ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডেপুটি কনসাল জেনারেল গ্রেফতার বিষয়ে বাংলাদেশ- ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন

গৃহকর্মীরা গ্রীন কার্ডের আশায় কূটনীতিকদের ফাঁসিয়ে দিচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১৫ জুন ২০১৭

গৃহকর্মীরা গ্রীন কার্ডের আশায় কূটনীতিকদের ফাঁসিয়ে দিচ্ছে

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের আশায় কূটনীতিকদের ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন তাদের গৃহকর্মীরা। দুই বছরের ব্যবধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুইজন বাংলাদেশী কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে তাদের গৃহকর্মীরা দেনা-পাওনা নিয়ে আদালতে অভিযোগ করেছেন। এসব অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই বলেই জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। এদিকে গ্রেফতার হওয়া নিউইয়র্কে বাংলাদেশের ডেপুটি কনসাল জেনারেল শাহেদুল ইসলাম জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। এছাড়া কূটনীতিককে গ্রেফতারের ঘটনাটি কনস্যুলার সম্পর্ক বিষয়ক ১৯৬৩ সালের ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে বাংলাদেশ। সূত্র জানায়, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের ডেপুটি কনসাল জেনারেল শাহেদুল ইসলামের বাসায় মোহাম্মদ আমিন নামে এক গৃহকর্মী কাজ করতেন। মোহাম্মাদ আমিনকে শাহেদুল ইসলাম নিজেই বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যান সেখানে। নিউইয়র্কে তার কুইন্সের বাসায় মোহাম্মাদ আমিন ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মে পর্যন্ত কাজ করেছেন। তবে চার বছর সেখানে কাজ করার পর বিনা মজুরিতে জোরপূর্বক কাজ করানোর ঘটনায় শ্রম পাচার ও নির্যাতনের অভিযোগ এনে গত বছর মে মাসে পুলিশের কাছে গিয়ে ঘটনার বিবরণ দিয়ে মামলা করেন আমিন। এক বছর আগের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হয়ে যান শাহেদুল। এর আগে ২০১৪ সালে ঠিক একইভাবে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মনিরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী ফাহিমা তাহসিনার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। সেই মামলা এখনও চলছে। তাদের গৃহকর্মী মাসুদ পারভেজ রানা অভিযোগ করেছিলেন, মাসে তিন হাজার ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ২ লাখ ৩৩ হাজার টাকা বেতন ও ভাল কাজের প্রলোভন দেখিয়ে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান বাংলাদেশী ওই দম্পতি। কিন্তু বাস্তবে ওই পরিমাণ বেতন দেয়া হয়নি। বরং তাকে প্রতিনিয়ত নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। বিনা বেতনে তাকে আমানুষিক পরিশ্রম করানো হতো। এসব অভিযোগ করে ম্যানহাটন ফেডারেল আদালতে সে সময় গৃহকর্মী মাসুদ পারভেজ রানা ওই মামলাটি দায়ের করেন। সেসব অভিযোগ ছিল ভিত্তিহীন। ওই মামলা দায়েরের পর গৃহকর্মী মাসুদ পারভেজ রানা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রীন কার্ড পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পেয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে নিযুক্ত ভারতের ডেপুটি কনসাল জেনারেল দেবযানী খোবরেগাড়ের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ এনেছিলেন তার গৃহকর্মী। গৃহকর্মীর অভিযোগে দেবযানীকেও গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে এ নিয়ে ওয়াশিংটন-দিল্লীর মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনেরও সৃষ্টি হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেসব কূটনীতিক তাদের গৃহকর্মী হিসেবে যাদের নিয়ে যাচ্ছেন, তারাই পরে কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে উল্টো অভিযোগ করছেন। আর তাদের অভিযোগের কোন সত্যতা নেই। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ নেয়ার জন্য তারা আদালতে গিয়ে মিথ্যা অভিযোগ করছেন। আর এর ফলে ফেঁসে যাচ্ছেন কূটনীতিকরা। সূত্র জানায়, গৃহকর্মীকে নির্যাতন, শ্রমিক পাচার এবং মজুরি চাওয়ায় হত্যার হুমকির অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার ৩৬ ঘণ্টা পর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন ডেপুটি কনসাল জেনারেল শাহেদুল ইসলাম। নিউইয়র্ক পুলিশ স্থানীয় সময় সোমবার সকালে শাহেদুলকে নিজ বাসা থেকে গ্রেফতারের কয়েক ঘণ্টা পর কুইন্স সুপ্রীমকোর্টে হাজির করলে বিচারক ড্যানিয়েল লুইস ৫০ হাজার ডলারের বন্ড বা নগদ ২৫ হাজার ডলারে তার জামিন ঠিক করে দিয়েছিলেন। এরপর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি জামিনে মুক্ত হন বলে জানিয়েছেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামীম