গাফফার খান চৌধুরী/মোঃ খলিলুর রহমান/ মীর আব্দুল আলীম ॥ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের পূর্বাচলের খাল থেকে স্মরণকালে বড় অস্ত্রের চালান উদ্ধারের ঘটনায় রীতিমতো হৈচৈ পড়ে গেছে। শনিবার বিকেলে রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে আরও পাঁচটি এসএমজি (সাব মেশিনগান) উদ্ধার হয়েছে। গত বছর উত্তরার দিয়াবাড়ি খাল থেকে এমনই একটি বিপুল পরিমাণ অস্ত্রগোলাবারুদের চালান উদ্ধার হয়েছিল। তবে তা পূর্বাচলের খাল থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের পরিমাণের চেয়ে অনেক কম। দুইটি অস্ত্রের চালানের মধ্যে বেশকিছু মিল খুঁজে পেয়েছেন তদন্তকারীরা। এত অস্ত্রগোলাবারুদ ইতোপূর্বে আর ঢাকায় উদ্ধারের ঘটনা ঘটেনি। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রগোলাবারুদ কারা কি উদ্দেশ্যে এবং কাদের জন্য এনেছিল তা জানতে রীতিমতো দৌড়ঝাপ শুরু হয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের।
তদন্তকারীদের ধারণা, অস্ত্রের চালানটি ভারতের কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের জন্য আনা হয়ে থাকতে পারে। চালানটি সীমান্ত পথে ভারতে পাঠাতে বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছিল এর সঙ্গে জড়িতরা। তবে কিভাবে কোন পথে এত বড় অস্ত্রের চালান দেশে ঢুকেছে তা রীতিমতো বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। ভারতীয় কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন অস্ত্রের চালানটি বাংলাদেশের কোন জঙ্গী সংগঠনের কাছে পৌঁছে দিতে সেখানে জমা করেছিল কিনা সে বিষয়টিও তদন্তে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশে বড় ধরনের নাশকতা চালিয়ে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে দেশীয় জঙ্গী সংগঠন ও সরকার বিরোধীদের কাছে অস্ত্রের চালানটি হস্তান্তরের জন্য মজুদ করা হয়েছিল কিনা সে বিষয়টি মাথায় রেখেও তদন্ত চলছে।
শুক্রবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের পূর্বাচলের ৫ নম্বর সেক্টরের একটি কৃত্রিম খাল থেকে ২১টি ব্যাগে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয়। নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ বলছে, গত মঙ্গলবার শরীফ খান নামে এক মাদক ব্যবসায়ীর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের বাগলা গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। অভিযানের সময় শরীফ বাড়িতে ছিল না। তার রান্নাঘর থেকে একটি এসএমজি উদ্ধার হয়। পরদিন আদালত প্রাঙ্গণ থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে শরীফকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়। আর তাতেই মিলে বিপুল অস্ত্রের সন্ধান।
শুক্রবার পর্যন্ত চালানো অভিযানে উদ্ধার হয় ৬২টি এসএমজি বা সাব মেশিনগান, ২টি রকেট লঞ্চার, ২টি ওয়াকিটকি, ৫টি ৭ পয়েন্ট ৬২ বোরের পিস্তল, ৪৯টি রকেট লঞ্চারের প্রজেক্টর, ৪২টি হ্যান্ডগ্রেনেড, ৪৪টি এসএমজির ম্যাগাজিন, বিপুল পরিমাণ টাইমফিউজ, ইগনাইটার ও বুলেট।
শরীফের স্ত্রী ফাহিমার দাবি, গত ২৯ মে তার স্বামীর একটি মামলার শুনানির দিন ধার্য ছিল। সকাল ছয়টার দিকে তার স্বামী বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। দুপুরে সাদা পোশাকে দুইজন বাড়িতে গিয়ে শরীফের খোঁজ করেন। পরে কয়েকজন পুলিশ গিয়ে তার রান্নাঘরে অভিযান চালায়। রান্নাঘরের চাল রাখার ড্রামের আড়াল থেকে একটি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে বলে পুলিশ জানায়।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেছেন, একজনকে গ্রেফতারের পর অস্ত্রের চালানটি উদ্ধার হয়েছে। এই চক্রের হাতে আরও অস্ত্রগোলাবারুদ আছে কি না তা জানার চেষ্টা চলছে। কারা কি উদ্দেশ্যে বিপুল অস্ত্রের মজুদ করেছিল তা জানা সম্ভব হবে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এ ধরনের অস্ত্রগোলাবারুদ দেশীয় জঙ্গীদের ব্যবহার করার এখন পর্যন্ত কোন তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। জঙ্গীদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগোলাবারুদের সঙ্গে সদ্য উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগোলাবারুদের মিল নেই।
উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলো চীনের তৈরি। যদিও অস্ত্রের গায়ে উৎপাদনকারী দেশের নাম উল্লেখ নেই। তবে অস্ত্রের ধরন বলছে, এগুলো চীনের তৈরি। পুলিশের মহাপরিদর্শকও এসএমজিগুলো চাইনিজ বলে জানান।
শনিবার গ্রেনেডগুলো নিষ্ক্রিয় করে বম্ব ডিসপোজাল টিম। টিমের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, গ্রেনেডগুলো সক্রিয় ছিল না। গ্রেনেডের সঙ্গে থাকা ডিফিউজ বা বিস্ফোরণ করার যে সার্কিট থাকে সেসব অচল। নিজস্ব পদ্ধতিতে গ্রেনেডগুলো নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত উপজেলার পূর্বাচল উপশহরের ৫ নম্বর সেক্টরের ভুইয়া বাড়ি ব্রিজ সংলগ্ন গুতিয়াবো এলাকার খাল থেকে উদ্ধার হওয়া সব গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করা হয়। গ্রেনেড নিষ্ক্রিয় করার সময় আশপাশের মানুষজনদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে রাখা হয়েছিল। স্থানীয় জেলে ও ডুবুরিদের দিয়ে খালে বিকেল পর্যন্ত অভিযান চালানো হয়।
পুলিশের সদর দফতরের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, অস্ত্রগোলাবারুদের চালানের সঙ্গে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের জড়িত থাকার বিষয়টি স্পষ্ট। অস্ত্র চোরাচালানের আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে অস্ত্রগোলাবারুদ উৎপাদনকারী দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যোগাযোগ থাকে। যে রাষ্ট্র অস্ত্র বিক্রি করে তারা সাধারণত অস্ত্রের অর্ডার পাওয়ার পর অস্ত্র তৈরি করে থাকে। যেসব অস্ত্র বেআইনীভাবে বিক্রি হয়ে থাকে, সেসব অস্ত্রের গায়ে সাধারণত উৎপাদনকারী দেশ নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের দেশের নাম উল্লেখ করে না। যাতে অস্ত্রের চালান ধরা পড়লেও, উৎপাদনকারী দেশকে আর জবাবদিহি করতে না হয়।
গত বছরের ১৮ জুন রাজধানীর তুরাগ থানাধীন উত্তরা ১৬ নম্বর সেক্টরের শেষপ্রান্তে মিরপুর আশুলিয়া বেঁড়িবাঁধ সংলগ্ন বৌদ্ধ মন্দিরের কাছে দিয়াবাড়ি খাল থেকে পানিতে ডুবে থাকা সাতটি ট্রাভেল ব্যাগ উদ্ধার করে পুলিশ। সেই ব্যাগ থেকে উদ্ধার হয় সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোরের ৯৫টি ও ২ দেশীয় পিস্তল, সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোবের ১৯২টি ম্যাগাজিন, ১০টি ম্যাগাজিন গ্লোক পিস্তল, ২৯৫টি এসএমজির (সাব মেশিন গান) ২৬৩টি ম্যাগাজিন, ১০টি বেয়োনেট, ১০৪টি ছোট সিলিন্ডার আকারের বুলেট তৈরির বক্স, নাইন এমএম (নয় মিলিমিটার) পিস্তলের ৮৪০টি তাজা বুলেট, চীনের তৈরি সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোরের ২১৭টি তাজা বুলেট ও অস্ত্র পরিষ্কার করার ১৮৮টি ক্লিনিং রড উদ্ধার হয়।
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার শীর্ষ নেতারা বাংলাদেশে ঘাঁটি গেড়ে আত্মগোপনে ছিলেন। বিশেষ করে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তারা বহাল তবিয়তে বাংলাদেশে বসে তাদের কর্মকা- পরিচালনা করে আসছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভের পর দেশ থেকে অন্য দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গড়ে ওঠা ঘাঁটি গুড়িয়ে দিতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে উলফার সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া ওরফে গোলাপ বড়ুয়াকে তার দুই সহযোগী লক্ষী প্রদীপ গোস্বামী ও বাবুল শর্মাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করে সরকার। এছাড়াও বিভিন্ন সময় উলফা চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়া, সামরিক শাখার উপ-প্রধান রাজু বড়ুয়া, পররাষ্ট্র সচিব শশধর চৌধুরী, অর্থ সচিব চিত্রবন হাজারিকা, সংস্কৃতি সচিব প্রণতি ডেকা ও শীর্ষ নেতা পরেশ বড়ুয়ার পরিবারের সদস্যসহ অন্তত ২৮ জনকে ভারত সীমান্ত দিয়ে পুশব্যাক করা হয়।
