ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পারসেপোলিস– অন্য এক রূপবানের কাহিনী

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ৫ জুন ২০১৭

পারসেপোলিস– অন্য এক রূপবানের কাহিনী

সম্প্রতি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে (মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান) ‘পারসেপোলিস’ নামে একটি বই সব ফ্রেসম্যান ছাত্রছাত্রীদের একটি কোর্সের জন্য পঠিতব্য বই হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে এবং তা ওয়েবসাইটে পোস্ট করা হয়েছে। নামের অর্থ জানতাম না, তবে হিজাব্রত ছোট্ট কার্টুনটি দেখে জানার আগ্রহ বেড়ে গেল। মারজেইন সতরূপী একজন ইরানী কার্টুনিস্ট-লেখিকা এবং পারসেপোলিস হলো তার আত্মজীবনীমূলক কমিক বই। কার্টুন দিয়ে একটি উপন্যাস, তাও বেশ নাম করেছে বলেই পাঠ্যবই হয়েছে। কি আজব এই ইন্টারনেট! এক ক্লিকেই সমস্থ খবর চলে আসে। বইটির ওপর পুরস্কারপ্রাপ্ত এনিমেটেড সিনেমা পর্যন্ত হয়েছে। বর্তমানে সতরূপী একজন বিশ্বখ্যাত নামী মহিলা। ভদ্রমহিলা একের পর এক কার্টুন উপন্যাস লিখে যাচ্ছেন। গত একটি লেখায় মানু প্রকাশের গল্পে বলেছিলাম, ছাত্রজীবনে সব কিছুতেই ‘ট্রাই আউট’ করা ভাল। কখন কি কাজে লাগবে আগের থেকে জানা যায় না। সতরূপী হয়ত ভাবেনি যে, তিনি একদিন কার্টুনের মাধ্যমেই খ্যাতি লাভ করবে। সতরূপী বিজ্ঞানী নয়, পড়াশোনার মাধ্যমে ক্যারিয়ার করেনি। নতুন কিছু আবিষ্কারও করেনি। শুধু ছোট্টবেলায় কার্টুন আঁকতে ভালবাসত। আর সেই কার্টুন আঁকাই তাকে পরবর্তীতে অর্থ ও খ্যাতি এনে দেয়। কিন্তু, কি-ই না হৃদয়বিদারক কাহিনী এই রূপবানের! তার পরিবারের। ইরানের জিলান প্রদেশের রাস্ট শহরে ১৯৬৯ সালে এক উচ্চ মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম সতরূপীর। মজার কথা, কয়েক জেনারেশন আগে তার প্র-প্রপিতামহ ১৮৪৮-১৮৯৬ সাল পর্যন্ত পারশিয়ান বাদশাহ ছিলেন। সতরূপীর নিজের কথায়, তার নাকি ১০০ জন বউ ছিল। কিন্তু সতরূপীর বাবা ইঞ্জিনিয়ার এবং মা ড্রেস ডিজাইনার এবং এ যুগের মানুষ। তখন তাদের পরিবার ক্যাডিলাক গাড়িও চালাত। সেই সম্ভ্রান্ত সুশিক্ষিত সতরূপীর পরিবারটি, কেমন করে যেন মার্ক্সিস্ট চিন্তা-চেতনার আদর্শে বিশ্বাসী ছিল। সেই রেজা শাহ পাহলবির আমল থেকেই। ফলে শাহের আমলেও সতরূপীর পরিবার হেনস্থা হয়েছে আর ইসলামিক বিপ্লবের পর তো আরও হেনস্থা। টিনএজার সতরূপী তার আদর্শ মডেল মানুষ, তার চাচাকে মৃত্যুদ- দেয়ার আগে দেখতে গিয়েছিল। ১০-১২ বছরের বালিকা জানত তার চাচাকে মারা হবে। কি হৃদয়বিদারক সে দৃশ্য! একজন মার্ক্সিস্ট বিশ্বাসী হওয়ার অপরাধে ইসলামিক বিপ্লবীরা তার চাচাকে মৃত্যুদ- দেয়। ঠিক যেমন বাংলাদেশে মৌলবাদীরা প্রগ্রেসিভ লোকদের নামের লিস্ট করে মৃত্যু বিধান জারি করে! সতরূপীর চাচার মৃত্যুর পর, মা বাবার কি আপ্রাণ চেষ্টা তাদের একমাত্র মেয়েটি যেন বেঁচে থাকে। এক সময় তাই তার মা-বাবা সতরূপীকে ইউরোপে পাচার করে দেয়। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সেই মেয়েটিই আজকের কার্টুন-লেখিকা, সিনেমা পরিচালক, সর্বোপরি সত্যনিষ্ঠ এক্টিভিস্ট মারজেইন সতরূপী। এখন সেই শাহও নেই। সেই খোমেনিও নেই। আছে শুধু তাদের কীর্তিকলাপ। কত নিরাপরাধ প্রাণ নিঃশেষ হয়ে গেছে। হায় কার্ল মাক্স! আপনি কি মন্ত্র বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন যার ফলে মানুষ শুধু ‘সুখ সুখ’ পাখিটির পেছনে ছুটছেই, ধরার আগেই বুকে তীর। ফ্রান্সে বসবাসকারী মধ্যবয়সী মারজেইন সতরূপী বর্তমানে সুখের সময়ই কাটাচ্ছে। একদিন অনেকটাই রিফিউজির মতো ছিল, অর্থ কষ্টও ছিল। ছিল স্বজনহীন এবং স্বজনহারার বেদনা। তবুও তো বিশ্বজুড়ে মানুষকে দিতে পেরেছে অনেক। ॥ দুই ॥ মারজেইন সতরূপীর সৃজনশীলতা এবং সাফল্য আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছে। কেননা আমাদেরও যে তিন তিনটি মেয়ে আছে। একেবারে ছোটটি এ প্রজন্মের। অন্য দুটি ক্যারিয়ার করে ফেলেছে। চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। আর ছোট মেয়ে গুড্ডু এই মে মাসেই হাই স্কুল অর্থাৎ ১২ ক্লাস শেষ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে উৎসব বা ইভেন্টের অভাব নেই। কিন্ডার থেকে শুরু করে এলিমেনটারি, মিডল স্কুল, হাই স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটির কোর্স সমাপ্তিতে গ্রাজুয়েশন সিরিমনি হয়। পরে আবার নিজস্ব পার্টিও হয়। আমাদের গুড্ডুর জন্য একটা পার্টি দিয়েছিলাম। দ্বিতীয় মেয়ে আটলান্টা থেকে বিরিয়ানি, চিকেন কারি, পনির টিক্কা মসলা, ছোলে, নানরুটি ইত্যাদি গাড়ি ভর্তি করে নিয়ে আসে। পার্টিটাতে নানা জাতের মানুষের সমাহার ছিল। কি পড়বে গুড্ডু? আমি ক্যারিয়ার সম্পর্কে কখনই কিছু বলিনি। দুই বছর একটা বিশেষ ভাল রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে পড়েছে। অনেক বিষয় পড়েছে। যা ভাল লাগবে, এনজয় করবে তাই পড়বে। শুধু বলেছিলাম ভাল ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এপ্লাই করতে। ওর মা চেষ্টা করেছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে। যুক্তরাষ্ট্রে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চাকরির বাজার ভাল। তার ওপর মেয়েরা ততটা এই লাইনে আসে না। কিন্তু গুড্ডুর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোন কোর্স পড়ার সুযোগ হয়নি। তাই অনেকটা নৈবচ। পড়ে মতামত দিল, কেমিস্ট্রি ও ম্যাথমেটিক্সে ডাবল মেজর করবে। আমি কেমিস্ট্রির কথা কখনই বলিনি এবং এক-দু’বার ছাড়া কেমিস্ট্রি বুঝতেও আসেনি। তাহলে কি আমাদের ‘জিন’ কথা বলছে। হয়ত বা তবে যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরা ম্যাথে অদক্ষ। যারা ভাল তারা সুপারব। সুতরাং ম্যাথেও মেজর করবে জেনে আমি খুশি। আনন্দের কথা, গুড্ডু এই ফল সেমিস্টারে আটলান্টায় এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে। দু’বছর বয়সে এদেশে আসে। দেখতে দেখতে নদী ও সাগরের পানি অনেকবার রিসাইকেল হয়েছে। সেই রিসাইকেল চলতেই থাকবে। একদিন আমরাও হয়ত রিসাইকেলে চলে যাব। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী অধ্যাপক [email protected]
×