ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রুত বিষয়টির রহস্য উদ্ঘাটন দাবি বিশেষজ্ঞদের

হাওড়ে মাছসহ জলজ প্রাণীর মৃত্যুর কারণ কি ইউরেনিয়াম?

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২২ এপ্রিল ২০১৭

হাওড়ে মাছসহ জলজ প্রাণীর মৃত্যুর কারণ  কি ইউরেনিয়াম?

শাহীন রহমান ॥ দেশের হাওড়াঞ্চলে মার্চ-এপ্রিলের এই অসময়ে বন্যা এবার নতুন নয়। প্রতি দুই-তিন বছর পর পরই এমন আগাম ব্যাপক ফসলহানির ঘটনা ঘটে। কিন্তু আগে কখনও মাছ, ব্যাঙসহ জলজপ্রাণীর এমন মৃত্যু ঘটনা ঘটতে দেখা যায়নি। এবার ফসলহানির সঙ্গে সঙ্গে মাছসহ জলজ প্রাণীর এমন ঘটনা জনমনে ব্যাপক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তারা বলছেন, আগে কখনও মাছের মড়ক দেখা না গেলেও এবার তাহলে কেন মাছসহ জলজপ্রাণীর মৃত্যু ঘটছে। তবে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করছেন বিভিন্ন কারণে পানিতে কেমিক্যাল দূষণ ছড়িয়ে পড়া বা অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণেও এটি হতে পারে। তবে তা ইউরেনিয়াম দূষণ কিনা নিশ্চিত না হয়ে বলা ঠিক হবে না। তারা বলেন এই মুহূর্তে, জলজপ্রাণীর মৃত্যুর সঠিক কারণ না জানা গেলেও তারা বলছেন সরকারের উচিত হবে বিষয়টি উদ্ঘাটন করে ব্যবস্থা নেয়া। তবে তারা উল্লেখ করেন মাছসহ জলজপ্রাণীর মৃত্যুর কারণ বের করা সরকারের জন্য কঠিন কিছু নয়। শুধুমাত্র মরা প্রাণীগুলো আনবিক শক্তি কমিশনে নমুনা এনে পরীক্ষা করলেই এর রহস্য বের হয়ে আসবে। এতে যদি প্রমাণিত হয় যে ইউরেনিয়ামের কারণে এমন ঘটেছে তাহলে তখনই সরকার ভারত সরকারকে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানাতে পারে। তবে প্রমাণ ছাড়া এখনি কিছু বলা যাবে না। ইউরেনিয়ামের কারণে হাওড় এলাকায় মাছ ব্যাঙ হাঁসসহ জলজপ্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে। তারা বলেন, বন্যার আগের হাওড়াঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ ধান চাষ করা হয়। ধান চাষে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়েছে। এখন উজান থেকে পাহাড়ী জলোচ্ছ্বাস নেমে আসায় এসব রাসায়নিক পদার্থ সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া ধান গাছ পচে পানিতে এ্যামোননিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হতে পারে। এসব কারণও হাওড় এলাকায় মাছের মৃত্যুর কারণ ঘটতে পারে। তবে সঠিক কি কারণে এমনটি ঘটেছে তা উদ্ঘাটন করে জনগণকে জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টি নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও বিষেশষজ্ঞরা বলছেন কেমিক্যাল বা অন্য কোন দূষণের কারণেই এটি ঘটেছে। অথবা এমন কোন ঘটনা ঘটেছে তার কারণে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ অনেক কমে গিয়ে মাছের মুত্যৃ ঘটেছে। তারা বলেন, দূষণ ছাড়া এ ধরনের মৃত্যুর ঘটতে পারে না। কি কারণে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বা দেশী মাছের আধার বলে পরিচিত হাওড়ে মাছের এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে তার কারণ অনুসন্ধান করা জরুরী। তবে এখন পর্যন্ত কেউ নিশ্চিত হতে পারেনি জলচর এসব প্রাণীর মৃত্যুর কারণ কি? নদী, পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, হাওড়াঞ্চলের পানিতে ধানগাছ বা অন্য কোন পদার্থ পচে নিয়ে গ্যাসের সৃষ্টি হয়ে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন এর পেছনের কি কারণ রয়েছে তা অবশ্যই গবেষণাগারে পরীক্ষা করে বের করা উচিত। তিনি বলেন এখন পর্যন্ত সেখানে না গিয়ে বলা যাচ্ছে না কি কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে। তবে বিভিন্ন কারণে হাওড়ের পানি পচে গ্যাসের সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে এমনি হতে পারে উল্লেখ করেন তিনি। