ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পর ইয়াবার আগ্রাসন রোধে তৎপর প্রশাসন

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৯ মে ২০১৭

প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পর ইয়াবার আগ্রাসন রোধে তৎপর প্রশাসন

মোয়াজ্জেমূল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারে উৎপাদিত মরণনেশার মাদক ইয়াবা ট্যাবলেটের আগ্রাসন নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে কঠোর হুঁশিয়ারি প্রদানের পর প্রশাসন এবং এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। কক্সবাজার জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা চোরাপথে চালানে চালানে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে অব্যাহতভাবে আসার রুট বন্ধে এবং জড়িতদের আইনের আওতায় আনার নতুন চিন্তা ভাবনা শুরু করেছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শনিবার কক্সবাজারে বিশাল জনসভায় সুস্পষ্টভাবে ইয়াবার আগ্রাসন বন্ধে এবং এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকাজুড়ে ৩৭টি ইয়াবা ট্যাবলেট উৎপাদন ফ্যাক্টরি রয়েছে। এছাড়া ছোটখাটো রয়েছে আরও বেশকিছু। এসব কারখানায় উৎপাদিত বিভিন্ন মূল্যের ইয়াবার চালান বছরের পর বছর ধরে আসছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে। এর প্রধান রুট স্থল ও সমুদ্র পথে। চট্টগ্রাম হচ্ছে বড় একটি ট্রানজিট পয়েন্ট। এরপরে ইয়াবার চালান চলে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। বর্তমানে ইয়াবার চোরাচালান এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, এর একটি অংশ এখন বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও যাচ্ছে। কক্সবাজার অঞ্চলের চিহ্নিত জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য, প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের একটি অংশ এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলেছে। এসব ঘটনা নিয়ে প্রচার মাধ্যমে অহরহ তথ্য প্রচারিত হলেও রহস্যজনক কারণে এদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বৃহত্তর চট্টগ্রামে এমন কোন দিন নেই যে ছোট বড় ইয়াবার চালান ধরা পড়ছে না। এর সঙ্গে যারা গ্রেফতার হচ্ছে এরা মূলত ক্যারিয়ার। নেপথ্যেও গডফাদাররা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে সর্বশেষ তালিকা প্রণীত হয় ২০১৩ সালে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালিত এ তালিকায় রয়েছে ৭৬৪ ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম। পরবর্তীতে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, সরকারী বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের তালিকা যোগ করে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১২২৫ জনে। ২০১৩ সালে পুলিশের উর্ধতন এক কর্মকর্তার নেতৃত্বে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের যে তালিকা প্রণীত হয় তাতে কক্সবাজার অঞ্চলের এক চিহ্নিত সংসদ সদস্যের নামও ওঠে আসে। শুধু তাই নয়, তার সঙ্গে তার পরিবারের অনেকের নামও চিহ্নিত করা হয়। অথচ এদের কখনও আইনের আওতায় আনা হয়নি সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের অভাবে। অথচ প্রশাসনসহ কে না জানে কক্সবাজার অঞ্চলে ইয়াবা ব্যবসার নেপথ্যের গডফাদার কে বা কারা। কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া অঞ্চলে এ ব্যবসায় জড়িত হয়ে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়ার সংখ্যাও কম নয়। বিলাসবহুল প্রাসাদ গাড়িসহ বিত্তের পাহাড় গড়ে তোলার তথ্য রয়েছে প্রশাসনের কাছে। কিন্তু এদের কেশাঘ্রও ছোঁয়া যায় না। যারাই গ্রেফতার হয় এরা নি¤œশ্রেণীর বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার ক্যারিয়ার মাত্র। ইয়াবা ব্যবসার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মিয়ানমারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওইসব বৈঠকে সীমান্তের ওপারে কোন কোন স্থানে ইয়াবা ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে তাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং ওইসব মাদক উৎপাদনকারী ফ্যাক্টরি বন্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধও করা হয়েছে বারে বারে। কিন্তু তথ্য রয়েছে, মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত প্রভাবশালীরাই এসব ফ্যাক্টরির মালিকানার সঙ্গে জড়িত। ফলে প্রতিষ্ঠিত ওইসব ফ্যাক্টরি কখনও বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়নি মিয়ানমার সরকার। এদিকে ইয়াবা সেবনকারীদের সংখ্যা দেশে যেহারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। ফলে চাহিদার বিপরীতে ব্যাপক মুনাফা লাভের উদ্দেশে বাংলাদেশে ঢুকছে চালানে চালানে ইয়াবা ট্যাবলেট। র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনীসহ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন পথে আসতে থাকা ইয়াবার চালান যা ধরা পড়ছে তা বিপুল পরিমাণ চালানের ক্ষুদ্র একটি অংশ বলেই ধারণা পাওয়া যায়। এসব ঘটনা নিয়ে ইয়াবা পাচার ও ব্যবসার সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে জড়িতদের নামও এসেছে প্রচার মাধ্যমে। এসব নিয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আলোচনাও কম হয়নি। কিন্তু পরিস্থিতির কোন উন্নতি দৃশ্যমান নয়। শেষ পর্যন্ত খোদ প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি অবহিত হয়ে কক্সবাজারে গত শনিবার প্রকাশ্যে ইয়াবা ব্যবসার বিরুদ্ধে যে হুঁশিয়ারি প্রদান করে গেছেন তা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাঝে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। পুরনো ফাইল উল্টিয়ে দেখা হচ্ছে কাদের নাম রয়েছে এ তালিকায়। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, উক্ত তালিকায় যাদের নাম রয়েছে এরা অত্যন্ত ক্ষমতাধর এবং জনপ্রতিনিধিও বটে। এছাড়া প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সাহস রাখে না। অতীতের ঘটনাবলী তা-ই প্রমাণ করে। তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশাসনের বহু কর্মকর্তা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তৎপর হওয়ার পরও রহস্যজনকভাবে থমকে যেতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ইয়াবাবিরোধী ঘোষণার পর এখন সকল মহলে আশার সঞ্চার হয়েছে, হয়ত বা এবার ইয়াবার আগ্রাসন থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। তবে উৎকণ্ঠাও রয়েছে, বিশাল সীমান্ত এলাকা দিয়ে ইয়াবার চালান যেভাবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে চলে আসে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে লজিস্টিক সাপোর্ট এর বিষয় নিয়ে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক পথে তল্লাশি চালিয়ে যেসব চালান ধরা পড়ে তার চেয়ে শতগুণ বেশি চালান আসে সমুদ্র পথে। হাজার হাজার বিভিন্ন ধরনের নৌযান অভ্যন্তরে ইয়াবার চালান চলে আসে ট্রানজিট পয়েন্ট চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ কড়া নজরদারি রাখার পরও প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পয়েন্টে ইয়াবার চালান ধরা পড়ার বিষয়টি দৃশ্যমান। কিন্তু এসব চালানের বড় একটি অংশ এখন সরাসরি সমুদ্র এবং নৌপথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যাচ্ছে বলেও তথ্য রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানানো হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রণীত ইয়াবা চোরাচালানিদের তালিকাটি নতুনভাবে প্রণীত হলে তা আরও দীর্ঘ হবে। কারণ এ ব্যবসায় সহজেই বিত্তের পাহাড় গড়া যায়। ইয়াবা চালান সাধারণত বড় আকৃতির হয় না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রভাবে ইয়াবা ট্যাবলেট অত্যন্ত সুচারুরূপে প্যাকেটজাত করে পৌঁছানো হয় গন্তব্যে। চট্টগ্রামে যেসব ইয়াবার চালান এ পর্যন্ত ধরা পড়েছে এর সবই প্যাকেটজাত। কখনও হাজার, কখনও লাখ, কখনও কোটি পিস ইয়াবার চালান অহরহ আসছে দিনের পর দিন। এমনও তথ্য রয়েছে, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে আঁতাত করে কিছু চালান ইচ্ছা করেই আটক করার সুযোগ দেয়। পক্ষান্তরে, একাধিক চালান পাচার করে দেয়ার সুযোগ করে নেয়া হয়।
×