ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঝুঁকির এ যাত্রায় কেউ সাগরে ডুবে মরছে, কেউ ধুঁকে মরছে ভিন দেশের জেলে

শক্তিশালী দালাল চক্র জড়িত ॥ লিবিয়ার পর ইউরোপে মানবপাচারের নতুন রুট ইরাক

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৩ জুলাই ২০১৭

শক্তিশালী দালাল চক্র জড়িত ॥ লিবিয়ার পর ইউরোপে মানবপাচারের নতুন রুট ইরাক

ফিরোজ মান্না ॥ লিবিয়ার পর এবার ইউরোপে মানবপাচারের নতুন রুট ইরাক। বাংলাদেশ থেকে তরুণরা লিবিয়া ও ইরাক হয়ে ঝঁকিপূর্ণ সাগর পথে ইউরোপ পাড়ি দিচ্ছে। বাংলাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দালাল মিলে একটি বড় চক্রের হাত ধরে তারা জীবনবাজি রাখছেন। গত ৬ মাসে লিবিয়াতে তিন শ’র বেশি বাংলাদেশীকে পাচার করা হয়েছে ইউরোপে নেয়ার জন্য। লিবিয়ার পথ কিছুটা কঠিন হওয়ায় এখন তারা ইরাকের পথে মানবপাচার করছে। দুটি রুট দিয়ে সাগর পথে এসব তরুণদের পাচার করতে গিয়ে অনেকের সাগর সমাধি ঘটছে। আবার অনেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষের হাতে আটক হয়েছে। ভাল চাকরি তাদের ভাগ্যে জোটেনি। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সত্ত্বেও ইউরোপে যাওয়া বন্ধ হয়নি। বরং দালাল চক্র নতুন নতুন রুট খুঁজে বের করছে। বড় অংকের টাকা নিয়ে ইউরোপগামী তরুণদের মহা বিপদের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে দেশী-বিদেশী দালাল চক্র। তারা হয় সাগরে ডুবে মরছে, না হয় স্থান পাচ্ছে কারাগারে। সূত্র জানায়, ইরাকের ভিসা সহজ হওয়ায় দালাল চক্র বাংলাদেশ থেকে তাদের ইরাকে নিয়ে আসছে। ইরাক থেকে সাগর পথে তাদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাচার করে যাচ্ছে। বেশির ভাগ তরুণই ঝুঁকিপূর্ণ পথে ইউরোপ যেতে পারেননি। তাদের অনেককে সাগরে ডুবে মরতে হয়েছে, না হয় তারা বিভিন্ন দেশের কারাগারে স্থান পেয়েছেন। ভাল চাকরি তাদের কপালে জোটেনি। দালাল চক্র ইরাকে প্রবেশ করার কয়েক দিনের মধ্যে সাগরপথে ইউরোপের সুবিধাজনক দেশে পাঠায়। ইউরোপে পৌঁছে দেয়ার জন্য বাংলাদেশের অনেক দালাল বিমান ভাড়া নিয়ে বাকিতে ইরাক থেকে ইউরোপে পাঠাচ্ছে। ইরাক থেকে দালালরা প্রথমে বাংলাদেশীদের তুরস্কে ঢোকানোর চেষ্টা করে। এ যাত্রায় সফল হলে ইউরোপে ঢোকাতে দালালদের কম কষ্ট করতে হয়। তবে তুরস্কে ঢোকাতে না পারলে সিরিয়ার অরক্ষিত বর্ডার দিয়ে সাগরের কাছাকাছি নিয়ে যায়। এরপর সুবিধাজনক সময়ে ইউরোপের যে কোন দেশে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। ভুক্তভোগী বাংলাদেশীরা জানান, এয়ার এরাবিয়ার মতো এয়ারলাইন্স দিয়ে মানবপাচারের অপকর্ম বেশি চলে। এই এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে শারজা থেকে কাতার যায় বাংলাদেশী তরুণরা। এরপর কাতার থেকে ইরাকে পাড়ি জমায়। এছাড়া ফ্লাই দুবাই নামে আরেকটি এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশীরা ইরাকে আসছে। এ দুই এয়ারলাইন্স দিয়ে মানবপাচারের ঘটনা ঘটছে বেশি। জানা গেছে, ইউরোপে পাড়ি জমানোর পর টাকা দিতে হবে এমন শর্তে নিরীহ যুবকদের ফাঁদে ফেলছে দালালচক্র। ইউরোপে বসবাসরত বেশিরভাগ বাংলাদেশী অভিবাসী তুরস্ক, সিরিয়া বা লিবিয়া হয়ে গিয়েছে। এখন নতুন করে ইরাক হয়ে গ্রীস, ইতালি বা ইউরোপের অন্য দেশে আসছেন। নৌকায় করে ইউরোপে পাড়ি জমানো অনেক কষ্টকর। দিনের পর দিন নৌকায় কাটাতে হয়। মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে। দালালচক্রের খপ্পরে পড়ে ইউরোপে আসার পর নানা ঝামেলায় পড়েন বাংলাদেশীরা। প্রথম সমস্যা ভাষা জানেন না তারা। ফলে ইচ্ছা থাকলেও কয়েক মাস কাজ পান না। নৌকায় করে ইউরোপে আসা বেশিরভাগ বাংলাদেশী অশিক্ষিত হওয়ায় ভাষা শিখতে তাদের অনেক সময় লাগে। নৌকায় করে আসা বাংলাদেশীদের মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে। মানবপাচার রোধে দেশে কঠোর আইন থাকলেও পাচারকারীরা আইনের ভয় পাচ্ছে না। দালালদের খপ্পরে পড়ে বিপজ্জনক পথে পাচার হতে গিয়ে অনেক