ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গোদাগাড়ীর আস্তানায় নিহত আশরাফুলের চাঞ্চল্যকর কাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৪ মে ২০১৭

গোদাগাড়ীর আস্তানায় নিহত আশরাফুলের চাঞ্চল্যকর কাহিনী

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ইউনিয়নের বেনীপুরে জঙ্গী আস্তানায় অপারেশন ‘সান ডেভিলে’ দুই নারীসহ পাঁচ জঙ্গীর আত্মঘাতীর পর থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। জঙ্গীদের আত্মঘাতী বিস্ফোরণে হতাহতের পর শঙ্কিত পুরো গ্রাম ও আশপাশের মানুষ। সিলকরা টিনের ওই বাড়ি ঘিরে উৎসুক মানুষের চোখ। অনেকে বাড়িটির ধারে কাছেও যাচ্ছে না। দূর থেকে মাঠের মধ্যকার বাড়িটি চেয়ে দেখছে ঘৃণার দৃষ্টিতে আর অবাক হচ্ছেন। তারা ভাবতেই পারছেন না এই ঘরেই বসবাস করে আসছিল দেশবিরোধী জঙ্গীরা। ওই গ্রামে শনিবারও দেখা গেছে পুলিশী পাহারা। এলাকাবাসীর শঙ্কা দূর করতেই সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গোদাগাড়ী থানার ওসি হিফজুল আলম মুন্সি। তিনি বলেন, আত্মঘাতী ঘটনার পর নিভৃত ওই গ্রামের মানুষ অনেকটাই ভীত ও শঙ্কায় রয়েছেন। তাদের শঙ্কা দূর করতেই সেখানে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। আরও কয়েকদিন পুলিশ মোতায়েন থাকবে। মাটিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আজম তৌহিদ বলেন, এ গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ কৃষি শ্রমিক। সারাদিন মাঠে কাজকর্ম করেই জীবিকা নির্বাহ করে। তাই ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলার পর গ্রামবাসীর মধ্যে অজানা ভীতি কাজ করছে। গ্রামের মানুষের মধ্যে শুধু জঙ্গীদের নিয়েই আলোচনা চলছে। অনেকে ঘটা করে ফাঁকা মাঠের মধ্যে জঙ্গী আস্তানা সেই টিনের বাড়িটি দেখতে গেলেও খুব কাছে ভিড়তে ভয় পাচ্ছেন। তাই দূর থেকেই বাড়িটি দেখছেন। তিনি বলেন অপারেশন সান ডেভিলের আগে জঙ্গী আস্তানার বিষয়টি কেউ টের পাননি। জঙ্গী আস্তানা ওই গ্রামকে কলঙ্কিত করেছে। গ্রামবাসীরা জানান, গত দুদিন ধরে জঙ্গী আস্তানা ঘিরে পুরো গ্রামের মধ্যে থমথমে অবস্থা কে এই জঙ্গী সাজ্জাদ এদিকে জঙ্গী সাজ্জাদ সম্পর্কে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। একই গ্রামে বসবাসকারী সাজ্জাদের শ^শুর লুৎফর রহমান জানান, তার জামাই সাজ্জাদ এক সময় জামায়াতের রাজনীতিতে জড়িত ছিল। অত্যন্ত গোড়া প্রকৃতির সাজ্জাদের চালচলনেও ছিল নানা রহস্য। মেয়ে সুমাইয়াকে বিয়ে দেয়ার পর থেকেই জেএমবি ক্যাডার জামাই জহুরুলের প্ররোচনায় জঙ্গী হয়ে যায়। এরপর কাপড় ব্যবসার আড়ালে পরিবারের সবাইকে জঙ্গীবাদের পথে সক্রিয় করে। তাদের ঘৃণিত দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে শ^শুর লুৎফর জানান, এসবের পেছনে রয়েছে সাজ্জাদের জামাই জহুরুল। জানা গেছে প্রায় ছয় মাস আগে জহুরুলকে গ্রেফতার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। ওই সময় এ বিষয়টি নিয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। সে খবরের সত্যতা মিলছে এতদিন পর। ওই সময় গোয়েন্দারা জানিয়েছিলেন, গত বছরের ৩১ অক্টোবর গোদাগাড়ীর দুর্গম চরের দিয়াড় মানিকচক গ্রামে জহুরুলের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। এরপর তাকে গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওই দিনই জহুরুল কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। জহুরুলকে আটকের দিন অভিযানে ছিলেন জেলা ডিবির এক উপ-পরিদর্শক। জেলা ডিবিতে যাওয়ার আগে তিনি গোদাগাড়ী থানাতেও কর্মরত ছিলেন। এই পুলিশ কর্মকর্তা সেদিন জহুরুলকে আটকের সত্যতা স্বীকার করেননি। তবে বেনীপুরে জহুরুলের শ্বশুর সাজ্জাদের বাড়িতে অভিযান চালানোর পর তিনি সে দিনের অভিযানের সত্যতা স্বীকার করেন। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, জহুরুলকে আটকের পর কড়া নিরাপত্তায় রাখার জন্য তাকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হয়। সেই জহুরুলই তার শ্বশুর বাড়ির সম্পর্কে তথ্য দেয়। এরপর পুলিশ সদর দফতর সেই তথ্য গোদাগাড়ী থানায় পাঠায়। এরপর পরিবারটিকে নজরদারির ভেতরে রাখে পুলিশ। দীর্ঘ প্রস্তুতির পর বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান শুরু করা হয়। পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক নিশারুল আরিফ বলেন, পুলিশের গোয়েন্দারা কাজ করেছে। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আস্তানাটির সন্ধান পাওয়া যায়। জানা গেছে, অনেক আগেই জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের জেএমবিতে যোগ দিয়েছিল সাজ্জাদ। তবে সেই সময় সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি সে। পুরাতন জেএমবি নতুন নব্য জেএমবি হয়ে ওঠায় সে আবার সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করে। জঙ্গী সাজ্জাদ তার পুরো পরিবারকে নব্য জেএমবি’র সদস্য বানিয়ে ফেলে। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, জঙ্গী সাজ্জাদ আলীর ভাই মনিরুল ইসলাম জেএমবির অন্যতম সদস্য। ২০০৫ সালে জেএমবির মৃত্যুদ-প্রাপ্ত শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইয়ের হাত ধরে জেএমবিতে ভেড়ে সে। মনিরুলের হাত ধরে জেএমবিতে যোগ দেন সাজ্জাদ আলী। তবে কিছুদিন পরেই মনিরুল চট্টগ্রামে অস্ত্রসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ১০ বছরের জেল হয় তার। এছাড়াও জেএমবি’র শীর্ষ নেতারা ধরা পড়ে ও বিচারে তাদের ফাঁসি হওয়ার কারণে সাজ্জাদ বেশিদূর এগোতে পারেনি। তবে, সম্প্রতি নব্য জেএমবি সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করলে আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে সাজ্জাদ। যোগাযোগ বাড়ে জেএমবি সদস্যদের সঙ্গে। আর এবারে তার নেপথ্যের গুরু হয় নিজের জামাই জহুরুল। তার হাত ধরেই মূলত সাজ্জাদ তার পুরো পরিবারকে জঙ্গীদের সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য বানিয়ে ফেলে। জহুরুলকে প্রথমে গ্রেফতারের পরই সাজ্জাদের ব্যাপারে তথ্য পায় পুলিশ। জঙ্গী আশরাফুল বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার অপারেশন সান ডেভিলে আত্মঘাতী আশরাফুল সম্পর্কেও তথ্য মিলেছে। পুলিশ জানিয়েছে, জঙ্গী আশরাফুল বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার দেবীনগর ইউনিয়নের চর চাকলা গ্রামে। আইএসের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এবং আইএসের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছে এমন এক বাংলাদেশী জঙ্গীকে খুঁজছে ভারত সরকার। ভারত সরকারের সন্ধানের তালিকায় রয়েছে রাজশাহীর বাগমারার শরিফুল ইসলাম। এছাড়া আরও ১০ জঙ্গীর নাম দেয়া হয়েছিল ভারতের পক্ষ থেকে। এই ১০ জনের মধ্যে নাম আছে আশরাফুলের। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর জঙ্গী আস্তানায় অপারেশন ‘সান ডেভিলে নিহত হয় আশরাফুল নামের একজন। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করা নারী সুমাইয়া আশরাফুলকে শনাক্ত করেন। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই আশরাফুল আইটি বিশেষজ্ঞ। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। আশরাফুল বড় মাপের জঙ্গী। রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি নিশারুল আরিফ জানান, ভারত আশরাফুল নামের যে জঙ্গীর নাম দিয়েছে, নিহত আশরাফুল ওই আশরাফুল কি না তা ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হবে। তবে আশরাফুল যে বড় মাপের জঙ্গী এ ব্যাপারে পুলিশ নিশ্চিত। আশরাফুলের সঙ্গে জঙ্গী সাজ্জাদের ছেলে আলামিনের পরিচয় ছিল। সেই সূত্র ধরে সাজ্জাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল আশরাফুলের। পুলিশের ধারণা বেনীপুরের ওই বাড়িটি বোমা বানানোর কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। অতিরিক্ত ডিআইজি নিশারুল আরিফ জানান, আশরাফুলের সঙ্গে সাজ্জাদের পরিবারের পরিচয় ও বাড়িটি কী কাজে ব্যবহার করা হতো তা নিশ্চিত হতে আত্মসমর্পণ করা সুমাইয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আত্মসমর্পণকারী সুমাইয়াকে নিয়ে পুলিশের নতুন অভিযান এদিকে অপারেশন সান ডেভিলে আত্মসমর্পণকারী জঙ্গী সুমাইয়াকে নিয়ে নতুন করে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি তাকে নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
×