ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

এসব নিয়ে শিক্ষা প্রশাসনে অসন্তোষ বাড়ছে

প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণের হিড়িক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে

প্রকাশিত: ০৮:১৩, ১৯ জুন ২০১৭

প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণের হিড়িক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণের হিড়িক পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ তার অধীন দফতরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। অথচ নামে ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণ’ হলেও সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষকদের অংশগ্রহণ থাকছে নামমাত্র। শিক্ষা খাতে একাধিক প্রকল্প চলমান থাকায় কোন না কোন প্রকল্প থেকে প্রতি মাসেই প্রশিক্ষণের নামে আয়োজন করা হচ্ছে বিদেশ সফরের। বিদেশ থেকে ফিরে শিক্ষক ও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা অধিকাংশই প্রতিবেদন দিলেও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তার প্রয়োজন মনে করছেন না। বরং অনেকেই শিক্ষা ক্যাডার বা যে কোন শিক্ষককে তার প্রশিক্ষক থেকে বঞ্চিত করে নিজেরাই সেখানে চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ এক সফর শেষে দেশে নেমেই আবার চলে যাচ্ছেন অন্য দেশে। এসব ঘটনায় অসন্তোষ বাড়ছে শিক্ষা প্রশাসনে। এদিকে প্রশিক্ষণের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও একদিকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষকরা অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে এই প্রশিক্ষণের কোন প্রতিফলনও দেখা যায় না। জানা গেছে, মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে কাজ করা একাধিক প্রকল্প থেকে আয়োজন করা হয় প্রশিক্ষণের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা প্রায় প্রতিবারের প্রশিক্ষণেই থাকেন। সবচেয়ে বেশি প্রশিক্ষণের আয়োজন করে টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট (টিকিউআই)-২ এবং সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ)। বিশ্ব ব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার ঋণে পরিচালিত এসব প্রকল্পের প্রশিক্ষণে কর্মকর্তাদের জন্য রাখা হয় বড় অংকের সম্মানীও। প্রতিটি প্রশিক্ষণ শিক্ষা কর্মকর্তাদের ও শিক্ষকদের জন্য আয়োজন করা হলেও সেখানে রাখা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের। ফলে এই প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ কোন প্রশ্নই তুলতে পারে না বলে বলছেন শিক্ষকরা। মাউশির কর্মকর্তারাও সাহস পান না মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রশ্ন তুলতে। ‘টিচার এ্যাক্রিডিটেশন’ বিষয়ক দুই মাসের এক প্রশিক্ষণে নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিলেন ১৪ জন। অথচ সেখানে তাদের মধ্যে একজন শিক্ষকও ছিলেন না। এই টিমে ছিলেন এনটিআরসিএ’র দু’জন কর্মকর্তা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তিন কর্মকর্তা। যাদের চারজনই শিক্ষকের বাইরের কর্মকর্তা এমনকি তারা শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাও নন। এছাড়া মাউশি অধিদফতরের একজন সিনিয়র কম্পিউটার অপারেটরও ছিলেন এই টিমে। তিনি কিভাবে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করবেন? তার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকরা। এছাড়া রয়েছে এনসিটিবি, মাউশি অধিদফতরসহ বিভিন্ন প্রকল্প ও দফতরের কর্মকর্তারা। যদিও বিভিন্ন দফতরের ৯ জন কর্মকর্তা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য। তারা শিক্ষক হলেও বর্তমানে শিক্ষা প্রশাসনে চাকরি করছেন। শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য একটি কলেজের অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও বিভাগীয় প্রধানরা মূল ভূমিকা পালন করলেও তাদের কাউকেও এই টিমে রাখা হয়নি। টিকিআই-২ এর অধীনে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর এক প্রতিক্ষণে ১৩ জন কর্মকর্তা ফিলিপিন্সে গিয়েছিলেন। এর কিছুদিন আগে একই বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে ১৯ কর্মকর্তা অস্ট্রেলিয়ায় যান। একই বিষয়ের প্রশিক্ষণ হলেও একই ব্যক্তিরাও পরপর দু’বার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। অথচ যারা সুযোগ পায়নি তাদের কোন প্রশিক্ষণেই পাঠানো হচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়ার প্রশিক্ষণটি মূলত মাউশি অধিদফতরের কর্মকর্তাদের জন্য হলেও সেখানে ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দু’জন অতিরিক্ত সচিব, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন যুগ্ম সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব, বাস্তবায়ন মনিটরিং ও মূল্যায়ন বিভাগের মহাপরিচালক, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। এছাড়া বাকি ১১ জনের মধ্যে ছিলেন মাউশি অধিদফতরের সাত ও অন্যান্য দফতরের চার কর্মকর্তা। ফিলিপিন্স থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে আসা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের যারা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তারা