এতে করে উলফা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপর চরম ক্ষিপ্ত। তারই প্রেক্ষিতে উলফা বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তারা বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠন ও সরকার বিরোধীদের অর্থ এবং অস্ত্রগোলাবারুদ গিয়ে শক্তিশালী করে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করছে। তারই অংশ হিসেবে উত্তরা এবং পূর্বাচলের অস্ত্রের চালানটি মজুদ করা হয়ে থাকতে পারে। অস্ত্রের চালান দুইটি দেশীয় কোন সন্ত্রাসী বা জঙ্গী সংগঠনের কাছে হস্তান্তরের জন্য মজুদ করা হয়ে থাকতে পারে।
এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দফতরের গোপনীয় শাখার সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, বিপুল অস্ত্রগোলাবারুদ কোথা থেকে কিভাবে সেখানে এসেছে তার তদন্ত চলছে। উদ্ধারকৃত অস্ত্রগোলাবারুদের গায়ে মরিচা ধরেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কয়েক মাস আগে সেখানে অস্ত্রের চালানটি রাখা হয়েছে। প্রতিটি অস্ত্রগোলাবারুদ অনুযায়ী তদন্ত চলছে। উদ্ধারকৃত অস্ত্রগোলাবারুদগুলো কোন কোন দেশ তৈরি করে। এসব অস্ত্রগোলাবারুদ কোন কোন দেশ ব্যবহার করে তা জানার চেষ্টা চলছে। সার্বিক দিক পর্যালোচার পর অস্ত্রের চালানটি কাদের জন্য কি উদ্দেশ্যে এনে মজুদ করা হয়েছিল সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। তিনি আরও জানান, পুরো খালেই অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। খালটি সেচ দিয়ে গুকিয়ে সেখানে অভিযান চালানো হবে।
রূপগঞ্জ থানার ওসি ইসমাইল হোসেন জানান, অস্ত্রগোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়নি। অভিযান শেষে মামলা দায়ের হবে।
নারায়ণগঞ্জ থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ও অস্ত্রের উৎসের সন্ধানের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান মোঃ শফিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তিনি নারায়ণগঞ্জে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, রূপগঞ্জের উদ্ধারকৃত অস্ত্রের উৎস কোথায়, অস্ত্র কোন কোথায় তৈরি হয়েছে সেটি জানার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশ অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি ও চীন থেকে বাংলাদেশ পুলিশ যে অস্ত্র কিনে সেগুলো যাচাই বাছাই করে দেখছি। এই দুই দেশের অস্ত্রের সঙ্গে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের খুব একটা সামঞ্জস্য দেখা যাচ্ছে না। আরও দুই একটি দেশের অস্ত্রে সঙ্গে মিল রয়েছে কিনা তা যাচাই বাছাই করে দেখা হবে। এ বিষয়ে সেনাবাহিনী, সিআইডি এক্সপার্টদের মতামত চাওয়া হবে।
তিনি জানান, এ ঘটনার প্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত শরীফ খান, শান্ত, রাসেল, শাহীন নামে চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। হৃদয় নামের এক যুবক (বর্তমানে বিদেশে আছে) লেকে মাছ ধরতে গিয়ে অস্ত্রের বস্তা পায়ে লাগে। সে একটি বস্তা তুলে ৯-১০টি অস্ত্র পায়। সেই অস্ত্রগুলো তারা বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখে। এরই মধ্যে তাদের কাছ থেকে তিনটি অস্ত্র (এসএমজি) উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও ৫-৬টি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। মূল অস্ত্রের চালানের সঙ্গে গ্রেফতারকৃতদের কোন সংশ্লিষ্টতা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। জঙ্গী কাজে ব্যবহার বা পার্শ্ববর্তী দেশের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সহায়তার জন্য অস্ত্রগুলো এসেছিল কিনা তা তদন্ত সাপেক্ষে বলা যাবে। তবে চট্টগ্রামের দশ ট্রাক অস্ত্রের চালানের সঙ্গে ধরা পড়া চালানের যোগসূত্র থাকতে পারে।