ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাজেট নেই, তাই বরাদ্দও মিলছে না

মহাদুর্যোগের পর ৩ পার্বত্য জেলার অবস্থা দুর্বিষহ

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ৯ জুলাই ২০১৭

মহাদুর্যোগের পর ৩ পার্বত্য জেলার অবস্থা দুর্বিষহ

মোয়াজ্জেমুল হক/মোহাম্মদ আলী ॥ বাজেট নেই। তাই বরাদ্দও নেই। মোটা অঙ্কের অর্থের বিশেষ বরাদ্দের বিষয়টি এখনও চিন্তা ভাবনার আবর্তে। ফলে পাহাড়ে মহাদুর্যোগ পরবর্তী অবস্থা দুঃসহ। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের চেষ্টা তাই থমকে আছে। গত ১৩ জুনের মহাদুর্যোগের পর পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলায় একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত রাঙ্গামাটি সদরসহ ১০টি উপজেলা। খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে পাহাড় ধসেছে। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে প্রাণহানির সংখ্যা কম। কিন্তু এককভাবে রাঙ্গামাটিতেই প্রাণহানি, ভূমিধস ও ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক। পাহাড়ে একযোগে ভারি বর্ষণে অতি ধসের ঘটনার পর প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির কথা জানানো হলেও প্রকৃত হিসাব এখনও মেলেনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় চেয়ে আছে সরকারের প্রতি। অথচ সরকারী বাজেটে কোন টাকা নেই। বিশেষ বাজেট বরাদ্দের বিষয় নিয়েও সঙ্কট রয়েছে। পাহাড়ের ইতিহাসে এত বড় দুর্যোগের ঘটনা নজিরবিহীন। ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে দুই লক্ষাধিক মানুষ এখন কর্মহীন। অর্থনৈতিক কর্মকা-ে বড় ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। পণ্য আনা নেয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা চলমান। ফলে একদিকে পণ্যের প্রয়োজনীয় চাহিদা যেমন মিটছে না, তেমনি পাহাড়ে উৎপাদিত পণ্যাদিও সেখান থেকে বাইরে প্রেরণ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়ের সবকটি পাদদেশ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষিত হওয়ায় সেখানকার ক্ষতিগ্রস্তরা নতুন করে বসতি গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায়ও থমকে আছে। টানা ২৪ দিনের বর্ষণ পরিস্থিতির অবসান ঘটার পর ক্ষতিগ্রস্তদের পাশাপাশি অক্ষত রয়েছেন এমন সব মানুষও ভিন্ন ধরনের দুর্যোগের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেননা, সেখানকার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে যে কর্মকা-ে লিপ্ত ছিলেন সবই অস্বাভাবিক অবস্থায় চলে গেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বা ক্ষতিগ্রস্ত হননি এমন জনমানুষ দুর্বিষহ সময় অতিক্রম করছেন। অনেকের ঘর নেই, বাড়ি নেই, বসতভিটার চিহ্নও নেই। কারও ঘরবাড়ি পাহাড় ধসের মাটি চাপায় চলে গেছে। স্বজন হারিয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা এলাকা পরিদর্শন করেছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারী যে বরাদ্দ মিলেছে তা নুন আন্তে পান্তা ফুরায়েছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবির নিয়ন্ত্রণে যেসব আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছিল সেগুলোতে দু’বেলার স্থলে এখন একবেলা রান্না করা খাবার পরিবেশন হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোও আশ্রয় কেন্দ্রে থাকছেন না। একটি অংশ একবেলা খাবারের জন্য সুযোগ নিচ্ছেন। অনেকে আবার যাওয়ার পথও পরিহার করেছেন। দুর্যোগের পর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পাহাড়গুলো রক্ষার ক্ষেত্রে অর্থের অভাবে কার্যকর ব্যবস্থা লক্ষণীয় নয়। যেসব স্থানে পাহাড়ী ধসে সড়ক ও বিধ্বস্ত হয়েছে সেগুলো কোন রকমে সচল করার ক্ষেত্রে সেনা ও সড়ক বিভাগের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এরপরও রাঙ্গামাটির সঙ্গে খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান এবং বান্দরবানের সঙ্গে কয়েকটি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ এখনও সচল করা যায়নি। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত যে তালিকা করেছে তা নিয়েও নানা সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অনেকের তালিকা এখানে স্থান না পাওয়ার দাবি উঠেছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে গলদঘর্ম অবস্থা। এ পর্যন্ত যেটুকু সুফল এসেছে তাতে সেনাবাহিনীর দ্রুত তৎপরতা বড় ধরনের সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। অন্যথায় দুর্যোগ পরবর্তী সময়ের অবস্থায় আরও ভয়াবহ পরিণতি দেখা যেত। মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্রে জানানো হয়েছে, পাহাড়ের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে এমনিতেই সঙ্কট প্রকট। তার ওপর উটকো ঝামেলা এসেছে ১৩ জুন একযোগে একই সময়ে পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলায় ভারি বর্ষণে ভূমিধস, অবিরাম ঢলে বাড়িঘর ও সহায় সম্পদ এবং জানমালের ক্ষতির বিষয়টি। এককভাবে মন্ত্রণালয় সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। একেকটি বিষয় একেক মন্ত্রণালয়ের অধীন। এক্ষেত্রে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ও বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি রয়েছে। কেননা, এ দুর্যোগে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম রয়েছে। পার্বত্য অঞ্চল উন্নয়ন বোর্ডেরও বিশেষ অর্থ বরাদ্দে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে সৃষ্ট দুর্যোগে রাতারাতি ক্ষতি কাটিয়ে উঠার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ অসম্ভব একটি ব্যাপার। পাহাড়ের তিন জেলায় উপজেলার সংখ্যা ২৬। এগুলো কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এর মধ্যে ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়েছে পুরো রাঙ্গামাটি জেলা। সদর এলাকার যে অবস্থা দৃশ্যমান সেক্ষেত্রে দূরবর্তী গহীন এলাকার জনপদের অবস্থা পর্যবেক্ষণে অবহেলার শিকার হয়ে আছে। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে কর্মতৎপরতা চালানোও অসম্ভব একটি বিষয়। ফলে প্রকৃত অর্থে পাহারে এ দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় নেবে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। রাঙ্গামাটিতে প্রাকৃতিক মহাবির্পযয়ের ২৫ দিন প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি সড়কে মাত্র ৭ কিঃমিঃ সড়ক চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। বর্ষণ না থাকায় শুক্রবার এই সড়কের খামারপাড়া এলাকায় সড়কের ওপর ধসে পড়া বড় পাহাড়ের মাটি সরানো সম্ভব হয়েছে। রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগ ২টি বোল্ডড্রোজার ও একটি চেইন ড্রোজার দিয়ে সড়কের ওপর থেকে দেড় কিলোমিটার মাটি সরানো হয়েছে বলে দায়িত্বরত উপসহকারী প্রকৌশলী আবু মুছা জানিয়েছেন। শনিবার থেকে কেচিং এলাকায় ধসে যাওয়া ৭০ সড়কে মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। এখানে একটি পাইপ কালভাট করা হবে বলে সড়ক বিভাগ সূত্রে জানানো হয়েছে। এটি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সমাপ্ত হলে রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি সড়ক চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে বলে সূত্র জানায়। নানিয়াচর বগাছড়ি সড়কও খুলে দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ঘাগড়া-বরইছড়ি সড়ক ভারি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। রাজস্থলী বাঙ্গাল হালিয়া ও বান্দরবান সড়কে এখনও পাহাড় ধসের মাটি পুরোপুরি সরানো যায়নি। ফলে এ সড়কে এখনও ভারি যান চলাচল উপযোগী হয়নি। আবহাওয়া পরিস্থিতি ভাল থাকলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে এসব সড়কে পুনঃসংযোগ স্থাপিত হবে বলে সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ এমদাদ হোসেন জানিয়েছেন। রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের সাপছড়ি বেইলি ব্রিজের কাজও পুরোদমে চলছে। বৃষ্টি না হওয়ায় এটির পাইপ বসানোর কাজ দ্রুত এগিয়ে গেছে। প্রাকৃতিক মহাবির্পযয়ের ২৫ দিন পর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি মহাদুর্যোগে তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষয়ক্ষতির একটি প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেছে। তালিকা অনুসারে দেখা যায়, তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড় ধসে ১৩১ জন লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। এদের মধ্যে শুধু রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় রয়েছে ১২১ জন। তার মধ্যে ৬১ পাহাড়ী ও ৬০ জন বাঙালী রয়েছে। আহতের সংখ্যা ৩৩৭ জন। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৫ হাজার। রাস্তাঘাট ও ফসলী বাগানের ক্ষতি ব্যাপক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অপরদিকে মন্ত্রণালয় বা সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান এখনও অপ্রকাশিত রয়েছে। এমনকি বেসরকারী সংস্থা বা এনজিওগুলোর পক্ষ থেকেও এ নিয়ে কোন পরিসংখ্যান তৈরি হয়নি। এর মূল কারণ জেলা সদর ছাড়া অন্য দশ উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির সংখ্যা নিরূপণ অপেক্ষাকৃত কঠিন হওয়ায় এ বিষয়টি দ্রুত এগুচ্ছে না।
×