ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চুলার পাশে বসিয়ে ৭ সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করেছেন মা রওশন

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ৩০ এপ্রিল ২০১৭

চুলার পাশে বসিয়ে ৭ সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করেছেন মা রওশন

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ সংগ্রামী, অপ্রতিরোধ্য নারীর প্রতীকী নাম জয়িতা। নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মূর্ত প্রতীক জয়িতা। কেবল নিজের অদম্য ইচ্ছাকে সম্বল করে চরম প্রতিকূলতাকে জয় করে জয়িতারা তণমূল থেকে সবার অলক্ষ্যে সমাজে নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন। সরকারের মহিলাবিষয়ক অধিদফতর এই জয়িতাদের খুঁজে বের করার উদ্যোগটি গ্রহণ করে ২০১৪ সালে। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে তৃণমূলে সফল নারীদের সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে জয়িতা অন্বেষণের মাধ্যমে। ‘জয়িতা অণ্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক কার্যক্রমের অধীনে ’১৬ সালের ‘জয়িতা’ হিসেবে পাঁচটি ক্যাটাগরিতে সাফল্যের আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিত করেছেন এমন পাঁচ নারীকে জয়িতা হিসেবে নির্বাচিত করে সংবর্ধনা ও সম্মাননা দেয়া হয়েছে। শনিবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে এ কার্যক্রমের অধীনে ঢাকা বিভাগের পাঁচ শ্রেষ্ঠ জয়িতাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় এর আয়োজন করে। ঢাকা বিভাগের সব জেলা হতে প্যানেল বিচারকের মাধ্যমে তাদের নির্বাচিত করা হয়। অর্থনৈতিকভাবে, শিক্ষা ও চাকরিক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন, সফল জননী, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা ও সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যেসব নারী তাদের মধ্য থেকে প্রাথমিকভাবে ৬৫ থেকে ১০ জনকে নির্বাচিত করা হয়। এর পর পাঁচ ক্যাটাগরিতে শ্রেষ্ঠ পাঁচ জয়িতাকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়। শনিবার তাদের সংবর্ধনা, সনদপত্র ও ক্রেস্ট প্রদান করা হয়েছে। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন যে নারী ফিরোজা খাতুন সাভার উপজেলার যাদুরচর গ্রামের মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই সংসারের অনেক দায়িত্ব ছিল তার ওপর। বাবার ইচ্ছা ছিল বড় সন্তানকে লেখাপড়া শেখাবে। কিন্তু সংসারের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে তার আর লেখাপড়া করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। গৃহস্থালি ও বাবার হালচাষের কাজে সব সময় সে লিপ্ত ছিল। যুদ্ধের প্রায় আট বছর পূর্বে তার বাবার উপস্থিতিতে এক গরিবের ঘরে বিয়ে হয় তার। সেখানে তার সুখের সংসার ছিল। তার ঘরে জন্ম নিল একটি পুত্রসন্তান। ১৯৭১ সালে ফিরোজা বেগমের কোলে দেড় বছরের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধকালে পাক হানাদার বাহিনী এসে তাদের বাড়ি দখল করে, বাড়িতে আগুন লাগিয়ে নিঃস্ব করে দেয়। তার সন্তানকে হানাদার বাহিনীর পাঁচ পাকি-পষ- ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলে। তাদের এই বর্বরতার দৃশ্য দেখে চিৎকার করলে হানাদার বাহিনী জোর করে তাকে তুলে নিয়ে যায় তাদের ক্যাম্পে। সেখানে ক্যাম্পে ক্যাম্পে হানাদার বাহিনী তার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে যশোরের শার্শা থানায় বাঘাছাড়া গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প থেকে তাকে উদ্ধার করল। