ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কারাগার রতনের কাছে ডাল-ভাত, ৩৬ বছরে ১০৩ বার!

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১৪ জুন ২০১৭

কারাগার রতনের কাছে ডাল-ভাত, ৩৬ বছরে ১০৩ বার!

মশিউর রহমান খান ॥ কারাগার আবার এমন কি জিনিস? ওখানে যাওয়া তো আমার কাছে ডাল-ভাত। কতবার আসলাম গেলাম তার কোন হিসাবই নেই। আর থানা পুলিশের সঙ্গে তো আমার নিয়মিতই দেখা সাক্ষাত হয়। তাদের কাজই তো আমি করি। তবে কারাগারে এসেছি শতবারের বেশি ছাড়া কম নয়। মূলত প্রবেশের পর কারাগারের অফিসারদের কথা শুনে ইচ্ছে হয় এসব ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি কিন্তু কারাগার থেকে বের হওয়ার পর নানা পরিস্থিতির কারণে পারি না। কারাগার, থানা পুলিশ এসব আর ভাল লাগে না। মনে হয় না কেউ আমাকে এই পথ থেকে ফেরাতে সহায়তা করবেন। তবে আমি ভাল হতে চাই। এমন সব কথাই অন্য বন্দী ও কারারক্ষীদের কাছে সবসময় বলে বেড়ান রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক বন্দী মোঃ রতন। রাজশাহী মেট্রোপলিটন এলাকার রাজপাড়া থানার ডিঙ্গাডোবা এলাকার বাসিন্দা তিনি। অকল্পনীয় হলেও সত্য শুধুমাত্র মাদক সেবন, মাদক বিক্রি ও পরিবহনের কারণেই তার ৩৬ বছর জীবনে ১০৩ বার কারাগারে যেতে হয়েছে মোঃ রতনকে। সবার কাছেই তিনি বলে বেড়ান নিয়মিত কারাগারে যাওয়ার কথা। তবে এর বাইরে শুধুমাত্র নেশা গ্রহণ ও বিক্রির সময় অসংখ্যবার গ্রেফতার হলেও থানা পুলিশ ও র‌্যাবের নিম্নস্তরের লোকদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক থাকার কারণে থানা থেকেই সে বিভিন্ন জনের সুপারিশে বেরিয়ে গেছেন বলে তার স্ত্রী শাকিলার দাবি। রতন পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী, সেবনকারী, পিকেটার ও নিয়মিত নানা জনের সঙ্গে ঝগড়া ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী ব্যক্তি হিসেবেই ডিঙ্গাডোবা এলাকায় অধিক পরিচিত। পরিবারের ভাষ্যমতে, সে পুলিশ ও র‌্যাবের সোর্স বা দালালও। কারাগার নাম শুনলে অনেকের কাছে ভয়াবহ ভয় আর আতঙ্কের মনে হলেও রতনের কাছে কারাগার একরকম আড্ডার স্থান। কারণ কারাগারে গিয়ে পুরনো সকল অপরাধী বন্ধুদের কাছে দেখা স্বাক্ষাতের সুযোগ হয়। কারাগারে বারবার যাওয়ার কারণে ও নেশার টাকা যোগাড় করতে তার বাবার রেখে যাওয়া রাজশাহী শহরের ১৪ কাঠা জমির পুরোটা বিক্রি করে দিয়েছেন বলে তার স্ত্রী শাকিলা জানান। ১৯৯৬ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকেই তার কারাগারে আসা শুরু। আমার জানা মতে, বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের কারা ইতিহাসে এতোসংখ্যক বার কোন আসামি কারাগারে আসেনি বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার হালিমা খাতুন। তবে এর বাইরেও বেশ কিছু আসামি রয়েছেন যারা নিয়মিতই কারাগারে আসেন। তবে রতনের কিছুদিন পরপর কারাগারে আসার খবর সকল কারা কর্মকর্তা কর্মচারীসহ পুরনো সকল কারাবন্দীই জানেন। এ আর নতুন কিছু নয়। তবে শতাধিকবার কারাগারে আসা বিভিন্ন মামলার মধ্যে বেশ কয়েকটি পিকেটিং ও মারামারির মামলা রয়েছে। কারাবন্দী রতনের এলাকায় অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দীর্ঘ ১৯ মাস একটানা প্রেম করার পর অবশেষে বাড়ি থেকে ১৯৯৮ সালের ২৫ জানুয়াার পালিয়ে বিয়ে করেন রতন ও তার স্ত্রী শাকিলা। উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের মতো করে সুখের সংসার সাজাবে। শুধুমাত্র মাদকের ছোবল আর বিভিন্ন মামলার কারণে কিছুদিনের মধ্যেই ফিকে হয়ে যেতে শুরু করল তাদের ভালবাসার আদলে গড়ে তোলা সংসার পরিকল্পনার রঙ্গিন স্বপ্ন। বর্তমানে একসঙ্গে জীবন যাপন করলেও সংসারের কাজে স্বামীকে মাসের খুবই কম সময় পাশে পান স্ত্রী শাকিলা। কারণ থানা, পুলিশ, আদালত আর কারাগারই রতনের নিত্যসঙ্গী। বর্তমানে তাদের সংসারে দুই ছেলে। ১৭ বছর বয়সের অন্তর নামের বড় ছেলেটি আর্থিক সচ্ছলতা না থাকায় রাজশাহী শহরের সাফল্য কোচিং সেন্টারে পিয়নের কাজ করে। মাসে বেতন পায় ২৫ শত টাকা। ছোট ছেলে সোহান ২য় শ্রেণীতে পড়ছে। বর্তমানে মামাশ্বশুরের বাড়িতে বউ বাচ্চা আর শাশুড়ি নিয়ে বসবাস করছে। ভয়াবহ মাদকের ছোবলে আক্রান্ত রতনের অত্যাচারে তার বউ ছেলে আর জন্মদাত্রী মাও অতিষ্ঠ। মাদকের টাকা যোগাড় করতে না পেরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে করা সীমাহীন অত্যাচার আর তা-বে বাধ্য হয়ে অভিযোগ দিয়ে মাদকাসক্ত ছেলেকে পুলিশের কাছে তুলে দিয়েছেন তার মা এর সংখ্যাও কম নয়। এছাড়া সর্বশেষ ২৬ মে তাকে তার মায়ের স্থানীয় থানায় করা মামলায় পুলিশ ঘর থেকে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। এরপর থেকে ঐ মামলায়ই বর্তমানে তিনি কারাগারে আটক রয়েছেন। সর্বশেষ কারাগারে প্রবেশের পর তার স্ত্রী সন্তান এমনকি মাও ছেলেকে একবারের জন্যও দেখতে যায়নি। তিন বোনের একটি মাত্র ভাইয়ের সংসারে সুখের অভাব ছিল না। কিন্তু রতনের বিভিন্ন কারণে বিবাহিত সকল বোনেরাও স্বামীর ঘরে অনেক কথা আর নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রতনের স্ত্রী শাকিলা। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে, রাজশাহী শহরের রাজপাড়া থানার ডিঙ্গাডোবা এলাকার বাসিন্দা শুকতার ম-লের একমাত্র ছেলে মোঃ রতন। ছোট থেকেই উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হওয়ায় লেখাপড়া করতে পারেননি রতন। তাই তার বাবা বাধ্য হয়ে এলাকারই একটি মোড়ে পান সিগারেটের দোকান দেন। বন্ধু বান্ধবদের প্ররোচনায় পড়ে সিগারেট দিয়ে শুরু নেশা ধরেন। মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল, আফিম, প্যাথিডিন ইয়াবা কোন প্রকারের মাদক সেবন বাদ দেয়নি সে। সর্বশেষ নিয়মিত ইয়াবা ও হেরোইন সেবন করেন তিনি। ডিঙ্গাডোবা এলাকার বাসার কাছের এক মোড়ে একটি পান সিগারেটের দোকান দেন রতন। এই দোকান থেকেই তার মাদক গ্রহণের