ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ছবি কিনে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান

হাওড়ে সব হারানো মানুষের কান্না শিল্পীর রং তুলিতে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৪ মে ২০১৭

হাওড়ে সব হারানো মানুষের  কান্না শিল্পীর রং তুলিতে

মোরসালিন মিজান ॥ অপরূপ সৌন্দর্যের হাওড়। এই সৌন্দর্যের কথা খুব কম মানুষই জানেন। কিন্তু এখন হাওড় নিয়ে অন্য আলোচনা। টানা বর্ষণ আর পাহাড়ী ঢলে ভেঙ্গে গেছে ফসল রক্ষা বাঁধ। পাকা প্রায় ধান তলিয়ে গেছে পানির নিচে। সাত সাতটি জেলার কৃষক সর্বস্বান্ত। কিছুদিন আগেও নতুন ফসল ঘরে তোলার স্বপ্নে বিভোর ছিল যে চোখ আজ সেখানে অশ্রু শুধু। সিলেট সুনামগঞ্জ হবিগঞ্জ নেত্রকোনার কৃষকের কান্না ছুঁয়ে দিয়েছে রাজধানীবাসীকেও। শিল্পীরা আরও বেশি স্পর্শকাতর। হাওড়ের সব হারানো মানুষের পাশে রং তুলি হাতে দাঁড়িয়েছেন তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে সমবেত হয়ে ছবি আঁকছেন। বিক্রি থেকে যে টাকা আসবে তা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের হাতে তুলে দেয়া হবে। মানবিক উদ্যোগটি গ্রহণ করেন দুর্গত এলাকার কয়েকজন শিক্ষার্থী। আগামীর শিল্পীরা সবাই চারুকলা অনুষদের ছাত্র। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতিদিনই আসছেন অন্য শিক্ষার্থীরা। অনুষদের বর্তমান শিক্ষক ও বরেণ্য শিল্পীরাও এসে ছবি আঁকছেন। ২৭ এপ্রিল শুরুটা করে দিয়ে গিয়েছিলেন চারুকলার শিক্ষক শিল্পী আবুল বারক আলভী। নিজে ছবি এঁকে উদ্বোধন করেছিলেন আয়োজনের। একাত্মতা ঘোষণা করতে উপস্থিত হয়েছিলেন অনুষদের বর্তমান ডিন শিল্পী নিসার হোসেন। এর পর থেকে প্রতিদিন প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলছে ছবি আঁকার কাজ। নিজের ভেতরের তাগিত থেকেই অনেকে ছবি আঁকতে আসছেন। বুধবার বিকেলে চারুকলা অনুষদে গিয়ে দেখা যায়, জয়নুল গ্যালারির সামনের ফাঁকা জায়গাটিতে কয়েকটি টেবিল পাতা হয়েছে। পাশাপাশি রাখা টেবিলের ওপর ঝুঁকে ছবি আঁকছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। কিছু সময় পর যোগ দেন অনুষদের শিক্ষক শিল্পী গুপু ত্রিবেদী। তার সামনে আয়োজকরা একটি সাদা কাগজ বিছিয়ে দেন। সেদিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভেবে নেন শিল্পী। পরে কালো মার্কার দিয়ে আউটলাইন টানেন। মোটা ব্রাশ চালান। এভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে যে প্রতিকৃতি সেখানে সৌম্য শান্ত চেহারার রবীন্দ্রনাথ! এর কয়েক মিনিট পর বাংলার বাউল একতারা হাতে সুর তুলেন যেন। উজ্জ্বল রঙে শিল্পী আঁকেন কল্পনার নারীকে। ছবি আঁকার ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় গুপু ত্রিবেদীর সঙ্গে। অন্য সময় ছবি আঁকেন। এখনও আঁকছেন। আজকের আঁকার পেছনে কোন্ বোধটি কাজ করছে? উত্তর দিতে ভূপেন হাজারিকার কালজয়ী সেই গানের আশ্রয় নিলেন। বললেন, ওই যে লাইন, মাথায় ওটাই ঘুরছে। মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না...। তিনি যোগ করেন, মানুষ বিপদে পরলে তার পাশে মানুষ হয়ে আমাদের দাঁড়াতে হবে। হবেই। রং তুলি আমার শক্তি। আমি তা-ই নিয়ে চেষ্টা করছি কিছু করার। এর যে আনন্দ সে তো বলে বোঝানো যাবে না। ছবি আঁকা শেষ হতেই সেটি ওঠে যাচ্ছিল দেয়ালে। সেদিকে তাকিয়ে দেখা গেল, একশ’র মতো ওয়াটার কালার। ড্রইয়িং। নানা রকম ভাবনা থেকে ছবি আঁকা হয়েছে। অধিকাংশ শিল্পীই হাওড় দেখেননি। তাঁদের আঁকা প্রকৃতি, গাঁয়ের আল পথ, নদী নৌকোই যেন বলছিল হাওড়ের কথা। ছবি আঁকার জন্য যারা চারুকলায় আসতে পারছেন না তারা আবার নিজের আঁকা ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছেন বিক্রির জন্য। খ্যাতিমান শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী, চারুকলা থেকে পাস করা অভিনেত্রী বিপাশা হায়াত ছবি পাঠিয়েছেন। আয়োজকরা নিজেরা যোগাযোগ করেও ছবি সংগ্রহ করছেন। উদ্যোক্তাদের একজন ড্রইং এ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগের শিক্ষার্থী মৃণাল বণিক। সুনামগঞ্জের ছেলে। বললেন, আমরা অনেক দূরে এখনও। কিন্তু কৃষকের কান্নাটা বুকে বাজছে। তাই উদ্যোগটা নিয়েছি। এখন এটি সবার। সবাই মিলে ছবি আঁকছি। সংগ্রহ করছি। ছবি বিক্রির অর্থ খুব বেশি হয়ত হবে না। কিন্তু যা হবে তা-ই নিয়ে হাওড়বাসীর পাশে দাঁড়াতে চান বলে জানান তিনি। মহৎ মানবিক এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে শনিবার পর্যন্ত। একটি ছবি কিনে সকলকে হাওড়বাসীর পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন শিল্পীরা।
×