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলছেন, দূষণের কারণে হাওড় এলাকায় মাছ ব্যাঙ ও হাঁসসহ অন্যান্য জলজপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। এটা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। তিনি বলেন অতীতে একাধিকবার হাওড় এলাকায় অকাল বা অসময়ে বন্যার ঘটনা ঘটেছে। তখন কোন মাছের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, কেমিক্যাল দূষণের কারণে এ ধরনের মাছে মড়ক লাগা সম্ভব। এছাড়া এমন কোন দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে যার কারণে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ অনেক কমে গিয়ে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তবে যাই ঘটুক না কেন এর পেছনে অবশ্যই কোন দূষণের ঘটনা ঘটেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। পরিবেশ নিয়ে কাজ করছেন বাপার সাধারণ সম্পাদক ডাঃ আব্দুল মতিন বলেন, হাওড়াঞ্চলে মাছ ব্যাঙ ও হাঁসসহ জলজপ্রাণীর মৃত্যুর কারণ এখনি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, দূষণ থেকে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তবে তিনি জোর দেন এসব প্রাণীর মৃত্যুর সঠিক কারণ উদ্ঘাটনের। বলেন, সরকারের উচিত হবে মরা প্রাণীগুলো আনবিক শক্তি কমিশনের নিয়ে পরীক্ষা করালেও আসল কারণ বেরিয়ে আসবে। তিনি বলেন হাওড় অঞ্চলে বা মেঘালয়ে ওই এলাকায় ইউরেনিয়ামের মতো গ্যাস হয় তো থাকতে পারে। কিন্তু এ ধরনের একটি গুরুতত্বপূর্ণ পদার্থ উত্তোলনের কোন ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ গর্ত করে উত্তোলন করতে পারে না। উভয় দেশের সচেতনার বিষয়। তাই প্রমাণ ছাড়া বলা যাবে না যে ইউরেনিয়াম দূষণের কারণে হাওড়াঞ্চলের প্রাণীর মড়ক লাগছে। তিনি বলেন, যেহেতু বিষয়টি সামনে এসেছে তাই সরকারের উচিত হবে দ্রুত পরীক্ষার মাধ্যমে আসল কারণ উদ্ঘাটনের ব্যবস্থা নেয়া। প্রাণী বিজ্ঞানীরা বলছেন, হাওড়াঞ্চলের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ অস্বাভাবিকহারে কমে যাওয়ায় মাছের মড়ক দেখা দিয়েছে। মাছের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রতি এক লাখ লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ থাকতে হবে ৫ থেকে ৮ মিলিলিটার। অক্সিনেজের পরিমাণ ৪ ভাগের নিচে কমে এলে জলজপ্রাণীর মৃত্যুর কারণ ঘটতে পারে। তারা বলেন, এছাড়াও এই এলাকায় মাছের মৃত্যুর অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ধান গাছে পচনের ফলে উৎপাদিত এ্যামোনিয়া গ্যাস, ধানের পানিতে আসা অতিমাত্রায় পলিমাটিসহ অন্যান্য আবর্জনা এবং মাছের খাদ্য সংকটের কারণেও এমনটি হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন অতিবৃষ্টি বা পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যার ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে সিলেট অঞ্চলে হাওড়ের ফসল নষ্ট হওয়ার খবর নতুন নয়। তবে এমন বন্যার পানিতে মাছ, ব্যাঙ ও হাঁসের মৃত্যুর ঘটনাটি জনমনে বেশ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তাই এর যথাযথ কারণ খোঁজা জরুরী। গত মার্চে আকস্মিক বৃষ্টি ও মেঘালয় থেকে আসা পাহাড়ী ঢলের ফলে সুনামগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের হাওড় এলাকা প্লাবিত হওয়ায় সেই সব অঞ্চলে ধান নষ্ট হয়। চাষীদের ফসল নষ্ট হওয়ার পর হাওড়ের মাছ, ব্যাঙ এবং হাঁসের মড়ক তাদের আতঙ্ক বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। তবে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে রয়েছে ওপেনপিট ইউরেনিয়াম খনি। গত ডিসেম্বরে মেঘালয়ের স্থানীয় খাসি জনগোষ্ঠী সেই এলাকার রানিকর নদীর পানির রং নীল থেকে বদলে সবুজ হয়ে যেতে দেখেন। এর প্রেক্ষিতে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি খাসি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (কেএসইউ) একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। সংগঠনটি সেই নদীর মাছ মরে যাওয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেন। এমনকি, জলজপ্রাণীহীন নদীটি এখন মৃত প্রায় বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। খাসি নেতা মারকনি থঙনি সাংবাদিকদের বলেন, সন্দেহ ইউরেনিয়াম খনি খননের ফলে এর থেকে নিঃসৃত ইউরেনিয়াম পানিতে মিশে নদীর পানির রং বদলে গেছে এবং নদীর মাছ মরে গেছে। তবে মেঘালয় রাজ্য সরকার বলছে তাদের দেশে মাছ মারা যাওয়ার ঘটনাটির সঙ্গে ইউরেনিয়াম খনির কোন সম্পর্ক নেই। রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী বিন্দো এম লানোঙ বলেন, যদি তাই হতো তাহলে অন্যান্য জলজপ্রাণীও মারা যেত। এই নদীটি সুনামগঞ্জের তাহেরপুর উপজেলার জাদুকাটা নদী থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশের হাওড়াঞ্চলের মাছসহ জলজপ্রাণীর মৃত্যুর কারণ কি ইউরেনিয়াম না অন্য কিছু তা সরকারকে অবশ্যই দ্রুত উদ্ঘাটন করা উচিত।
×