ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১৮ হাজার রোগীপ্রতি একটি সেন্টার ॥ সপ্তাহে দু’বার ডায়ালাইসিস করাতে পারেন

কিডনি বিকল রোগীদের নিয়ে ডায়ালাইসিস ব্যবসা জমজমাট

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১৬ জুলাই ২০১৭

কিডনি বিকল রোগীদের নিয়ে ডায়ালাইসিস ব্যবসা জমজমাট

নিখিল মানখিন ॥ কিডনি বিকল রোগীদের নিয়ে বেশ কিছুসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী নিম্নমানের ডায়ালাইসিস ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ব্যাপকসংখ্যক কিডনি রোগীর তুলনায় ডায়ালাইসিস সেন্টার খুবই কম, মাত্র ৯৬ এবং ১৮ হাজার রোগী এসব সেন্টারে সপ্তাহে দুবার করে ডায়ালাইসিস করাতে পারেন। বেসরকারী সেন্টারগুলোতে সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ডায়ালাইসিস মূল্য রাখা হয়। একজন রোগীকে সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে ছয় থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। সাউথ এশিয়াতে মোট কিডনি রোগীর তুলনায় মাত্র ১৫ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিসের সুযোগ পায়। বাকি বিপুলসংখ্যক রোগী অর্থাভাবে ডায়ালাইসিস নিতে পারে না। এ সুযোগে কিডনি বিকল রোগীদের কাছ থেকে নানা কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। মফস্বল থেকে আসা রোগীরাই এমন ফাঁদে বেশি পড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে মঞ্জুরুল হাসানের। ডায়ালাইসিস দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। দুটি ডায়ালাইসিস ও ওষুধের পেছনে প্রতি সপ্তাহে খরচ হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা। জরুরী ভিত্তিতে কিডনি প্রতিস্থাপন করানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু রোগীর পরিবারের পক্ষে এ ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরিবারটির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। মঞ্জুরুলের বাবা আব্দুল হাকিম হাওলাদার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন। মা, তিন ছোট ভাই-বোন, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে মঞ্জুরুল হাসানের সংসার। চিকিৎসার খরচ মেটানোর পেছনে ইতোমধ্যে সহায়-সম্বল ফুরিয়ে গেছে। অসহায় হয়ে পড়েছে মঞ্জুরুল হাসানের পরিবার। টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার জলছত্র গ্রামের ৩০ বছর বয়সী হাসান মিয়ার দুটি কিডনি অকেজো হয়ে গেছে। কিডনি প্রতিস্থাপন করাতে তাগিদ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু কিডনিদাতা পাওয়া যাচ্ছে না। তার বড় ভাই হেলাল মিয়া জনকণ্ঠকে জানান, সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে ছয় লাখ টাকা যোগাড় করেছি। কিন্তু কিডনিদাতা পাওয়া যাচ্ছে না। সরাসরি রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে কিডনি গ্রহণ নিষিদ্ধ বলে জানিয়ে দিয়েছেন দেশের চিকিৎসকরা। রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়র কারও কিডনির সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব দেশে অবাধ কিডনিদাতার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, সেই সব দেশে যেতে হলে আরও টাকা লাগবে। এভাবে চিকিৎসার নানা জটিলতায় পড়ে তার ভাই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানান মোঃ হেলাল মিয়া। টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে সিরাজগঞ্জের রবিউলের চিকিৎসা। তার দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। জরুরী ভিত্তিতে কিডনি প্রতিস্থাপন করানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু রোগীর পরিবারের পক্ষে এ ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। রবিউলের বাড়ি সিরাজগঞ্জ শহরের ধানবাড়ি মহল্লার জিএম হিলালী রোডে। তিনি সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বিভাগের অস্থায়ী পিয়ন হিসেবে চাকরি করেন। পরিবারটির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। বর্তমানে টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রবিউল ও সেলিনা পারভিনের সংসারে রয়েছে তিন সন্তান। চিকিৎসার পেছনে সহায়-সম্বল ফুরিয়ে গেছে। এভাবে কিডনি বিকল হলেই রোগীর মৃত্যু যেন ঠেকানো যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে কিডনি রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। আর কিডনি বিকল রোগীর জন্য কিডনিদাতার সঙ্কটও প্রকট হয়ে উঠেছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ মোট রোগীর শতকরা মাত্র দুই ভাগ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। অন্যরা নিজেদের মতো চেষ্টা করে রোগী নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়। বাকিরা ডায়ালাইসিস দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে থাকে। টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে ব্যয়বহুল চিকিৎসা, উন্নত চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের জটিলতার কারণে শত শত কিডনি বিকল রোগী অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ এমএ সামাদ বলেন, বিশ্বব্যাপী কিডনি রোগের হার অত্যন্ত ব্যাপক। বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি লোক কোন না কোন কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি বিকলের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সাধারণত এ দেশের শতকরা ১০ ভাগ রোগী এ চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে না। অর্থাভাবে অকালে প্রাণ হারায় বেশিরভাগ রোগী। পক্ষান্তরে, একটু সচেতন হলে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগের উপস্থিতি ও এর কারণ শনাক্ত করে তার চিকিৎসা করা। কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ হারুন অর রশিদ বলেন, দেশে ব্যাপকসংখ্যক কিডনি রোগীর তুলনায় ডায়ালাইসিস সেন্টার খুবই কম, মাত্র ৯৬ এবং ১৮ হাজার হাজার রোগী এসব সেন্টারে সপ্তাহে দুবার করে ডায়ালাইসিস পায়। বেসরকারী সেন্টারগুলোতে সাড়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ডায়ালাইসিস মূল্য রাখা হয়। তিনি বলেন, সাইথ এশিয়াতে মোট কিডনি রোগীর তুলনায় মাত্র ১৫ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিসের সুযোগ পায়। বাকি বিশালসংখ্যক রোগী অর্থাভাবে ডায়ালাইসিস নিতে পারে না। তাই বাংলাদেশে ডায়ালাইসিস খরচ কমাতে সরকারী-বেসরকারীভাবে বাস্তবিক উদ্যোগ নিতে হবে। কিডনিদাতার সঙ্কট দেশে কিডনি বিকল রোগীদের জন্য কিডনিদাতার সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠেছে। টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি রয়েছে কিডনি সার্জনের সঙ্কট। আইনী জটিলতাসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কারণে কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রমে অংশ নিতে চান না সার্জনরা। প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হওয়ার পরও কিডনি গ্রহণকারীকে আজীবন প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার ওষুধসহ নিয়মিত ফলোআপ অব্যাহত রাখতে হয়। এভাবে ব্যয়বহুল চিকিৎসা, উন্নত চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনের জটিলতার কারণে শত শত কিডনি বিকল রোগী স্বাভাবিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিডনিদাতা ও গ্রহীতার ওষুধের মূল্যহ্রাস এবং মস্তিষ্কের মৃত্যুর (ব্রেন ডেথ) পর তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসুস্থ ব্যক্তির দেহে সংযোজন করার সুযোগ রেখে আইন তৈরির ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অনুষ্ঠানে কিডনিদাতা ও গ্রহীতারা নিজেদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। উপস্থিত কিডনিদাতাদের একজন হলেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার মিনারা বেগম (২৮)। তিনি তার ছেলে আশরাফুল আলমকে (২৮) কিডনি দান করেন। মিনারা বেগম জনকণ্ঠকে জানান, ২০১৪ সালে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিসেস এ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ কামরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে তার ছেলের কিডনি প্রতিস্থাপন করানো হয়। প্রতিস্থাপন এবং তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী চিকিৎসা বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ টাকা। মিনারা বেগম জানান, তার শারীরিক অবস্থা আগের মতো নেই। ভারি কাজ করতে পারেন না। তবে এখন পর্যন্ত বড় কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। ছেলের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে তিনি বলেন, ছেলে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। তার শারীরিক অবস্থাও ভাল। কিন্তু প্রতি মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকার ওষুধ খেতে হয়। আমার মতো গরিব মানুষের পক্ষে তা বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কিন্তু ছেলেকে এ চিকিৎসা আজীবন চালিয়ে যেতে হবে। ফলোআপের ঘাটতি পড়লেই দেখা দেবে শারীরিক সমস্যা। আরেকজন কিডনিদাতা হলেন পাবনার ভাঙ্গুরা থানার নাসিমা খাতুন (৪০)। তিনি তার ছেলে রুহুল আমিনকে কিডনি দিয়েছেন। কিডনি প্রতিস্থাপনে খরচ হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। ছেলেকে ফলোআপ করাতে মাসে প্রায় ১২ হাজার টাকা খরচ হয়, যা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এভাবে প্রতিস্থাপন করানোর পরও কিডনি গ্রহণকারীকে আজীবন প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার ওষুধসহ নিয়মিত ফলোআপ অব্যাহত রাখতে হয়।
×