ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

* কূটনীতিক এলাকায় বিদেশীদের নিñিদ্র নিরাপত্তা বলয় তৈরি হয়েছে ;###;* বিদেশী কূটনীতিকসহ অন্যদের নিরাপত্তার জন্য দেয়া ছয় দাবিই পূরণ

বিদেশী চাপ নেই ॥ হলি আর্টিজানের ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে সরকার

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১ জুলাই ২০১৭

বিদেশী চাপ নেই ॥ হলি আর্টিজানের ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে সরকার

তৌহিদুর রহমান ॥ রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গী হামলার ঘটনায় বিদেশী কূটনীতিক ও নাগরিকের নিরাপত্তায় বিদেশী চাপ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে সরকার। এছাড়া ঘটনার শুরুতে বিদেশীদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিলেও একাধিক উদ্যোগ নেয়ায় তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে সরকার। বিশেষ করে কূটনেতিক এলাকায় নিñিদ্র নিরাপত্তা বলয় তৈরি ও বিদেশীদের দেয়া সকল সুপারিশ বাস্তবায়নও করা হয়েছে। এছাড়া নিহতদের মধ্যে ইতালি ও জাপানী নাগরিক বেশি হলেও দেশ দুটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের কোন টানাপোড়েনও তৈরি হয়নি। গত বছর পহেলা জুলাই রাজধানীর গুলশানে কূটনৈতিক এলাকায় হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন বিদেশী কূটনীতিক ও নাগরিকরা। তখনকার ঘটনার পরেই আতঙ্কিত হয়ে বেশ কয়েক বিদেশী নাগরিক ঢাকাও ত্যাগ করেছিলেন। ঢাকার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মান দূতাবাস নিজ নিজ নাগরিকদের বিশেষ সতর্ক থাকতেও নির্দেশ দিয়েছিল। এসব মিলিয়ে বিদেশীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতে সরকার প্রবল চাপের মুখে পড়ে। তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতে একের পর এক উদ্যোগ নেয়ায় সেই চাপ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে সরকার। দেশে বিভিন্ন সময়ে জঙ্গী হামলা হলেও কূটনৈতিক জোনের নিরাপত্তাবলয় ভেদ করে কোন বেকারিতে বিদেশীদের জিম্মি করে হত্যার ঘটনা বাংলাদেশে এটাই ছিল প্রথম। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী ও জঙ্গীদের উত্থানের পর দেশে দেশে এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও জঙ্গী হামলা ঘটে। এই হামলার মধ্য দিয়ে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হলেও সেটা হয়নি। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কোন দেশে অবস্থান করা কূটনীতিক ও বিদেশী নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব স্ব স্ব দেশের। সে হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থান করা বিদেশীদের দায়িত্বও সরকারের। রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পরে বিদেশীদের নিরাপত্তায় বিশেষ ভূমিকা নেয় বাংলাদেশ। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বিদেশীদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপও নেয়া হয়। বিশেষ করে কূটনৈতিক জোনে নিñিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সরকার। এছাড়া গোয়েন্দা তৎপরতাও অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বাড়ানো হয়। নিরাপত্তার জন্য গঠন করা হয় একটি টাস্কফোর্স। বিদেশী কূটনীতিকরা তাদের নিরাপত্তা বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের কাছে ছয়টি সুপারিশ করেছিল। এসব সুপারিশের মধ্যে ছিল কূটনৈতিক জোনে নিরাপত্তা নিশ্চিত, বিদেশী ক্লাবে নিরাপত্তা প্রদান, বিদেশী প্রতিষ্ঠানের অফিসে নিরাপত্তা বৃদ্ধি, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অফিসে নিরাপত্তা নিশ্চিত, বিমানবন্দরে চেক আউট ও চেক ইনের সময় বিদেশীদের নিরাপত্তা প্রদান ও ঢাকার বাইরে থাকা সকল বিদেশীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এসব সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন করে সরকার। জঙ্গী হামলাকে এখন বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্বের যে কোন দেশেই জঙ্গী হামলা হতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে। দুই বছরে ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, তুরস্ক, তিউনিসিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ভারত প্রভৃতি দেশেও জঙ্গী হামলা ঘটেছে। ফ্রান্সে একাধিকবার জঙ্গী হামলার ঘটনায় তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও সমালোচনা হয়। রাজধানীর গুলশানে জঙ্গী হামলার পরে বেশ কয়েকটি মিশনের কর্মকর্তারা ছুটি নিয়ে বাংলাদেশের বাইরে যান। তারা আর ঢাকায় ফিরবেন কি-না সেটা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তাও দেখা দেয়। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিবারের সদস্যদের স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ ত্যাগ করারও অনুমতি দেয়া হয়। এছাড়া সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয় ব্রিটিশ কাউন্সিল। তবে এসব মিশন ও সংস্থা আবারও পুরোপুরি স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। এদিকে হলি আর্টিজান হামলায় নিহত ১৭ বিদেশী নাগরিকের মধ্যে ৯ জন ইতালির নাগরিক। আর ৭ ছিলেন জাপানী। এই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের গভীর কূটনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান। তবে এই ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন সৃষ্টি হবে কিনা তা নিয়ে আশঙ্কা ছিল। বিশেষ করে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে জাপানের বিপুল সহায়তা রয়েছে। আবার জাপানী কারিগরি বিশেষজ্ঞরাও এসব প্রকল্পে কাজ করছেন। গুলশান ঘটনার পর বাংলাদেশে জাপানী সহায়তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও এমন অপপ্রচার করা হয়। অপরদিকে ইতালিতে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক প্রবাসী নাগরিক রয়েছেন। এর ফলে সেদেশের বাংলাদেশী প্রবাসীদের ওপর কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা সেটা নিয়েও আশঙ্কা ছিল। তবে সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে জাপান ও ইতালির সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও কোন টানাপোড়েন হয়নি। দেশ দুটির সঙ্গে সমানতালে সম্পর্ক ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে সরকার। গত বছর ৬ আগস্ট জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকার প্রেসিডেন্ট শিনিচি কিতাওকার ঢাকা সফরের কথা ছিল। তবে গুলশান হামলার ঘটনায় জাইকার প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর স্থগিত হয়ে যায়। এ নিয়ে ঢাকা-টোকিওর মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়। তবে চলতি বছর ২৫ মে ঢাকা সফর করেন জাইকার প্রেসিডেন্ট শিনিচি কিতাওকা। তিনি ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেন। জাইকা প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপান কখনও সহযোগিতা বন্ধ করবে না। বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজ করছে এবং জাইকা তাদের সহযোগিতা বন্ধ করবে না বলেও জানান তিনি। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় নিহত ৭ জাপানী ঢাকায় জাইকার একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছিলেন। ওই হামলার পর বাংলাদেশে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তাতে জাইকার প্রেসিডেন্ট সন্তোষ প্রকাশ করেন। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করতে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগেরও প্রশংসা করেন জাইকার প্রেসিডেন্ট। রাজধানীর গুলশানে জঙ্গী হামলার প্রেক্ষিতে দেশের কোন ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়নি বলে জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তার অভিমত, জঙ্গী হামলা এখন বৈশ্বিক সমস্যা। সে কারণে একক কোন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার কোন সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, গত বছর পহেলা জুলাই রাতে গুলশান দুই নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় একদল অস্ত্রধারী জঙ্গী। দেশী-বিদেশী অন্তত ৩৩ জন সেখানে জিম্মি হন। হামলাকারীদের ঠেকাতে গিয়ে বোমায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পরে কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ওই বেকারির নিয়ন্ত্রণ নেয় সশস্ত্রবাহিনী। ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার করা হলেও ২০ জনের লাশ পাওয়া যায় জবাই করা অবস্থায়। ২০ জনের মধ্যে ১৭ জন ছিলেন বিদেশী নাগরিক। এর মধ্যে ৯ জন ইতালির, ৭ জন জাপানী ও একজন ছিলেন ভারতীয়। আর বাকি তিনজন ছিলেন বাংলাদেশী। এই তিনজনের মধ্যে আবার একজনের মার্কিন নাগরিকত্ব ছিল।
×