ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আকাশ সংস্কৃতির অশ্লীল আগ্রাসনও দায়ী

সামাজিক অবক্ষয় আর বিচারহীনতায় বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৩ মে ২০১৭

সামাজিক অবক্ষয় আর বিচারহীনতায় বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ২৮ এপ্রিল রাজধানীর পূর্ব জুরাইন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে পনেরো বছরের এক কিশোরীকে আটকে রেখে আটজন মিলে যৌন নির্যাতন করেছে। নির্যাতনের শিকার কিশোরীর মামলার প্রেক্ষিতে বিদ্যালয়টির নিরাপত্তাকর্মী স্বপনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জানা যায়, মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে স্কুলের নিরাপত্তাকর্মী এ ধরনের ঘৃণিত কাজে প্রশ্রয় দেয়। সেদিন জুরাইনে মামার বাসা থেকে পুরান ঢাকার নিজ বাসায় যাচ্ছিলেন এই কিশোরী। তার রিক্সা চেয়ারম্যান বাড়ি এলাকার রাস্তায় গতিরোধ করে কিছুদিন আগে পরিচিত যুবক শাওন। মেয়েটির অসহায়ত্বের সুযোগে পূর্ব জুরাইন আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়ে তার ওপর যৌন নির্যাতন করে শাওন ও তার সাত সহযোগী। এলাকার প্রভাবশালীদের কাছে বিচার না পেয়ে পরে থানায় মামলা করে নির্যাতি এই কিশোরী। ঘটনার ১৪ দিন পার হলেও পুলিশ এখনও মূল অপরাধীদের খুঁজে করতে বের করতে পারেনি। পুলিশ জানিয়েছে, আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। সামাজিক অস্থিরতা, অপসংস্কৃতি, আকাশ সংস্কৃতি, অশ্লীলতা, ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা কারণে দিনে দিনে সামাজিক অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। পাশাপাশি অশ্লীলতার আগ্রাসনে মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অভাব ও সামাজিক অবক্ষয়ে ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ধর্ষণের শিকার যারা তাদের অধিকাংশই শিশু-কিশোরী। স্কুল, কোচিং এমনকি নিজ বাড়িতেও নিরাপদ নয় শিশু কিশোরীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে চরম নৈতিক অবক্ষয়, আকাশ সংস্কৃতি, মাদকের বিস্তার, বিচার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। নারী ও শিশু মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, দেশে ’১৬ সালে এক হাজারেরও বেশি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সংগঠনটি নারীর ওপর নির্যাতনের এমন নির্মম ও নিষ্ঠুর ধরনকে উদ্বেগজনক বলে বর্ণনা করেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদে সংরক্ষিত ১৪ দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ২০১৭ সালের এপ্রিলে ৮৫ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে তথ্য মিলেছে। মার্চ মাসে এ সংখ্যা ছিল ৮৮। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৭৯। এরমধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৩, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে চার জনকে। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৬ জনকে। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে আট। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৩। জানুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৭৬। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪ জনকে। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২ জনকে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে এ পর্যন্ত মোট ৩২৮ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। নারী নির্যাতনের চিত্র দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। বরং নির্যাতনের মাত্রায় যোগ হয়েছে নতুন কৌশল। মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু ধর্ষকদের শাস্তির দাবি জানিয়ে বলেন, মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অভাব ও সামাজিক অবক্ষয়ে ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। যারা অপরাধী তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরাধী একজন ব্যক্তি, কাজেই সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। নির্যাতনের শিকার নারী প্রায়ই অভিযোগ করতে চায় না। কারণ তারা পুনরায় নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও ছেড়ে দেয়ার ভয় দেখানো হয়। এই সংস্কৃৃতি থেকে বের হতে হলে সাইবার ক্রাইমের বিরুদ্ধে যে আইন হয়েছে তার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া পরিবার থেকে সন্তানকে যেন যথাযথ মূল্যবোধ দিয়ে বড় করা হয় সে আহ্বানও তিনি সকল অভিভাবকের প্রতি রাখেন। শরীয়তপুরের একটি উপজেলায় আট বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ করে দুই কিশোর। দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশুটি স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতে খেলাধুলা করছিল। এ সময় প্রতিবেশী দুই কিশোর শিশুটিকে ঘরে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে। মেয়েটির চিৎকার শুনে পরিবারের লোকজন এসে উদ্ধার করে। ঘটনাটি ১ এপ্রিলের। চিকিৎসার জন্য মেয়েটিকে আনা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে। পরবর্তীতে মেয়েটি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, এ অপরাধ প্রতিরোধে কয়েকটা ধাপে কাজ করতে হবে। প্রথমত, মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তৃতীয়ত, আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে চলেছে বলে অভিযোগ করেছে শিশু বিষয়ক বেসরকারী সংস্থাগুলোর জাতীয় নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ)। বিএসএএফের সা¤প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑচলতি ২০১৭ সালের প্রথম ৩ মাসে ১৪৫ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে যা ২০১৬ সালের একই সময়ের তুলনায় ৫১ শতাংশ বেশি। ২০১৬ সালে একই সময়ে এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা ছিল ৯৬। অর্থাৎ তিন মাসে ৪৯ বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি, একই সময়ে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩১। এতে বলা হয়েছে চলতি বছরের একই সময়ে শিশুদের গণধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে তার আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ। ধর্ষণের পর শিশু হত্যার ঘটনাও বাড়ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে শিশু ধর্ষণের মোট ঘটনা ছিল যথাক্রমে ৫২১ ও ৪৪৬। গত ২৫ মার্চ রাজধানীর দক্ষিণখানে চার বছর বয়সী এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পুলিশের তথ্যমতে, রাত নয়টার দিকে প্রতিবেশী আবুল খায়ের তার কক্ষে শিশুটিকে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে। পরে বাসায় এসে শিশুটি কান্নাকাটি করলে বাবা-মা বিষয়টি জানতে পারেন। এ ঘটনায় আবুল খায়েরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভারসাম্যহীনতা, আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া এবং অভিভাবকের অসচেতনতা শিশু ধর্ষণ বৃদ্ধির বড় কারণ। প্রতিরোধে দরকার দ্রুত বিচার এবং অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এ্যাডভোকেট সালমা আলী জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে অপরাধের সংখ্যা ওঠা-নামা করে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও একটি বড় কারণ। এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে দরকার দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা; যা মানুষের অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করবে। পাশাপাশি, নিম্নবিত্ত পরিবারে শিশুদের দেখভালের বিষয়ে গুরুত্ব বাড়াতে হবে।
×