আহসান। বিচারকের ঠিক করে দেয়া ৫০ হাজার ডলার বন্ডে তাকে মুক্ত করা হয়। এর আগে কুইন্স ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রিচার্ড ব্রাউন বলেছিলেন, কূটনৈতিক কর্মকর্তা হলেও সম্পূর্ণ কূটনৈতিক দায়মুক্তির অধিকারী না হওয়ায় গ্রেফতার এড়াতে পারেননি শাহেদুল ইসলাম। আদালতে বিচারক ড্যানিয়েল লুইস জামিন ঠিক করে দিলে শাহেদুলের পাসপোর্ট জব্দ করার নির্দেশ দেন। তবে ডেপুটি কনসাল জেনারেল শাহেদুলকে গ্রেফতারের আগে তাকে ন্যূনতম কূটনীতিক সুবিধা দেয়া হয়নি বলে প্রবাসীদের একটি পক্ষ বলছে, গ্রেফতারের মতো চরম পদক্ষেপ নেয়ার আগে তাকে নোটিস দেয়া যেত, যা সচরাচর অন্য দেশের কূটনীতিকদের ক্ষেত্রে করা হয়। গৃহকর্মী নির্যাতনের এ অভিযোগকে শাহেদুলের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ বলে দাবি করেছেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামীম আহসান। তিনি বলেছেন, গৃহকর্মী নির্যাতিত শ্রমিক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের অভিপ্রায়ে এমন প্লট তৈরি করেছেন। সময়ের ব্যবধানে তা প্রমাণিত হবে। এদিকে নিউইয়র্কে বাংলাদেশী কূটনীতিককে গ্রেফতারের ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কূটনীতিককে গ্রেফতারের ঘটনাটি কনস্যুলার সম্পর্ক বিষয়ক ১৯৬৩ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের পরিষ্কার লঙ্ঘন। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্যা এ্যাফেয়ার্সের কাছে এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এছাড়া ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসও বিষয়টি নিয়ে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বলে জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের মে মাসে ওই কূটনীতিকের বাড়ি থেকে যখন গৃহকর্মী নিখোঁজ হয়, তখনই বিষয়টি স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু গত ১৩ মাসে বিষয়টি নিয়ে এই কূটনীতিককে গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত কোন ধরনের অগ্রগতি জানানো হয়নি বাংলাদেশকে। ১২ জুন গৃহকর্মীকে নির্যাতনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি কনসাল জেনারেল শাহেদুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। ঠাকুরগাঁওয়ে নানান আলোচনা নিজস্ব সংবাদদাতা ঠাকুরগাঁও থেকে জানান, নির্যাতন এবং প্রাপ্য মজুরি না দেয়ার অভিযোগে নিউইয়র্কের বাংলাদেশ মিশনের ডেপুটি কনসাল জেনারেল শাহেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী গৃহকর্মী মোঃ আমিন ২০১২ সালে নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন। এর আগে মোঃ শাহেদের বাবা ঠাকুরগাঁও-১ আসনের সাবেক এমপি, জেলা আ’লীগের সাবেক সভাপতি খাদেমুল ইসলামের গৃহকর্মী ছিলেন আমিন। থাকতেন এমপি হোস্টেলে। দীর্ঘদিন গৃহকর্মীর কাজ করার সুবাদে শাহেদুল ইসলামের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে আমিনের। এমপি খাদেমুল ইসলামের মৃত্যুর পর মোঃ শাহেদ রাজনৈতিক বিবেচনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। এরপরই আমিনকে বাসায় কাজ করার জন্য সেখানে নিয়ে যান। নিউইয়র্কে থাকাকালে আমিন ঠাকুরগাঁওয়ের কিশোরবাড়ী গ্রামে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। ঠাকুরগাঁও শহরে ৮ শতক জমি কিনেছেন ২৪ লাখ টাকায়। গত কয়েক দিন আগে আমিন তার মা ও ছেলেকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গেছেন। স্ত্রীর সঙ্গে আমিনের যোগাযোগ নেই বলে জানিয়েছেন তার স্বজনরা। রুহুল আমিনের ১০ বছরের ছেলে কিশোরবাড়ী গ্রামে দাদির সঙ্গে থাকত। আমিনের দুই ভাই ঠাকুরগাঁও শহরেই থাকেন। তবে শাহেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে আমিনের আনা অভিযোগের বিষয়ে তারা কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন। আমিনের ভাই ওবায়দুর রহমান বলেন, আমার ভাই শাহেদুল ইসলামের সঙ্গে থাকে এটা জানি। এজন্য সে ক্ষমতার বড়াই করে। তাই আমি তার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখি না। তবে সম্প্রতি আমার মা ও মোঃ আমিনের ছেলেকে আমেরিকা পাঠানোর জন্য বললে আমি দূতাবাসের মাধ্যমে তাদের যেখানে যাওয়ার সব কার্যক্রম সম্পন্ন করে পাঠিয়ে দিই। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহেদুল ইসলামের স্বজনরা জানিয়েছেন, আমিন দীর্ঘদিন থেকে তাদের পরিবারের সঙ্গে ছিলেন। তিনি তাদের বিশ্বস্ত। কিন্তু কোন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে শাহেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। শাহেদুল ইসলামের ভাই ডাঃ মহিদুল ইসলাম বলেন, আমার ভাইয়ের ইমেজ নষ্ট করার জন্য আমিন কোন ষড়যন্ত্রে পা দিতে পারে। আমার ভাই নির্দোষ।
×