ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তামাকের আগ্রাসন (শেষ পর্ব)

স্তরভিত্তিক কর পদ্ধতি চালু থাকায় রাজস্ব ফাঁকি

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ৮ জুন ২০১৭

স্তরভিত্তিক কর পদ্ধতি চালু থাকায় রাজস্ব ফাঁকি

রহিম শেখ ॥ তামাক পণ্য বা সিগারেটে স্তরভিত্তিক কর পদ্ধতি চালু থাকার ফলে একদিকে কোম্পানিগুলো যেমন রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে অন্যদিকে সস্তা হচ্ছে তামাক পণ্য। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে যেসব দেশে সস্তায় সিগারেট পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। এমনকি ডিম, দুধ এবং চালের তুলনায় এখানে তামাক পণ্য সস্তা। তামাক পণ্য সস্তা হওয়ায় মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির বাড়ার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪০ সালের মধ্যে তামাক নির্মূলের বিষয়টি বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, সম্পূরক শুল্ক না বাড়িয়ে শুধু মূল্যস্তর ও ভিত্তিমূল্য সমন্বয় করার কারণেই সিগারেট-বিড়ির প্রকৃত মূল্য দিন দিন কমছে। প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাজেটে সিগারেটের সর্বনিম্ন স্তর ভেঙ্গে দেশী এবং আন্তর্জাতিক দুটি স্তরে বিভক্ত করে তামাক কর-কাঠামোর জটিলতা আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। সূত্র জানায়, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সিগারেটের ক্ষেত্রে ৪৮ থেকে ৬৩ শতাংশ, বিড়ির ক্ষেত্রে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এবং জর্দা ও গুলের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ সুনিদিষ্ট শুল্ক বিদ্যমান আছে। পাশাপাশি ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর এবং ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ রয়েছে। এর বাইরে কোম্পানিগুলোকে পুঁজি বাজারে তালিকাভুক্ত হলে ৪০ শতাংশ এবং তালিকাভুক্ত না হলে ৪৫ শতাংশ কর্পোরেট আয়কর দিতে হয়। দেখা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পক্ষ থেকে তামাক পণ্যে সর্বোচ্চ ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট শুল্ক (এসডি) আরোপের কথা বলা হলেও এ ঘোষণার মধ্যেই রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, আইনে বলা হয়েছে ৩০০ শতাংশ এসডি আরোপের কথা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সেখান থেকে বিশেষ প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলোকে ২৩৭ থেকে ২৭৫ শতাংশ পর্যন্ত দায়মুক্তি দিয়েছে। অর্থাৎ সিগারেটের ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে ২৩৭ থেকে ২৫২ শতাংশ পর্যন্ত। আর বিড়ির ক্ষেত্রে দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৭৫ শতাংশ। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই রেওয়াজ একটি নিয়মে দাঁড়িয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞার গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্যের ওপর বিদ্যমান কর কাঠামো জটিল। জটিল কর কাঠামোর কারণেই কর ফাঁকির পাশাপাশি তামাক পণ্য সস্তার মূল কারণ। আর কোম্পানিগুলো তামাকের কর না বাড়ানোর অপকৌশল হিসেবে এই জটিল কর কাঠামোকে ব্যবহার করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তামাক পণ্যের ওপর অধিকহারে কর বাড়ানোর বিকল্প কিছু নেই। তাছাড়া সিগারেটে করারোপের ক্ষেত্রে মূল্যস্তর তুলে দিতে হবে। এক ধাপের সিগারেটের দাম বাড়লে মানুষ অন্যটিতে যেতে পারে। এ জন্য যখন সব তামাক পণ্যের দাম বাড়বে তখন এর ব্যবহার কমে আসবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম যুবায়ের বলেন, প্রস্তবিত বাজেটে উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেট এবং ধোঁয়াবিহীন (গুল, জর্দা) তামাক পণ্যে কর না বাড়ানোর প্রস্তাব চরম জনস্বাস্থ্যবিরোধী। তিনি বলেন, তামাকবিরোধীদের দীর্ঘদিনের দাবি উপেক্ষা করে একক স্তরভিত্তিক কর কাঠামো প্রতিষ্ঠার কোন নির্দেশনা বাজেট ঘোষণায় প্রতিফলিত হয়নি। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি, চার স্তরবিশিষ্ট মূল্যস্তরে পরিবর্তে একটি মূল্যস্তর রাখার। এতে রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ থাকবে না, এক স্তরে বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে। তামাকের কর সংক্রান্ত এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, তামাক পণ্যের ওপর ৭০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ধার্য করা হলে এক বছরে বাংলাদেশে ১ হাজার ৩৬০ কোটি শলাকা সিগারেট ও বিড়ির ব্যবহার কমবে এবং তামাক খাত থেকে বাড়তি রাজস্ব অর্জিত হবে ২ হাজার ২২০ কোটি টাকা। কিন্তু এ ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়িত না হওয়ায় প্রতিবছর সিগারেট ও বিড়ির প্রকৃত মূল্য কমছে। প্রস্তাবিত বাজেটে দেশীয় উৎপাদনকারী কোম্পানির প্রস্তুত করা নিম্ন মূল্যস্তরের প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের মূল্য ২৩ টাকার স্থলে ২৭ টাকা এবং আন্তর্জাতিক কোম্পানির প্রস্তুত করা সিগারেটের মূল্য ৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশীয় কোম্পানির ক্ষেত্রে এই মূল্যবৃদ্ধি প্রায় ১৭.৪ শতাংশ এবং আন্তর্জাতিক কোম্পানির ক্ষেত্রে প্রায় ৫২.২ শতাংশ। তবে এডভ্যালোরেম পদ্ধতি বহাল থাকায় এই দুটি পণ্যের মূল্য যতটুকু বাড়বে তার সিংহভাগই যাবে তামাক কোম্পানিগুলোর পকেটে। প্রস্তাবিত বাজেটে সিগারেটের সর্বনিম্ন স্তর ভেঙ্গে দেশী এবং আন্তর্জাতিক দুটি স্তরে বিভক্ত করে তামাক কর-কাঠামোর জটিলতা আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। তামাকবিরোধীদের সুনির্দিষ্ট কর পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব গ্রহণ না করে করারোপের পুরনো ও জটিল এডভ্যালোরেম পদ্ধতিই বহাল রাখা হয়েছে। ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন’ শীর্ষক সাউথ এশিয়ান স্পিকারস সামিটের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তামাককে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নির্মূল অর্থাৎ ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। এ জন্য তামাকের ওপর বর্তমান শুল্ক-কাঠামো সহজ করে একটি শক্তিশালী তামাক শুল্কনীতি গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় অর্থমন্ত্রী তামাকে করারোপের ক্ষেত্রে বাজেটে মূল্যস্তরভিত্তিক কর প্রথা তুলে দিয়ে তামাকের কর ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটেও মূল্যস্তরভিত্তিক প্রথা বিদ্যমান।
×