পাশাপাশি মাদক বিক্রিসহ পরিবহনের কাজ শুরু করেন তিনি। একদিন দোকানের ভেতরেই নেশা করা অবস্থায় পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। কিছুদিন পর থেকেই একের পর এক মামলায় কারাগারে আসতে থাকেন রতন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শতাধিকবার কারাগারে আসা উক্ত আসামি ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো তিন মাসের কারাদ-ে দ-িত হয়ে কারাগারে কয়েদি হিসেবে আসেন। এর আগে ও পরে অসংখ্যবার হাজতি আসামি হিসেবে আসলেও কয়েদি হিসেবে এটিই প্রথম তার কারাগারে আসা। হাজতি হিসেবে সর্বনি¤œ তিন দিন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ একমাস কারাগারে থাকেন। প্রতিবারই পরিবারসহ নিজস্ব লোকদের মাধ্যমে আদালত থেকে জামিনে বের হয়ে যান তিনি। তবে তাকে জামিনে সহযোগিতার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগানদাতা কে তা সে কাউকে বলতে রাজি হয় না। ঐ এলাকার সবাই তাকে বারবার জেলে যাওয়া রতন নামেই চেনেন। বাড়ি কোনদিকে জানতে চাওয়া মাত্রই স্থানীয় লোকজন বলতে থাকেন মাদক রতন ? সোজা গলিপথ দেখিয়ে দিলেন। মামা শশুরের বাড়িতে থাকেন তার স্ত্রী সন্তানসহ শাশুড়ি রাবেয়া খাতুন। জনকণ্ঠকে স্ত্রী শাকিলা বলেন, মনোযোগ না থাকায় লেখাপড়া করতে পারেননি আমার স্বামী। প্রায় ১০ বছর আগেই তার পিতার মৃত্যুর পর সত্তোর্ধ তার মা তাকে নেশা করতে অসংখ্যবার বারণ করলেও তা শুনতো না। কিছুদিন পরপরই কারাগারে আসা যাওয়া করার কারণে এই রাজশাহী কারাগারের প্রায় প্রতিটি দেয়াল ও লোহার বেষ্টনিই তার চেনা। শাকিলা জানান, তার স্বামী ব্যক্তিগতভাবে সে আওয়ামী লীগের সমর্থক। সে রাজপাড়া থানা আওয়ামী লীগের ২ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য। রাজশাহীর সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনও তার স্বামীর চেনাজানা আছে বলে জানান। আওয়ামী লীগের কর্মী হওয়ায় এক সময়ের প্রতিবাদী যুবক রতন খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে ৯৬ সালে দলের পক্ষে পিকেটিং করার অপরাধে তাকে প্রথম কারাগারে পাঠায় পুলিশ। রতন তার স্ত্রীকে বলেছেন যে রাজশাহী শহর বিএনপির নেতা সালাউদ্দীন বেবী লক্ষ্মীপুর মোড় থেকে তাকে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। এরপর থেকে আজীবন কারাগারেই আসা যাওয়া করতে হচ্ছে। স্বামীর বিষয়ে শাকিলা বলেন, আমরা চাই না সংশোধন হয়ে বা শিক্ষা না নিয়ে সে কারাগার থেকে বের হোক। তার অত্যাচারে পরিবারের ছেলে, আমি, আমার মা, আমার মামা মামিসহ আমার বৃদ্ধা শাশুড়িও অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। বাবার রেখে যাওয়া ১৪ কাঠা সম্পত্তি সে বিক্রি করে দিয়েছে নেশা করার জন্য আর কারাগারে মারামারিসহ বিভিন্ন মামলায় জামিন করার কাজে। এসব টাকা নেশা করা ও জেলে যাওয়ার পর ছাড়া পেতে খরচ করেছে। নেশা করলেই সে ভাল থাকে আর কোন কারণে নেশা করতে না