ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণের বৈশাখ

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১০ এপ্রিল ২০১৭

প্রাণের বৈশাখ

বৈশাখ পুরাতনের বিদায় ও নবীন বরণ মাস। ঝড় নিয়ে আসা বৈশাখ বিদায় হয় ধবংসের সহযাত্রী হয়ে। বৈশাখ সাহসী, ক্ষ্যাপা, বৈরী, অশান্ত, অসীম, মারমুখো, নির্দয়। কিন্তু তার সৃজনক্ষমতা শিল্পীর সুনিপুন সৌন্দর্যকেও হার মানায়, তার নতুন করার পালা তার নবায়নী ধারা প্রকৃতির সকল পারক্ষমকে হার মানায়। বৈশাখ পুরনোর বিদায় ও নবীন বরণ মাস। ঝড় নিয়ে আসা বৈশাখ বিদায় হয় ধ্বংসের সহযাত্রী হয়ে। বৈশাখ সাহসী, ক্ষ্যাপা, বৈরী, অশান্ত, অসীম, মারমুখো, নির্দয়। কিন্তু তার সৃজনক্ষমতা শিল্পীর সুনিপণ সৌন্দর্যকেও হার মানায়, তার নতুন করার পালা তার নবায়নী ধারা প্রকৃতির সকল পারক্ষমকে হার মানায়। কবি মনে আলোড়ন জাগাতে আসে বৈশাখের বার্তা। প্রেমিকের অন্তর সাধনায় বিশ্বাস ও প্রেমের মাত্রাযোগ ঘটায় এ বৈশাখ। চৈত্রের দাবদাহে জীবন যখন মরুপ্রায়, রোদে পুড়ে কাদামাটি ঠনঠনে, তখনই বৈশাখ আনে ঝড়, বিজলীর ছোড়া পুঞ্জীভূত শিলা থেকে ঘূর্ণির শঠতা। কর্মব্যস্ত ঢাকা শহরও পহেলা বৈশাখে যেন সমস্ত কিছুকে ছুটি দিয়ে একসঙ্গে মিলবে এক বৈশাখী মোহনায়। বৈশাখের এ আগমন উদ্বেলিত করবে সবাইকে। ব্যর্থতার সবটুকু গ্লানিকে দুরে সরিয়ে আনন্দ উৎসবের সঙ্গে প্রার্থনা করবে নতুন দিনের, নতুন স্বপ্ন রেখার। চৈত্র সংক্রান্তি : পহেলা বৈশাখের উৎসব শুরু হয়ে থাকে মূলত চৈত্র সংক্রান্তি দিয়েই। অর্থাৎ বছরের শেষ মাসের শেষ দিনে পালন করা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। এ দিনে বিদায় জানানো হয় পূরণ বছরকে। আর তার সঙ্গে মঙ্গল কামনা করা হয় নতুন দিনের। এক কালে চৈত্র সংক্রান্তি শুধু গ্রামগঞ্জেই ছিল। কিন্তু এখন আর তা শুধু গ্রামেই সীমাবদ্ধ নেই। শহরেও পালন করা হয় এ উৎসব। বিশেষ করে ঢাকায় তো চৈত্র সংক্রান্তি দিয়েছে সংস্কৃতিতে এক নতুন উৎসবের মাত্রা। নতুন ভোরে নতুন বর্ষ উদযাপন: এরপরের দিন বৈশাখের ঠিক প্রথম প্রহরে উদযাপন করা হয় বাংলা নববর্ষের। দিনের সূর্য উদিত হতেই শুরু হয়ে যায় নববর্ষ। কারণ বাঙালী রীতিতে দিন শুরু হয়ে থাকে সূর্য ওঠার পর থেকেই। আর রবী ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় উৎসব। রাজধানীতে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রমনার বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় বর্ষবরণের অনুষ্ঠানমালা। ছায়ানটের অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু হলেও বর্ষবরণের উৎসব ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকায়। লাখো মানুষের জনস্রোত মিশে যায় জীবনের উৎসবে। বাংলা নববর্ষের কথকতা : মোগল সম্রাট আকবর। ভারতবর্ষের পরাক্রমশালী এই সম্রাট নানা কারণেই ইতিহাসেবিখ্যাত হয়ে আছেন। মুঘল সাম্রাজের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ হুমায়ুনের মত্যুর পর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই সাম্রাজ্যের শাসনভার নেন জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। তিনি সিংহাসনে বসার পরই আগ্রা ও দিল্লী দখল করে নেন আদিল শাহ শূরের সেনাপতি হিমু। আকবরকে আক্রমণ করতে আসেন হিমু। বৈরাম খানকে সঙ্গে নিয়ে হিমুর মোকাবেলায় নামেন আকবর। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমু পরাজিত হন সম্রাট আকবরের কাছে। তার এই বিজয় উদযাপন করতে এবং আরও সুবিধাজনক উপায়ে খাজনা আদায় করতে সম্রাট আকবর ইলাহী সন চালু করার ঘোষণা দেন। মুঘল আমলে রাজারা খাজনা আদায় করতেন চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী। চাঁদের উদয় অস্তের হিসাব করে গোনা হয় চন্দ্রবর্ষ। যেমন, আরবি হিজরী সন হলো চন্দ্রবর্ষ। কিন্তু চন্দ্রবর্ষ প্রতিবছর ১১ দিন করে এগিয়ে যেত যা কৃষকের খাজনা দেয়া ও ফসল তোলার মধ্যে সমস্যা তৈরি করত। এতে কৃষকের খাজনা দেয়া কঠিন ব্যাপার হয়ে যেত। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। তখন ব্রিটিশ আমল। সবার মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী চেতনা গড়ে উঠছে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর আবার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের খবর পাওয়া যায় ১৯৩৮ সালে। তবে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়েছিল বলে জানা যায় না। রমনার বটমূলে বৈশাখী আয়োজন : স্বাধীনতার পূর্বে পাকিস্তানী শাসকরা বাঙালী সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার প্রতিবাদে ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে (১৯৬৫ সালে) রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট। রবি ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মধ্য দিয়ে স্বাগত জানায় বৈশাখকে। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। ১৯৭২ সালের পর থেকেই মূলত এটি জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃত হয়। ১৯৮০ সালে এই উৎসবকে আরও এক ধাপ বাড়তি রঙের ছোঁয়া দিতে প্রচলন হয়েছে বৈশাখী শোভাযাত্রার। এ ছাড়াও এই দিনে বাংলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন, নজরুল একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনসহ অনেক প্রতিষ্ঠানই উদযাপন করে পহেলা বৈশাখ। ঐতিহ্যকে ঘিরে মেলা : বাঙালী বরাবরই উৎসবপ্রিয় এক জাতি। যে কোন উৎসবের সঙ্গে মেলার আয়োজন করা বাঙালীর ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি। এক সময় নবান্নের উৎসবে মেলা বসানো হতো গ্রামে গ্রামে। মেলাকে ঘিরেই উৎসবের মূল আকর্ষণ ছিল। আর সে ধারা এখনও আছে গ্রাম কিংবা শহরেও। মেলা আর বাঙালীর সঙ্গে পহেলা বৈশাখেরও আছে এক নিবিড় ঘনিষ্ঠতা। এ দিনে হাটে-মাঠে-বন্দরে-মেলায় জড়ো হয় হাজার হাজার মানুষ। কোথাও এক বা দিনের মেলা হলেও এমনও আছে যেখানে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে এক মাসব্যাপী মেলার উৎসব আয়োজন করে। এসব মেলায় পাওয়া যায় স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব ধরনের হস্তশিল্প ও মৃৎশিল্পজাত, মানে মাটির সামগ্রী। এ ছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মেয়েদের সাজসজ্জার সামগ্রীসহ আরও কত কিছু পাওয়া যায় এই মেলায়। রকমারি লোকজ খাদ্যসামগ্রী, যেমন- চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাশা ও বিভিন্ন প্রকার মিষ্টির বৈচিত্র্যময় সমারোহ থাকে মেলায়। শুধু রকমারি জিনিস আর খাদ্যসামগ্রীই নয়। এই মেলায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনী থেকে শুরু করে নাচ-গান, পুতুল নাচ, সার্কাস, নাগরদোলা ইত্যাদিও শোভা পায়। সাম্প্রদায়িকতা আর বৈরিতাকে দূরে ঠেলে নতুন বছর হোক সমস্ত মঙ্গলের উপলক্ষ। ধর্ম-বর্ণ নির্র্বিশেষে বাঙালী মিলিত হোক এক নতুন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে। থাকবে না কোন্দল অথবা সংঘর্ষ। যেখানে থাকবে একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমস্ত কিছু মঙ্গলকে এগিয়ে নেয়া।
×