মারা পড়ছেন। আবার অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হয়ে বহু মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে আটক রয়েছেন। বর্তমানে মালয়েশিয়ার চেয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে মানবপাচারের ঘটনা বেশি ঘটছে। মালয়েশিয়াতেও ট্রলারযোগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখন অনেক মানুষ পাচার হচ্ছেন। পাচারকারী চক্রের খপ্পর থেকে প্রতিনিয়ত অনেক নিরহ মানুষ পুলিশের হাতে আটক হয়। কিন্তু পাচারকারী কাউকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে না। অভিযোগ উঠেছে পাচারকারীদের সঙ্গে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বিভাগের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে। এ কারণেই পাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মানবপাচার বন্ধের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কয়েক দফা চিঠি দিলেও কোন কাজ হচ্ছে না। মানবপাচার ও অভিবাসন নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকটি সংগঠন বলেছে, বেশিরভাগ মানবপাচার হয় মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে। এক শ্রেণীর দালালের মাধমে তারা বেশি বেতনের চাকরির লোভে বিদেশ যাচ্ছে। এতে বৈধ শ্রমবাজারের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। এখানে থেকে উত্তরণ না ঘটাতে পারলে দেশের বহু মানুষ নিঃস্ব সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বে। সরকার মানবপাচার প্রতিরোধ আইন করলেও তার প্রয়োগ হচ্ছে না বলেই চলে। ‘ন্যাশনাল লেভেল শেয়ারিং ফর এডাপশন অব কমপ্রিহেনসিভ ল’ এগেইনস্ট ট্রাফিকিং ও রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) জানিয়েছে, অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে না পারলে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার হারাতে হতে পারে। সমুদ্রপথে টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়ায় অনিয়মিত অভিবাসন দেশের সার্বিক অভিবাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভারত ও পাকিস্তানে বেশিরভাগ পাচার হচ্ছে নারী। এদের জীবন সবচেয়ে দুর্বিষহ। পাচারকারীরা সংশ্লিষ্ট দেশের দালালদের কাছে তাদের বিক্রি করে দেয়। দালালদের হাতে পড়ার পর তাদের জায়গা হয় যৌনপল্লীতে। অথবা অন্য কোন স্থানে আটকে রেখে তাদের ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। এখন শুরু হয়েছে লিবিয়াতে পাচার। লোভ দেখানো হচ্ছেÑ লিবিয়া থেকে সাগর পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চাকরির। লোভে পড়ে মানুষ দালালদের ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা তুলে দিয়ে অনিশ্চিত জীবনে চলে যাচ্ছে। কেউ হয় তো লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। তবে বেশিরভাগেরই ঠাঁই হয় বিভিন্ন দেশের জেলখানায়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, মানবপাচার উদ্বেগজনক হারে রাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে বহু মানুষের জীবনহানি ঘটবে। সমাজে একটা ভীতিকর পরিস্থিতির জন্ম নেবে। এখন থেকে বের হতেই হবে। তা না হলে জনশক্তির বাজারও হারাতে হবে। প্রতিবছর পাচার হওয়া নারী-পুরুষের প্রকৃত সংখ্যা কত তা সরকারী-বেসরকারী কোন সংস্থার কাছে নেই। সরকারী-বেসরকারী সংস্থাগুলো সংবাদ মাধ্যম থেকে যে সংখ্যা পাওয়া যায় তারই হিসাব রাখা হয়। এর বাইরে আর কোন কাজ হচ্ছে না। দেশে লোকসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে এ বিষয় নিয়ে সরকা রর খুব একটা মাথাব্যথা নেই। বেসরকারী সংস্থাগুলো মাঝে মধ্যে মানবপাচার প্রতিরোধ নিয়ে বছরে দু’চারটি সেমিনার করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করছে। পাচার হওয়া পরিবারের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছে না। এভাবেই বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ পাচার হয়ে যাচ্ছে।
×