ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিশের সাতকাহন

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ৩ জুন ২০১৭

ইলিশের সাতকাহন

ইলিশ। তুলনাহীন স্বাদ গন্ধ ও পুষ্টিমান তেলের কারণে তৃপ্ত রসনায় ইলিশ হয়েছে মাছের রাজা। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ইলিশের স্থায়ী ঠিকানা নেই। এরা পরিযায়ী মাছ। আন্তর্জাতিক মাছও বলা যায়। সারা বিশ্বের মহাসাগর সাগর উপসাগরে নানা নামে ইলিশের বিচরণ। বিশ্বে যত ইলিশ উৎপন্ন হয় তার অর্ধেকের বেশি হয় বাংলাদেশে। আর পদ্মার ইলিশ! ইউনিভার্সাল টেস্টি ইলিশ। একই সঙ্গে ইউনিভার্সাল সুন্দরী ইলিশ। আমাদের গর্ব- বাংলাদেশ ইলিশকে জাতীয় মাছের মর্যাদা দিয়েছে। ইলিশের ইতিহাস কত প্রাচীন সেই হিসাব মেলে না। ইলিশের চেয়ে অনেক বড় মাছ আছে। তারপরও ইলিশ মাছের রাজা। বলা হচ্ছে, আদিকাল থেকে ইলিশের অবাধ বিচরণ সাগর মহাসাগরে। ইলিশের বিচরণও বেশ মজার। সাগরের লোনা পানি থেকে নদীর মিঠা পানিতে। সেখান থেকে ফের সাগরের লোনা পানিতে। প্রজনন মৌসুমে বা ডিম ছাড়ার মৌসুমে স্ত্রী পুরুষ ইলিশ ঝাঁক বেঁধে অনুকূল পরিবেশের জন্য সমুদ্র থেকে বের হয়ে পড়ে। নদীর মোহনায় মিঠা পানিতে ডিম ছাড়ে। মিঠা পানিতে শিশু ইলিশ জন্মে সাগরের পানিতে ফিরে যাওয়ার পর্যায়ে বড় হতে থাকে। বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর, ভূমধ্যসাগর, পারস্য উপসাগর, জাভা সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর, টনকিন উপসাগর, পশ্চিম ও মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরে সাঁতরে বেড়ায় ইলিশ। ব্রিটিশ গবেষক হ্যামিল্টন বুকানন ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গোপসাগরে মাছ নিয়ে গবেষণার পর্যায়ে ইলিশকে হিলসা নামকরণ করেন। পরবর্তী সময়ে ফিসার ও বিয়ানিক নামের দুই গবেষক ইলিশকে ‘টেনুয়ানোসা’ ভুক্ত করেন। বিশ্বে পাঁচ প্রজাতির টেনুয়ানোসা পাওয়া যায়। যার মধ্যে তিন প্রজাতি বাংলাদেশে মেলে। ইলিশ (টি-ইলশা), চন্দনা ইলিশ (টি-টলি) ও গুর্তা ইলিশ (এইচ-কি-লি)। এর মধ্যে বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশ বিশ্বখ্যাত ইলিশ। পদ্মার ইলিশ চেনার উপায় হলো, এর পিঠের ওপর কিছুটা সবুজাভ। শরীর রূপালি চকচকে। পাখনা ও লেজ লম্বা। স্ত্রী ইলিশ পুরুষের চেয়ে আকারে কিছুটা বড়। চন্দনা ইলিশকে কেউ চান্দিনা ইলিশ কেউ টালি ইলিশ বলে। চন্দনা কিছুটা চ্যাপ্টা ধরনের। পিঠ হলুদাভ। লেজ ও পাখনা তুলনামূলক ছোট। গুর্তা আকারে ছোট। নীলাভ সবুজ রঙের। শরীরের ধার দিয়ে কালচে বেগুনি রঙের ফোটা। প্রাচীন ইতিহাসের আদি পর্বে ও সাহিত্যে ইলিশকে ‘ইল্লিশো’ বলা