ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল নিয়ে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদে ক্ষোভ

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৯ জুলাই ২০১৭

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল নিয়ে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদে ক্ষোভ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল নিয়ে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে মত দেয়ায় সাবেক গণপরিষদ সদস্য প্রবীণ আইনজীবী ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং আওয়ামী ফোরামের নেতাদের তীব্র সমালোচনা করা হয়। আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, যারা বাহাত্তরের সংবিধান প্রণেতা দাবিদার তারাই বারবার সংবিধানকে কলুষিত করেছে। যারা বারবার সংবিধানকে নিজের সন্তান হিসেবে দাবি করেছেন তারাই বারবার অসৎ উদ্দেশে নিজের সন্তানকে হত্যা করেছেন। আসলে তারা বাহাত্তরের সংবিধান নয়, তারা চায় জিয়াউর রহমানের মার্শাল ল’ গণতন্ত্র। কারণ এতে তাদের সম্মান ও সুযোগ বাড়ে। শনিবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ নেতারা এসব কথা বলেন বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কেবলমাত্র পাকিস্তানে এবং আমাদের দেশে রয়েছে। সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর জিয়াউর রহমান অন্যায়ভাবে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন। ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ছিলেন গণপরিষদ সদস্য। তারাই সংবিধান তৈরির সময় ছিলেন। এখন কিভাবে তারা সুপ্রীম জুডিশিয়ালের পক্ষে কথা বলেন? তারা কী চান? বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর সূচনা বক্তব্যের পর দলের উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া শোক প্রস্তাব পাঠ করেন। এতে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খান, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, আবদুল মতিন খসর, এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, নজিবুল্লাহ হিরুসহ অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা এ সময় বক্তব্য রাখেন। এরপর সাংগঠনিক সম্পাদকরা তাদের রিপোর্ট পেশ করেন। এরপর শুরু হয় ষোড়শ সংবিধান বাতিল রায় নিয়ে। দলের দু-একজন সিনিয়র সদস্য এ নিয়ে বক্তব্য দেন। সে সময় পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে না পাওয়া পর্যন্ত আলোচনা করা ঠিক হবে না-এমন বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন সাবেক আইনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু। মতিন খসরু আইনের ব্যাখা দিতে চাইলে তাকে থামিয়ে দিয়ে এক প্রবীণ সদস্য বলেন, আপনারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। দলের জন্য কাজ করেন না। এ সময় আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আশিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ আমলেই জঙ্গীরা জামিনে মুক্ত হচ্ছে। এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কোন আইনজীবীর মাধ্যমে তারা জামিন নিচ্ছেন? খোঁজখবর নিতে হবে। এ সময় খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, আমি যখন প্রতিমন্ত্রী ছিলাম, তখন এমন হয়নি। তাকে থামিয়ে দিয়ে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আপনাদের সবার আমলই আমাদের দেখা আছে। আপনারা শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। দলের জন্য কিছু করেন না। এ সময় আরও কয়েকজন সদস্য সুপ্রীমকোর্টের রায় নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তাদের থামিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এ নিয়ে আমরা সংসদে চূড়ান্ত আলোচনা করব। তবে এ কথাটি বলা যায়, আমরা কখনই বিচারপতিদের অসম্মান করিনি। খালেদা জিয়া তার পছন্দের ব্যক্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বানাতে গিয়ে বয়স বাড়িয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানায়, আগামী বছর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের জন্য প্রার্থীদের প্রস্তুতির নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা। বৈঠকে উপস্থিত রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র বদরুউদ্দিন আহমেদ কামরানকে নিজ এলাকায় জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা। সূত্রগুলো জানায়, আগামী নির্বাচনে জয়লাভের জন্য জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে হবে। জনগণের কাছে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, বাড়ি বাড়ি যেতে হবে, উঠোন বৈঠক করতে হবে। এছাড়া আর কোন পথ নাই। শুধু বড় বড় মিছিল, মিটিং করলেই কাজ হয় না। এ করে ভোট বাড়ানো যাবে না। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আগামী নির্বাচন অবহেলা করার সুযোগ নেই। প্রচার-প্রচারণার জন্য যত ধরনের কৌশল তা গ্রহণ করতে হবে। সংসদ উত্তপ্ত হতে পারে সংসদ রিপোর্টার জানান, টানা ৯ দিন বিরতির পর আজ রবিবার ফের বসছে জাতীয় সংসদ অধিবেশন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেয়া রায় সুপ্রীমকোর্ট বহাল রাখা নিয়ে বাইরে চুপচাপ থাকলেও সংসদ অধিবেশনে এ নিয়ে উত্তাপ ছড়াতে পারে। দু’একদিনের মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে অধিবেশনে তুমুল বিতর্ক হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। আজ বিকেল ৫টায় স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদের মুলতবি বৈঠক শুরু হবে। আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলতে পারে দীর্ঘতম এই বাজেট অধিবেশন। কার্যসূচীতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাসসহ কয়েকটি ইস্যুতে সংসদে আলোচনা হতে পারে। বিশেষ করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ইস্যুতে উত্তপ্ত আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সর্বোচ্চ আদালতের রায় নিয়ে মন্তব্য করতে গেলে তা আদালত অবমাননার পর্যায়ে পড়বে। ফলে তাদের আইনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হতে পারে। কিন্তু সংসদে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে সংসদ সদস্যদের আদালত অবমাননার দায় এড়ানোর সুযোগ থাকবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সার্বভৌম সংসদের সদস্য হিসেবে সংসদের সদস্যরাও সার্বভৌম। ফলে সংসদের কোন কিছু নিয়ে কথা হলে তা আদালত অবমাননার মধ্যে পড়বে না। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল নিয়ে বাইরে কথা বলে অহেতুক বিতর্কে না জাড়িয়ে বরং সংসদে কথা বলার প্রস্তুতি নিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, সংসদ ও সংসদ সদস্যদের সার্বভৌম বিষয়ে সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে (১) সংসদের কার্যধারার বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না, (৩) সংসদে বা সংসদের কোন কমিটিতে কোন কিছু বলা বা ভোটদানের জন্য কোন সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন আদালতে কার্যধারা গ্রহণ করা যাবে না। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকার ও বিরোধী দলের একাধিক সংসদ সদস্য জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আদালত কি করছে না করছে, তা আদালতের ব্যাপার। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে সংসদ থেকে। সংসদে যেহেতু সংশোধনীটি পাস হয়েছে, সেহেতু এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার তাদেরই, সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত আসবে। আর বাহাত্তরের সংবিধানে এই বিধানটি ছিল, সেটাকে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনর্বহাল করা হয়েছে। কাজেই সর্বোচ্চ আদালতের রায়টি মূল সংবিধানের স্পিরিটের পরিপন্থী। সংসদে আমরা এ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করব।
×