ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পরিবার দিশাহারা

দমকলের মতিন এখন ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৭ মে ২০১৭

দমকলের মতিন এখন ইতিহাস

গাফফার খান চৌধুরী ॥ জঙ্গী আস্তানায় অভিযানকালে নিজের জীবন উৎসর্গ করে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্য আব্দুল মতিন। দেশ-জাতি সারা জীবন তাকে স্মরণ রাখবে। সবার কাছে ইতিহাস হয়ে থাকলেন। কিন্তু নিজের পরিবারকে রেখে গেলেন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে আমরা দিশাহারা। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে চোখে ঘুম আসে না। দুই শিশুসন্তানকে কিভাবে মানুষ করব তাও জানি না। বড় হলে সন্তানদের সরকার যদি কোন চাকরি দিত, তাহলে মনের জ্বালা কিছুটা হলেও দূর হতো। তবে পুলিশের তরফ থেকে দশ লাখ টাকার সহায়তা পেয়ে খুবই আনন্দিত হয়েছি। যদিও সরকার সব সময়ই সন্ত্রাস ও জঙ্গীবিরোধী অভিযানে হতাহতদের সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। সরকারের সার্বিক সহযোগিতা পাব বলে আশা করি। কথাগুলো বলার সময় আবেগে কাঁদছিলেন গত ১১ মে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে জঙ্গী আস্তানায় অভিযানকালে জঙ্গীদের গ্রেনেড হামলায় নিহত ফায়ার সার্ভিস সদস্য আব্দুল মতিনের স্ত্রী গৃহিণী তানজিলা বেগম। বলছিলেন, ১৯ বছরের বিবাহিত জীবন তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে গেলো জঙ্গীদের কারণে। জীবন আজ অর্থহীন মনে হচ্ছে। স্বামীর মৃত্যুতে এত কষ্ট পেয়েছি যে, যা জীবনে আর কোনদিনই পাইনি। স্বামীর বাড়ি রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী থানাধীন মাটিকাটার বাটা গ্রামে। আমার বাড়ি একই থানাধীন মহিশালবাড়ি গ্রামে। শ্বশুর এহসান আলী। শাশুড়ি বাদেনূর বেগম। পাঁচ ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিল আমার স্বামী। স্বামীর উপার্জনে সংসার চলত। পাশে বসে থাকা মেয়ে জেসমিন আক্তার স্থানীয় মহিশালবাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। মায়ের সঙ্গে আসা একমাত্র ছেলে আব্দুল্লাহ মারুফ স্থানীয় আল ইসলা ইসলামিয়া একাডেমির ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী। পিতার শোকে কাতর শিশুটির চোখেমুখে ছিল শূন্যতা। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে মানুষজনের দিকে তাকিয়ে ছিল। তেমন কিছুই বলছিল না। বলতে গেলেই কান্নায় কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। নিহতের স্ত্রী বলছিলেন, স্বামীর মৃত্যুতে চোখে অন্ধকার দেখছি। কারণ যৌথ পরিবার। আমার স্বামীর চার ভাই ও একমাত্র বোন ছোট। তাদের মানুষ করা কঠিন হয়ে পড়বে। দুই সন্তানকে কিভাবে মানুষ করব জানি না। তবে পুলিশের তরফ থেকে আমাকে দেয়া ৭ লাখ এবং আমার শাশুড়িকে দেয়া ৩ লাখ টাকা অনেক কাজে লাগবে। সরকার সব সময়ই জঙ্গীবিরোধী অভিযানে নিহতদের পরিবার ও আহতদের নানাভাবে সহায়তা করে থাকেন। সরকার আমাদের সহায়তা করলে খুবই খুশি হবো। বিশেষ করে আমার স্বামীর পরিবারের যেসব সদস্য পড়ালেখা করছে, তাদের পড়ালেখার খরচ দিলে খুবই ভাল হতো। পাশাপাশি ছেলেমেয়ে বড় হওয়ার পর তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দিলে খুব কৃতজ্ঞ থাকব। এরপর আর তেমন কিছুই বলতে পারছিলেন না। শুধুই গুমরে কাঁদছিলেন। এর আগে অনুষ্ঠানে জানানো হয়, আব্দুল মতিনের বয়স হয়েছিল প্রায় ৪৩ বছর। স্থানীয় একটি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ১৯৯৫ সালে তিনি ফায়ার সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। ওই অভিযানে রাজশাহী জেলা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমিত চৌধুরী, ডিবির এএসআই উৎপল কুমার ও আহসান হাবিব এবং কনস্টেবল আবু সাঈদ ও তাইজুল ইসলাম আহত হন। অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক নিহত আব্দুল মতিনের পরিবারের কাছে নগদ ১০ লাখ টাকা এবং আহত পাঁচ পুলিশ সদস্যদের নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। পরে পুলিশপ্রধান বলেন, হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার ঘটনা তাদের বড় অভিজ্ঞতা। ওই হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা, ১৭ বিদেশী ও তিন বাংলাদেশীসহ মোট ২২ জন নিহত হন। এটি একটি বড় অভিজ্ঞতা। রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানাধীন মাটিকাঁটা ইউনিয়নের বেনীপুর গ্রামের সাজ্জাদ আলীর বাড়িতে থাকা জঙ্গী আস্তানায় ওই দিনের অভিযান সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে পুলিশ প্রধান বলেন, মাটির দেয়াল দিয়ে তৈরি বাড়িটি ছিল নির্মাণাধীন। নিহত ফায়ারম্যান অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে মাটির দেয়াল গুঁড়িয়ে দিতে খুব কাছ থেকে দ্রুতগতিতে পানি দিচ্ছিলেন দেয়ালে। ঠিক ওই সময় জঙ্গীরা আস্তানা থেকে বেরিয়ে গ্রেনেড হামলা চালালে ফায়ারম্যান আব্দুল মতিনের মৃত্যু হয়। ভবিষ্যতে আরও সাবধানতার সঙ্গে জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন তিনি। যাতে অভিযানকারীদের কেউ হতাহত না হন। ভবিষ্যতে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস আরও সমন্বয় করে জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালাবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আলী আহাম্মেদ খান বলেন, ভবিষ্যতে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস যৌথভাবে পরিকল্পনা মোতাবেক জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালাবে। অনুষ্ঠানে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×