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় তিনি নিয়োজিত ছিলেন। যখন তিনি নিজ গ্রামে ফিরে আসেন তখন গ্রামের মানুষ এমনকি তার স্বামীও তাকে ঘরে তোলেনি, গ্রামে থাকতে দেয়নি। পরবর্তীতে আগারগাঁও বস্তিতে বঙ্গবন্ধু তাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলে সেখানে তিনি সব বীরাঙ্গনার সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন। বর্তমানে তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের স্পেশাল আয়া হিসাবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি হেমায়েতপুরে মেয়ে ও জামাই, নাতি-নাতনি নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করছেন। সফল জননী প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ক্লাসে বরাবরই প্রথম স্থান অধিকার করতেন রওশন আরা। মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় নারীশিক্ষার পশ্চাৎপদতা এবং বয়সে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি বয়সের সৎ ভাইদের অর্থনৈতিক ও শারীরিক নির্যাতনের কারণে পঞ্চম শ্রেণীর বেশি পড়ার সুযোগ পাননি টাঙ্গাইলের কেন্দুয়া গ্রামের এ মেয়েটি। এরপরই অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায় তার। একে একে তার গর্ভে জন্ম নেয় সাত সন্তান। সময়ের অভাবে রান্নার সময় লাকড়ির চুলার পাশে বসিয়ে প্রত্যেক সন্তানকেই পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত হাতে-কলমে প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছেন এই সফল জননী। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করেও তার সাত সন্তানের মধ্যে চারজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসহ মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেছে। বাকি দুই সন্তানও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। সেসময় কেন্দুয়া গ্রাম ও এর আশপাশের এলাকায় শিক্ষিতের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। এই বিরূপ সামাজিক অবস্থা থেকে রওশন আরা বেগম ছেলেমেয়েদের তুলে এসেছেন। তার পাঁচ ছেলে এবং দুই মেয়ের নাম : সুলতান আহাম্মদ, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান কার্যালয়, মতিঝিল, ঢাকা; মোঃ সফিকুল ইসলাম, জেলা ও দায়রা জজ, জেলা জজ আদালত, মৌলভীবাজার; মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, এক্সিকিউটিভ অফিসার, সোনালী ব্যাংক, স্থানীয় কার্যালয় মতিঝিল, ঢাকা; মোহাম্মদ আল মামুন, উপসচিব (অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ), বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন সচিবালয়; মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, উপপরিচালক, ডিপার্টমেন্ট অব অফ-সাইড সুপারভিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক প্রধান কার্যালয়, ঢাকা; বিলকিছ আজিজ, গৃহিণী; লায়লা আঞ্জুমান, স্কোয়াড্রন লিডার, বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি বঙ্গবন্ধু কুর্মিটোলা, ঢাকা। সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যিনি মানুষের তরে মানুষ আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। এই মূলমন্ত্র নিয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও কোহিনূর আক্তার জুঁই সমাজের মানুষের কল্যাণে কাজ করে চলছেন। সাভার উপজেলার যাদুর চর বিলামলিয়া গ্রামের কন্যা জুঁই ৭ বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে দুই চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন। ঢাকার ডাক্তার জানান তার চোখের রস শুকিয়ে গেছে। তিনি বারো বছর বয়সে তার ছোট বোনকে নিয়ে কাজের সন্ধানে আজিমপুরে আসেন। সেখানে এক বিদেশিনী মিস বিক্যামনেলের সঙ্গে তার পরিচয়, যিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মহিলাদের নিয়ে কাজ করেন। বিক্যামনেল তাকে অন্ধদের স্কুলে বিনা বেতনে ভর্তি করে দেন। তিনি মিরপুর গার্লস ল্যাবরেটরি ইনস্টিটিউট থেকে ১৯৮৬ সালে এস.এস.সি পাস করেন। এরপর মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ থেকে ১৯৮৮সালে এইচ.এস.সি ও ১৯৯৪ সালে ডিগ্রী পাস করেন। ১৯৯৮ সালে মিরপুর বাংলা কলেজ থেকে এম.