পারলেই আমাদের সবার ওপর নেমে আসে অত্যাচারের খড়গ। জীবনে অসংখ্যবার তার হাতে আমি, আমার মা মানে তার শাশুড়ি, তার গর্ভধারিণী মাসহ আমার পরিবারের লোকজন মার খেয়েছি। এই জীবনে তার কারণে থানা পুলিশ, র‌্যাব আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের নিত্যসঙ্গী। থানা আর র‌্যাবের দালালি করে কিছু টাকা পেলেই পরিবারের লোকদের জন্য খাবার পোশাক ও নানা উপহার কিনে আনে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকলেও তাকে জেল থেকে বারবার বের করতে হয় বিধায় আমরা এখন পথের ফকির হয়ে গেছি। শাকিলা বলেন, কঠিন আর্থিক সঙ্কটে এমনও সময় গিয়েছে যে, একটানা ৪ থেকে ৫ দিন খাবার না খেয়ে থাকতে হয়েছে আমাদের। স্বামীর নেশা সম্পর্কে বলেন, একবেলা শুধু ভাত খায় রতন। আর সারাদিন সে শুধু চা খায় আর নেশা করেন। আগে বাইরে গেলেও এখন ঘরে বসেই অনেক সময় নেশা করে। র‌্যাব পুলিশ আর নানা বড় বড় লোকের সঙ্গে পরিচয় থাকায় কারাগারে গেলেও সে ছাড়া পেয়ে যায়। আমরাও অনেক সময় তাকে কারাগার থেকে ছাড়িয়ে এনেছি। মূলত কারাগারে যাওয়া তার কাছে কোন ব্যাপারই না। গেলেও যেহেতু ছাড়াই পেয়ে যায় তাই তার কোন চিন্তা নেই। কারাসূত্র জানায়, কারাগারের ভেতরে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে নেশা গ্রহণ করতে না পেরে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন রতন। এর অত্যাচারে সাধারণ হাজতি ও কয়েদি আসামিরা বিরক্ত। তবে এর কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে সে স্বাভাবিক হতে থাকে। ২৬ মে কারাগারে আসার পর থেকে কারাগারে কোন লোক তাকে দেখতে না আসায় রতন কারা কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাছে তাকে কারাগার থেকে বের করার জন্য নিয়মিত আবেদন জানাচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার হালিমা খাতুন জনকণ্ঠকে বলেন, রতন এই কারাগারে আসা যাওয়া বেশ কিছু আসামির মতো একজন নিয়মিত আসামি। তার কারাগারের আসামির পরিচিতি পত্রে (টিকেটে) মোট পিকেটিং, মারামারি, মাদক গ্রহণ, বিক্রিসহ ক্রিমিনাল রেকর্ড (সিআর)সহ বিভিন্ন মামলায় একশত তিন বার বিভিন্ন মামলায় কারাগারে এসেছে বলে উল্লেখ রয়েছে। কারাভ্যন্তরে বিভিন্ন বন্দী ও কারারক্ষীদের কাছে সে কারাগারে আসা যাওয়া কোন ব্যাপারই না বলে বেড়ান। অনেকের কাছে বলেন, কারাগারে আসা যাওয়া তার ডাল-ভাত। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন যাবত চাকরিরত কর্মচারীদের মতে, রাজশাহী কারাগারে আটক প্রায় কারাগারের পুরনো সকল বন্দীই তাকে ভাল করেই চেনেন। মূলত সে মাদকাসক্ত বন্দী। আমরা তাকে অসৎ পথ পরিহারের জন্য চেষ্টা করি কিন্তু সে শোনে না। সর্বশেষ ২৬ মে ৩ মামলায় সে কারাগারে আসে। তার মা-ই তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে বলে আসামি রতন আমাদের জানিয়েছেন। তবে সে এবার জামিনে বের হয়ে এই পেশা ছেড়ে ভাল হতে চান বলে জানিয়েছেন।
×