ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ তহবিল;###;তামাকের আগ্রাসন (১)

নীতিমালার অভাবে ৬০০ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে

প্রকাশিত: ০৪:১২, ৪ জুন ২০১৭

নীতিমালার অভাবে ৬০০ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে

রহিম শেখ ॥ প্রথমবারের মতো তামাক খাত থেকে ৬০০ কোটি টাকার বেশি সারচার্জ আদায় হলেও অলস পড়ে আছে পুরো অর্থ। এ সংক্রান্ত ব্যবহার নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত হলেও গত দুই অর্থবছরে তামাক খাত থেকে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বাবদ আদায়কৃত অর্থ ব্যয়ের কোন দিকনির্দেশনা পায়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ফলে তামাক কোম্পানির মালিকদের কাছ থেকে নেয়া স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অথচ টাকার অভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল তামাকবিরোধী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এদিকে আসন্ন বাজেটে তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ওপর আরও বেশি পরিমাণে সারচার্জ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে মারা যায় ৫৭ হাজার মানুষ, পঙ্গুত্ববরণ করে ৩ লাখ ৮২ হাজার জন। সংস্থাটির গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর শতকরা ৬০ ভাগ হয় অসংক্রামক রোগের কারণে। তামাকের এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় সরকার ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে প্রথমবারের মতো সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের ওপর স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ২০১৪ সালের অর্থ আইন দ্বারা আরোপ করা হয়। তামাকজাত দ্রব্য হতে সারচার্জ আদায় সংক্রান্ত বিধিমালা ১ জুলাই ২০১৪ হতে কার্যকর করা হয়। এ আইন অনুসারে আমদানিকৃত এবং দেশে উৎপাদিত সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্য হতে ১ শতাংশ হারে (অর্থনৈতিক কোড ২২১২ এর মাধ্যমে) স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ সংগৃহীত হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সারচার্জ সংগ্রহের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হিসেবে তা আদায়ও করছে। জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে, সারচার্জ থেকে অর্জিত অর্থ ‘তামাক ব্যবহারজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসায় ও পুনর্বাসনে’ ব্যয় করা হবে বলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত উল্লেখ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এ অর্থ ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট কোন বিধিমালা জারি না হওয়ায় আদায় করা অর্থটুকুও অব্যবহৃত রয়ে গেছে। ফলে সরকারের এ প্রশংসনীয় উদ্যোগের কোন সুফল মানুষ পাচ্ছে না। অর্থ মন্ত্রণালয় তথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই সারচার্জ আরোপের কারণ হিসেবে বলছে, জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তামাক নিয়ন্ত্রণ ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা এবং তামাকজাত দ্রব্য হতে অর্জিত স্বাস্থ্যকরের দীর্ঘস্থায়ী ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে তামাক নিয়ন্ত্রণ ও অসংক্রামক রোগের নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য অর্জনে অর্থ যোগান দেয়া, তামাক নিয়ন্ত্রণ ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে কার্যরত সংস্থাগুলোর জন্য আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দেয়া, তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন ও সুরক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করা ও জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কাজে অর্থ যোগান দিতেই এই সারচার্জ আরোপ করা হয়েছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ১১টি দেশে এ ধরনের সারচার্জ প্রথা চালু আছে। এসব দেশের মধ্যে থাইল্যান্ডে ২ শতাংশ, নেপালে প্রতি সিগারেটে ১ পয়সা, ভারতে প্রতি ১০০০ শলাকা বিড়িতে ৫ রুপি, ভিয়েতনামে ১-২ শতাংশ, কাতারে ২ শতাংশ, আইসল্যান্ডে ০ দশমিক ৯ শতাংশ, এস্তেনিয়ায় ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, মঙ্গোলিয়ায় ২ শতাংশ এবং লাওসে প্যাকেট প্রতি ইউএসডি ০ দশমিক ০৩ শতাংশ হারে সারচার্জ আদায় করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে তামাকপণ্যের ওপর ১ শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপ করা হয়। নীতিমালা না থাকায় সারচার্জ থেকে আদায় করা অর্থ গত দু’বছর ধরে তামাক নিয়ন্ত্রণে ব্যয় করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল থেকে গত বছর স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবস্থাপনা নীতি, ২০১৬ প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। এ খসড়ার ওপর মতামত দেয় ১০টি মন্ত্রণালয়। মতামতের ভিত্তিতে নীতিমালা খসড়া চূড়ান্ত করতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার আয়োজন করা হয়। সভা শেষে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো নীতিমালা সন্নিবেশ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোর ব্যাপারে বৈঠকে উপস্থিত সদস্যরা একমত পোষণ করেন। ওই সভায় চূড়ান্ত খসড়া নীতিমালায় নতুন একটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবস্থাপনা কমিটির কোন সদস্য বা তাদের আত্মীয় বা তাদের বা তাদের অধীনে কোন সংগঠন আলোচ্য খাত হতে আর্থিক সুবিধা নিতে পারবে না। স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবস্থাপনা নীতি-২০১৬ এর পরিবর্তে নীতিমালাটিকে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ব্যবস্থাপনা নীতি-২০১৭ হিসেবে অভিহিত করা হবে। এছাড়া তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের ওপর বর্তমানে নির্ধারিত সারচার্জ ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ থেকে ৫ শতাংশ করার ব্যাপারে মন্ত্রণালয় ও এনবিআর একসঙ্গে কাজ করবে। তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক জুবায়ের আহমেদ বলেন, সারচার্জ বাড়ানোর উদ্যোগ ভালো। তবে সারচার্জ আদায়ের পর এর ব্যবহারে স্বচ্ছতা এবং সঠিক খাত নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। নীতিমালা না থাকায় বিগত দিনে আদায় করা অর্থ অব্যবহৃত আছে। এজন্য দ্রুত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের এক কর্মকর্তা জানান, স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ থেকে আদায় করা অর্থ সময়োপযোগী, বাস্তবসম্মত বিশেষ করে তামাক নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট কাজে কিভাবে ব্যবহার করা যায় এবং কোন খাতে ব্যবহার করা যায় সে জন্য খাত নির্ধারণে কমিটি কাজ করছে। এ কমিটি শিগগরই একটি নীতিমালা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার চেষ্টা করছে। ৮ সদস্যের শক্তিশালী এ কমিটি দ্রুত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
×