ছিলেন মূলত স্কুল প্রধান। কিন্তু আমাদের দলে স্কুল প্রধান ছিলেন না বললেই চলে। তাই প্রশিক্ষকরাও আমাদের অনেকের পরিচয় পাওয়ার পর কিছুটা বিব্রত ছিলেন। পরিচয়ের পর্বেই যদি ঝামেলা বাধে তাহলে বাকি প্রশিক্ষণ কেমন হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছুদিন আগে বিদেশে স্কুল শিক্ষকদের এক প্রশিক্ষক কর্মসূচীতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে দেশে চলে এসেছিলেন মন্ত্রণালয়ের দাপুটে কর্মকর্তা। টিকিআই-২ এর অধ্যায়নে নিউজিল্যান্ডে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন ১৬ জন কর্মকর্তা। বিদেশে ‘সাপোর্ট টু টুইনিং পার্টনারশিপ মেকানিজমস’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ শেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নে তাদের অবদান রাখার কথা। মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নের এই প্রশিক্ষণে অংশ নেয়া ১৬ জনের মধ্যে আটজন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, ছয়জন সরকারী কলেজের শিক্ষক এবং একজন মাত্র সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। প্রশিক্ষণের পরিচয় পর্বে আটজনই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা থাকায় তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করেন নিউজিল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে বাধ্য হয়ে ওই আটজন নিউজিল্যান্ডে ঘুরেফিরে বেড়িয়েছেন বাকিরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে তার পরে কিছুদিন প্রশিক্ষণের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর নজরদারি বৃদ্ধির কারণে সকলে শতর্ক ছিলেন। তবে ধীরে ধীরে আবার শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ শুরু হয়। তবে মাউশি অধিদফতরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলছিলেন, যেসব প্রকল্প থেকে বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয় তাদের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায়ই (ডিপিপি) থাকে শিক্ষা, পরিকল্পনা, অর্থসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি। এছাড়া মাউশি অধিদফতর থেকে কয়জন যাবেন, কয়জন কলেজ থেকে যাবেন সেটাও ডিপিপিতে উল্লেখ করা থাকে। তাই এখানে আমাদের কিছু করার নেই। বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) ফিলিপিন্স ও অস্ট্রেলিয়া থেকে সম্প্রতি স্টাডি ট্যুর করে ফিরেছেন কর্মকর্তারা। ছয়জনের দলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে রাখা হয়। ১৩তম নিবন্ধনের মৌখিক পরীক্ষা চলাকালীন হঠাৎ করে কেন তাদের এই স্টাডি ট্যুরের প্রয়োজন পড়ল তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন শিক্ষকরা। শিক্ষকরা এ নিয়ে আন্দোলনেরও ঘোষণা দেন। এনটিআরসিএ’র নিজস্ব টাকায়ই এই ট্যুরের আয়োজন করা হয়েছিল পরীক্ষা চলার সময়েই। শিক্ষকরা ইতোমধ্যেই অভিযোগ তুলেছেন, প্রতিবছর শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় লাখ লাখ শিক্ষার্থী অংশ নেয়। এতে এনটিআরসিএ’র কোটি কোটি টাকা আয় হয়। এত টাকা খরচ করার কোন খাত নেই তাদের। ফলে গরিব পরীক্ষার্থীদের টাকার যথেচ্ছ ব্যবহার করতেই তারা শিক্ষা সফর বা ট্রেনিংয়ের নামে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। গত মার্চ মাসে জাপানে ২০ শিক্ষার্থী যান স্টাডি ট্যুরে। অথচ সেখানে রাখা হয় চার সুপারভাইজার। এই চারজনের মধ্যে দু’জন সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ, একজন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও একজন মাউশি অধিদফতরের কর্মকর্তা। অনার্স-মাস্টার্সে পড়ুয়া এসব শিক্ষার্থীর সঙ্গে কেন দু’জন কর্মকর্তার যাওয়ার প্রয়োজন পড়ল সেই উত্তর নেই কারো কাছে। অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও দফতর-অধিদফতর থেকে বিদেশে প্রশিক্ষণে গেলে সেই প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ করতে হয়। এমনকি প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে দফতরের অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিয়ে কর্মশালা করতে হয়। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করতে হয়। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও তার অধীন কর্মকর্তাদের সেই ধরনের কোন ব্যবস্থা দেখা যায় না। যেসব দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের দেশের কোন সঙ্গতিই নেই সেখানেও ভ্রমণের উদ্দেশ্যেই যাওয়া নিয়ে আছে নানা বিস্তর অভিযোগ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. আফছারুল আমীন সম্প্রতি এসব বিষয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলছিলেন, যারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর বা প্রকল্পের প্রশাসনিক কর্মকর্তা তারা শিক্ষকদের বা শিক্ষার প্রশিক্ষণ নিয়ে কী করবে? তারা আজ এক ধরনের কাজ করবেন তো কাল অন্য ধরনের। এমনকি বিভিন্ন দফতরেও বদলি হয়ে যাবেন। শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ পেলেই শিক্ষার উন্নতি হবে। যাদের প্রশিক্ষণ নিয়ে ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই তাদের যাতে সুযোগ দেয়া না হয় সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আরও সচেতন হতে হবে।
×