এ পরীক্ষা দেন। তিনি মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের আওতাধীন অন্ধ মহিলা সমিতি হিসাবে একটি সমিতি গঠন করেন। সেখানে তিনি অন্ধদের নিয়ে কাজ করেন। তিনি অন্ধদের জন্য একটি হাসপাতাল তৈরি করেছেন। হাসপাতালের নাম ‘কোহিনূর অন্ধ হাসপাতাল’। সরকারী লিজকৃত সম্পত্তিতে তিনি এই হাসপাতালটি গড়ে তোলেন। তিনি সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান পেয়ে সেই অনুদান দিয়ে হাসপাতালটি পরিচালনা করেন। তার লেখা বইও বাজারে বের হয়েছে। তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে কবিতা ও গান লিখছেন। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী বৃষ্টি খাতুন নরসিংদী জেলার দাসপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়েন তখন তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মা অন্য মানুষের বাড়িতে তাঁতের কাজ করে কোনরকমে সংসার চালাতেন। মায়ের কাজের পাশাপাশি নিজে কাজ করতেন এবং পড়াশোনাও করতেন। তার স্বপ্ন ছিল ভবিষ্যতে পুলিশের চাকরি করবেন। কিন্তু অভাবের সংসারে কোনরকমে অষ্টম শ্রেণী পাসের পর ২০০৩ সালে তার মা তাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেন। স্বামীর উপার্জনের অর্থ দিয়ে সংসার চালানো অসম্ভব দেখে পাশের বাড়ির একজনের কাছ থেকে ভাড়া হিসেবে একটি সেলাই মেশিন নিয়ে অন্যের কাপড় সেলাই করে উপার্জন শুরু করেন। পরবর্তীতে এনজিও থেকে বিশ হাজার টাকা কিস্তি নিয়ে দশ হাজার টাকা দিয়ে একটি মেশিন ক্রয় করে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে বৃষ্টি খাতুনের তিনটি কারখানা আছে। তার কারখানায় ১০০ মহিলা শ্রমিক আছে। বর্তমানে তার ব্যবসার পুঁজি আছে এক কোটি টাকা ও জায়গা আছে প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যমানের। নিজের ব্যবসার পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজেও অবদান রাখতে চান তিনি। শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী যে নারী সীমাহীন প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের অদম্য ইচ্ছা, চেষ্টা ও শ্রম দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন ধামরাই উপজেলার কালিদাসপট্টি গ্রামের মেয়ে আমিনা ফাহমিদা খানম। বাবা ছিলেন গরিব কৃষক। অন্যের জমিতে চাষ করে সংসার চালাতেন। মাত্র দেড় বছর বয়সেই আমিনা পোলিও রোগে আক্রান্ত হন এবং আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে চিকিৎসার অভাবে শারীরিক পঙ্গুত্ব বরণ করেন। পাঁচ বছর বয়সে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। স্কুল বাড়ি থেকে দূরে হওয়ায় এবং স্কুলের স্বাভাবিক ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রতিবন্ধী শিশু হিসেবে চলাফেরা করা ছিল তার জন্য অত্যন্ত কষ্টকর। তিনি নবম শ্রেণী হতে টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতেন। দুর্বল দুটি পা নিয়ে তিনি জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল। হাঁটতে হাঁটতে কখনওবা তার পায়ে ঘা হয়ে গেছে। প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ইডেন মহিলা কলেজ হতে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স করেন। বর্তমানে তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কর্মরত। ভবিষ্যতে তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য কাজ করতে চান। জয়িতা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় নারীকে মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করে তাদের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে চলেছে। সরকারের বিভিন্ন নারীবান্ধব উদ্যোগের কারণে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের ফলে সারা বিশ্বে দেশের নারীর উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়ন নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের সকল নারী জয়িতা। আমরা যাদের নির্বাচিত করে সম্মাননা প্রদান করছি তাদের দেখে উৎসাহিত হবে অন্য নারীরা। ঢাকা বিভাগের কমিশনার হেলালুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি রেবেকা মমিন, মহাপরিচালক সাহিন আহমেদ চৌধুরী ও সচিব নাছিমা বেগম।
×