে স্থাপন করা হবে। তবে ৩৬ হাজার কিলোমিটার ওপর দিয়ে স্যাটেলাইটটি পৃথিবী প্রদক্ষিণ করবে। ১০৪ ডিগ্রী নর্থ ইস্ট দিয়ে স্যাটেলাইটটি ঘুরবে। সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে বলা হয়, এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর বিদেশী স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। অন্যদিকে স্যাটেলাইটের অব্যবহৃত তরঙ্গ ভাড়া দিয়ে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করাও সম্ভব হবে। বিটিআরসি ২০০৮ সালে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য আইটিইউয়ের কাছে ইলেক্ট্রনিক ফাইলিং দাখিলসহ প্রাথমিক কার্যক্রম শেষ করেছিল। দীর্ঘপথ পার হয়ে এখন নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে খুব বেশি সময় বাকি নেই। ২ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পর কার্যক্রম শুরু করলে আশপাশের বেশ কয়েকটি দেশ টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচার সেবা দেয়ার জন্য জিয়োসিক্রোনাস স্যাটেলাইট সিস্টেম (৪০টি ট্যান্সপন্ডার, ২৬ কেইউ ব্যান্ড, ১৪ সি ব্যান্ড)-এর গ্রাউন্ড সিস্টেমসহ সব ধরনের সেবা পাওয়া যাবে। এতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে এলইওপি (কিক অফ মিটিং), জিএসআরএফ (ইক্যুইপমেন্ট ফ্যাক্টরি এ্যাকস্টেন্স টেস্ট), অমনি এ্যান্টেনা এ্যাভেএবুল এট কানস ফরম টুলেস ফ্যাসালিটি), টিআরবি (টেস্ট রিভিউ বোর্ড), ডিআরবি (টান্সমিটার ডিজাইন বোর্ড) সর্বশেষ ২৮ ফেব্রুয়ারি টিসিআর (চেকিং এ্যান্ড ইন্টিগ্রেশন মিটিং) হয়েছে ও পাওয়ার স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচার সেবার পাশাপাশি টেলিমেডিসিন, ই-লার্নিং, ই-এডুকেশন, ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) ইত্যাদি সেবা প্রদান করা হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ টেরিস্ট্রিয়াল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা বহাল থাকা, পরিবেশ যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে ই-সেবা নিশ্চিত করাসহ স্পেস টেকনোলজির জ্ঞান সমৃদ্ধ মর্যাদাশীল জাতি গঠনেও অনবদ্য ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। বর্তমানে বিদেশী স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ প্রতিবছর প্রায় ১৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে হচ্ছে। নিজস্ব স্যাটেলাইট স্থাপন হলে এই টাকা সাশ্রয় হয়েও আর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তারানা হালিম শনিবার দুপুরে গাজীপুর মহানগরীর তেলিপাড়া এলাকায় বিটিসিএলের টেলিযোগাযোগ স্টাফ কলেজ ক্যাম্পাসসংলগ্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ প্রকল্পের গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণের চ্যালেঞ্জিং কাজগুলো শেষ হয়ে গেছে। আমরা আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটি মহাকাশে উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হব। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণ প্রকল্পের ব্যয় সব মিলিয়ে ধরা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। এর জীবনকাল ১৫ বছর। এটি পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হচ্ছে। কোম্পানি পরিচালনার জন্য ১১ সদস্যের একটি বোর্ড থাকবে। এ বোর্ডই কোম্পানি পরিচালনা করবে। এ স্যাটেলাইট ব্যবহারের জন্য এর কভারেজ এলাকাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর কভারেজ এলাকা ইন্দোনেশিয়ার ১৮ হাজার দ্বীপে এ স্যাটেলাইট থেকে সংযোগ নেয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের তিন বছর পর থেকে আমরা নিজেরাই এটি পরিচালনা করতে পারব। এর মধ্যে আমাদের দক্ষ জনবল তৈরি হয়ে যাবে। এটি পরিচালনার জন্য কোম্পানিতে ১০৫ জন লোকের প্রয়োজন হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ৩০ জনকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ১৮ জনকে প্রশিক্ষণ নিতে ফ্রান্সের থ্যালেস এলেনিয়া স্পেসে পাঠানো হবে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ফ্রান্সের ঘায়েনা দ্বীপ থেকে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হবে। এটি মহাকাশে স্থাপনের লক্ষ্যে বিটিআরসি কর্তৃক চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে ৪৫ বছরের জন্য ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অরবিটাল স্লট লিজ গ্রহণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণের লক্ষ্যে স্যাটেলাইট প্রস্তুত উৎক্ষেপণ ও গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের জন্য বিটিআরসি ফ্রান্সের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থ্যালস এলেনিয়া স্পেসের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সে মোতাবেক ওই প্রতিষ্ঠানের সহকারী ঠিকাদার স্পেক্ট্রা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ওই প্রকল্পের নির্মাণকাজ করছে। গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডার ক্যাপাসিটির মধ্যে বাংলাদেশ নিজেরা ২০টি ব্যবহার করবে। বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার ইজারা দিতে পারবে বাংলাদেশ। বর্তমানে আমরা অন্যদের স্যাটেলাইট ভাড়ায় ব্যবহার করছি। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে স্থাপন করা হলে আমাদের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ সাশ্রয় হবে। দেশের সব মানুষকে যোগাযোগ ও সম্প্রচার সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা নিশ্চিত হবে। স্যাটেলাইটের বর্ধিত ফ্রিকোয়েন্সি ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রাও উপার্জন করা যাবে। আর টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হবে। পরিদর্শনকালে অন্যদের মধ্যেÑ প্রকল্প পরিচালক মেসবাহুজ্জামান, প্রকল্পের বৈদেশিক পরামর্শক শফিক আহমেদ চৌধুরী, স্পেক্ট্রা ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খালিদ হোসেন খান, পরিচালক নাজমুল হাসান, চীফ কো-অর্ডিনেটর মাহবুব মোরশেদ, প্রধান প্রকৌশলী মাসুদুর রহমানসহ উর্ধতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
×