ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি

গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ ॥ ইতিহাসবিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন জরুরী

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১৪ মে ২০১৭

গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ  ॥ ইতিহাসবিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন জরুরী

(শেষাংশ) ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ঐ দিন তিনি এক বক্তব্যে বলেন- ‘বাংলার মাটিতে যুদ্ধপরাধীদের বিচার হবে।’ এই লক্ষ্যে ’৭২-এর ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণয়ন করে The Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) order, ১৯৭২” যা দালাল আইন নামে পরিচিত- ’৭৩-এর জুলাইয়ে প্রণয়ন করা হয় International Crimes Tribunals অপঃ- ১৯৭৩ সারাদেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধপরাধের দায়ে প্রায় ১১ হাজার দালালের বিচার চলছিল। এরমধ্যে ৭৫২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে দন্ডিত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সংবিধানে ১২,৩৮,৬৬ ও ১২২নং অনুচ্ছেদ সংযোজন করে দালালদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন, দালালদের ভোটাধিকার ও সংসদ সদস্য হবার অধিকার ছিল না। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশকে আবারও পাকিস্তান বানানোর লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়। জিয়াউর রহমান ও খন্দকার মোস্তাক বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ইনডেমনিটি দেয়, বিদেশী দূতাবাসে চাকরি দেয়, পুনর্বাসন করে। ’৭৫-এর ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে অর্ডিন্যান্স নাম্বার- ৬৩/১৯৭৫ জারি করে, এবং কারাগারে আটক ও দ-িত সকল যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়, ৭৬ সালে সেকেন্ড প্রক্লেমেশন অর্ডার নাম্বার- ৩/১৯৭৬ জারি করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করবার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাবলী তুলে দেয়। সেকেন্ড প্রক্লেমেশন ঘোষণা জারি করে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের ভোটার হওয়ার সুযোগ দেয়। প্রক্লেমেশন অর্ডার নাম্বার- ১/১৯৭৭ জারি করে দালালদের সংসদে নির্বাচিত হওয়ার লক্ষ্যে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ তুলে দেয়। প্রক্লেমেশন অর্ডার নাম্বার- ১/১৯৭৭ এর মাধ্যমে সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে দালালদের রাজনীতি করার সুযোগ দেয়। রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী, রাজাকার আলীমকে মন্ত্রী বানায়। শহীদ পরিবারের জন্য বঙ্গবন্ধু যে সকল বাড়ি বরাদ্দ করেছিলেন জিয়াউর রহমান জোরপূর্বক ঐ সব বাড়ি থেকে শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুলিশ বা সেনাবাহিনী দিয়ে উৎখাত করে। বঙ্গবন্ধু ৭৩ সালে ১৮ এপ্রিল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কুখ্যাত যুদ্ধপরাধী গোলাম আযম গংদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছিলেন। জিয়াউর রহমান ৭৮ সালে গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনে। জিয়াউর রহমানের সময় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকদের বেছে বেছে হত্যা করে। যুদ্ধক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের নেতিবাচক কর্মকা-ে বিরক্ত হয়ে জেনারেল ওসমানী বাধ্য হয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর অন্যতম কর্তা কর্নেল বেগ সকাল-সন্ধ্যা বাঙালীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান ও কর্নেল বেগ প্রতিপক্ষ। প্রশ্ন জাগে, কেন পাকিস্তানী হানাদার কর্নেল বেগ জিয়াউর রহমানের কাজে খুশী, আর খুব শিগগিরই জিয়াউর রহমান নতুন কাজ কেন পাবে? মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। জিয়াউর রহমান খালেদা জিয়াকে নেবার জন্য চিঠি দিয়ে লোক পাঠানো সত্ত্বেও খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে যাননি, তিনি ক্যান্টনমেন্টেই ভাল আছেন সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন স্বামীকে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান মহান ম্ুিক্তযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার নেতৃত্বের ইতিহাস নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। এমনকি ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দের প্রতিও জিয়াউর রহমানের ভীতি ছিল। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে দেয়া হয়নি। একই ধারাবাহিকতায় ৯১ সালে জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে দেশকে, ইতিহাসকে, আমাদের গৌরবকে ম্লান করে দেয়। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর বিকৃত খেলায় মেতে উঠে বিএনপি, রাজাকারের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়, আর যুদ্ধপরাধীদের বিচার দাবি করায় শহীদ জননী জাহানারা ঈমামের হাতে হাতকড়া পড়ায়। ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৩ সালের ৮ জানুয়ারি পরাজিত পাকিস্তানী জেনারেল জানজুয়ার মৃত্যুতে, খালেদা জিয়া সকল প্রকার রীতিনীতি প্রথা ভেঙ্গে জানজুয়ার জন্য শোকবার্তা প্রেরণ করে সেদিন বীর বাঙালীর মাথা হেঁট করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বাঙ্গালী জাতির আলোকবর্তিকা, নিকষ কালো অন্ধকার দূর করেছেন, তাঁর নেতৃত্বে আমরা উদয়ের পথে যাত্রা করছি। তিনি জীবনের ওপর মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে সকল অপশক্তি ও নেতিবাচক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করছেন দৃঢ় প্রত্যয়ে। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম গংদের বিচার চেয়ে ১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল জাতীয় সংসদে দেওয়া তাঁর একটি বক্তব্য এখানে উল্লেখ করছি, “এই সংসদ সার্বভৌম সংসদ। সেই লক্ষ্যে, আমি বিশ্বাস করি যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ, যুদ্ধ ও গণহত্যাসহ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সাধন, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পরও পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের সঙ্গে জড়িত থেকে বাংলাদেশের বিরোধিতা, বিদেশী নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের উদ্দেশে বেআইনী রাজনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত পাকিস্তানী নাগরিক গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ জনগণের যে মতামত প্রতিফলিত হয়েছে, তাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ আন্তর্জাতিক ক্রাইম এ্যাক্ট ১৯৭৩ অনুসারে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ সম্পর্কে বিচারের জন্য আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আপনার মধ্যমে এই সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। সেই লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে গোলাম আযম ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে প্রসিকিউশন ও বিচারের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব রাখছি।’ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধপরাধ, গণহত্যার বিচার চলছে। রায় কার্যকর হচ্ছে। ট্রাইব্যুনাল বন্ধ করে দিতে, বিতর্কিত করতে দেশে-বিদেশে গভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করছে যুদ্ধাপরাধীর দল। এমনকি ট্রাইব্যুনাল থেকে নথি চুরি করেছে। যুদ্ধপরাধীদের বাঁচাতে ডলার এর বিনিময়ে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে। এদের মধ্যে টবি ক্যাডম্যান, আর একিন গাম্পের কথা উল্লেখ করতে পারি। খালেদা জিয়া, তার পুত্র তারেক রহমান ও বিএনপি নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানের সুরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দেন। গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে কটাক্ষ করেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেন। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে ভেজা বাংলার মাটিতে এই ঔদ্ধত্য ও স্পর্ধা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আমরা মেনে নিতে পারি না। এটি গর্হিত অপরাধ। ইতিমধ্যে মহান জাতীয় সংসদ ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এখন প্রয়োজন গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের শাস্তির জন্য আইন প্রণয়ন। পৃথিবীর ১৭টি দেশে গণহত্যা অস্বীকার বা ঐড়ষড়পধঁংঃ ফবহরধষ ষধি রয়েছে। যেমন: অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চেজ রিপাবলিক, ফ্রান্স, জার্মানী, হাঙ্গেরী, নেদারল্যান্ডস, পোলান্ড, পর্তুগাল, রাশিয়া, রোমানিয়া ইত্যাদি। বীরের রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রুধারা আমরা ব্যর্থ হতে দিব না, ত্রিশ লাখ শহীদ বুকের রক্ত দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করে গেছেন। দুই লাখ সম্ভ্রম হারা মা- বোনের আর্তনাদ আমরা ভুলিনি। রাজনীতির কবির অমর কবিতা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” আমাদের অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ, আত্মায় বিরাজমান। এ প্রসঙ্গে ৮ মার্চ, ১৯৭১ দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের অংশ ঠিক এরকম, “আবহমান বাংলার বাসন্তী সূর্য আর উদার আকাশকে সাক্ষী রাখিয়া গতকাল নির্ভীক নেতা এবং বীর জনতার কণ্ঠস্বর একই সুরে ধ্বনিত হইয়া ওঠে যুগ-যুগান্তর, দেশ-দেশান্তরের সকল মুক্তি-পিপাসু সভ্য জাতির হৃদয়বাসনার অমোঘ মন্ত্র ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ ধ্বনি ওঠে লাখ লাখ কণ্ঠে দিগন্ত ‘কাঁপাইয়া ‘জয় বাংলা’ ৭ মার্চ তাই বাংলার সার্বিক স্বাধিকার আন্দোলনের দুর্গম দুস্তর পথের প্রান্তে একটি অতুলনীয় স্মৃতিফলক।’ যারা গণহত্যা অস্বীকার করে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে- তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করেনা, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ২৬মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণায় বিশ্বাস করে না। ১০ এপ্রিলে প্রণীত স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র মানে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে তারা মুজিবনগরে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ এর প্রথম সরকার মানে না, যে সরকারের অধীনে আমরা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। ওরা আমাদের সংবিধান মানে না, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতকে অবমাননা করে। তাই ওদের শাস্তির নিমিত্ত আইন প্রণয়ন আবশ্যক। গত ০৪ মে, ২০১৭-এ এ সংক্রান্ত আমার একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব মহান জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে অনেক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমি বিশ্বাস করি ’৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে সংঘটিত নৃশংস গণহত্যা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের শাস্তির জন্য মহান জাতীয় সংসদ আইন প্রণয়ন করবে। ইতোমধ্যে এই আইনটির খসড়া তৈরি করা হয়েছে বলে মাননীয় আইনমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন। আমরা শহীদের রক্ত ঋণ শোধ করব। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের ইতিহাসকে মহিমান্বিত করব। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।
×