হয়েছে। ইল্লিশোর উদ্ধৃতি আছে নানাভাবে। প্রাচীন স্মৃতি শাস্ত্রের প্রণেতা জীমূতবাহন প্রাণীজ উদ্ভিদ ও তেল বা চর্বির তালিকা দিতে গিয়ে ইল্লিশো মাছকে প্রিয় খাদ্য বলে তেলের বহুল ব্যবহারের উল্লেখ করেছেন। দ্বাদশ শতকে সর্ব্বনন্দ ইলিশের প্রশংসা করেছেন। মধ্যযুগের সাহিত্যে বাংলা ও বাঙালী গ্রন্থে মুহম্মদ আবদুল জলিল সে যুগের রন্ধন প্রণালী মাছের তালিকায় ইলিশ অন্যতম উল্লেখ করেছেন। দ্বিজবংশীবদন দাসের মনসামঙ্গল কাব্যে ছন্দায়িত বর্ণনা আছে এ রকম ‘ইলিশ তলিত করে বাচ্চা ও বাঙ্গআ/শউলের খ- ভাজে শউল পোনা/বড় বড় ইঁচা মৎস্য করিল তলিত/রিঠাপুঠা ভাজিলেক তৈলের সহিত...’। ইলিশ ঠাঁই পেয়েছে পদ্মপুরাণ চ-িমঙ্গল ও ভারতচন্দ্রের রচনায়। আধুনিক যুগের সাহিত্যেও ইলিশ বন্দনা কম নয়। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি’ ছড়া শিশু পাঠ্যে আনন্দ দিয়েছে। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের কুবের মাঝির ইলিশ কাহিনী কালজয়ী হয়ে আছে। ইলিশ নিয়ে যে কত কথা- ইলিশের কাঁটার সংখ্যা কত তাও বর্ণিত হয়েছে। কলকাতার মার্কোপোলো রেস্তোরাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতির শেফ অমিতাভ চক্রবর্তী ইলিশের কাঁটার যে হিসাব দিয়েছেন তা লিখেছেন বরেণ্য সাহিত্যিক শংকর। তিনি বাঙালীর খাওয়া দাওয়া গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, এক কেজি ইলিশের কাঁটার সংখ্যা প্রকার ভেদে ৯ থেকে ১০ হাজার। ইলিশে কাঁটা ছিল বলেই বাঙালীর পাতে ইলিশ পড়ছে। তা না থাকলে গলদা চিংড়ির মতো ইলিশ দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশ পাড়ি দিত। আমেরিকা ইউরোপ ও জাপানের সাহেবরা ইলিশের কাঁটায় এতটাই ভয় পায়, এই কাঁটা না জানি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইলিশের পুষ্টিমান সম্পর্কে বিজ্ঞানীগণ বলেছেন, খাদ্য উপযোগী ইলিশে আছে ১৯ দশমিক চার শতাংশ চর্বি এবং ২১ দশমিক আট শতাংশ আমিষ ও খনিজ। ইলিশের চর্বি কখনই ক্ষতিকর নয়। ইলিশের চর্বিতে আছে অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এ্যাসিড ও ওমেগা। যা রক্তের কোলেস্টরেলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। আমিষে আছে নয় ধরনের এ্যামাইনো এ্যাসিড, ক্যালসিয়াম ফসফরাস লৌহ উপাদান। ভিটামিন এ ডি বি মেলে ইলিশে। প্রাচীন শাস্ত্রে ইলিশের গুণ সম্পর্কে বলা হয় মধুর, রেচক, ¯িœগ্ধ, বহ্নিবর্ধক, পিত্তকৃৎ, কফ কৃৎ, বাতনাশক। চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রাচীন হেকিমগণ গাছগাছালির সঙ্গে ইলিশের ঔষধি গুণাগুণ প্রয়োগ করতেন। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×