শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসম (উলফা)-কে ঘাঁটি গাড়তে যারা অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে, সেই একই মহল এখন অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে বাংলাদেশের জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোকে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) উলফাকে অর্থ, অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে, সেই একই অভিযোগের ভিত্তিতে সন্দেহের তীর এখন আইএসআইসহ বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার দিকেই। দেশের ভেতরে জামায়াত-শিবিরসহ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জঙ্গী তৎপরতায় সহায়তা করছে, যাতে দেশকে জঙ্গী রাষ্ট্রে আখ্যায়িত করা যায়। আর এ কারণেই জঙ্গী অর্থায়ন বন্ধ না হওয়ায় নতুন জঙ্গী রিক্রুট হচ্ছে, মাঝেমধ্যেই নতুন জঙ্গী আস্তানা ও জঙ্গীদের খোঁজ মিলছে। সর্বশেষ সিলেটের তিনটি জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের সময় সবকিছু পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়ে তিন জঙ্গী আস্তানার চৌদ্দজনের সবাই আত্মঘাতী হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রেই প্রশ্ন উঠেছে, জঙ্গীরা যেসব অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করছে তারা সেগুলো পাচ্ছে কোথায়? তাদের এসব সরবরাহ করছে কে? একই সঙ্গে এসব অস্ত্রশস্ত্র কেনাকাটা, বাড়িভাড়া নেয়া, জঙ্গীদের থাকা-খাওয়ার অর্থ পাঠাচ্ছে কারা? কারা সেই অর্থের যোগানদাতা? গত বছরের ১ জুলাইয়ের গুলশান হলি আর্টিজানে হামলার পর থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ সিলেটের তিনটি জঙ্গী আস্তানায় অভিযান পরিচালনায় যেসব অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে, যেগুলো জঙ্গীরা ব্যবহারের জন্যে আস্তানায় মজুদ করেছেÑ সেসবের পেছনে বিপুল অঙ্কের টাকা-পয়সার বিনিয়োগ ঘটেছে। সর্বশেষ সিলেটে জঙ্গীদের কাছে যেসব অস্ত্র এবং অন্যান্য সামগ্রী পাওয়া গেছে সেগুলোর মূল্য নির্ধারণ করলে অস্বাভাবিক উপায়ে প্রাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রের দাম স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হওয়ারই কথা।
তদন্তে দেখা গেছে, যেসব জঙ্গী এসব অপারেশন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে তাদের কেউ পিতার বাড়ি বা নিজের কোন প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আনছে না। শুধুমাত্র জঙ্গী একটি ডাক্তার পরিবার ও নিহত শীর্ষ জঙ্গী মেজর (অব) জাহিদের কিছু টাকা দান ও চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই করে কিছু অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে বলে তদন্তকারীরা দাবি করে আসছেন। কিন্তু জঙ্গীরা যেদিন নিরুদ্দেশ হয়েছে, সেদিন খুব বেশি টাকা-পয়সা নিয়ে বের হয়নি বলে তদন্তে প্রতীয়মান হয়েছে। গত মাসে চট্টগ্রামে ধৃত বা মৃত জঙ্গীদের গোটা পরিবারই অর্থবিত্তে তেমন সচ্ছল নয়, অথচ গোটা পরিবার এবং নিকটাত্মীয় পরিবার নিয়ে তারা দিব্যি বাড়িভাড়া করে থাকা, খাওয়া, সংযোগ স্থাপন, অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া ইত্যাদিতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন পড়েছে, যা পেতে তাদের কোন সমস্যা হয়নি। এমনকি তারা কেউই ব্যাংক বা কারও প্রতিষ্ঠানে হামলা করে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করছে, লুটপাট করছেÑ সেটিও তদন্তে প্রকাশ পায়নি। এতেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, দেশব্যাপী জঙ্গীদের পেছনে বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচের কোন এক বা একাধিক গোষ্ঠী রয়েছে, যারা জঙ্গীদের প্রয়োজনীয় অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহের দায়িত্ব পালন করছে। এসব অর্থ ও অস্ত্রের প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানে যদি সামান্য টানাপোড়েন পড়ত, বিঘœ ঘটতÑ তাহলে এতসব জঙ্গী আস্তানার অস্তিত্ব থাকত কি-না যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ পর্যন্ত জঙ্গী আস্তানাগুলোর যেসব ধরন-ধারণ দেখা গেছে তাতে এক ধরনের সচ্ছল অবস্থারই প্রমাণ পাওয়া গেছে। জঙ্গীরা কোথাও কুঁড়েঘর বা টিনের সাধারণ ঘর ভাড়া নিয়ে কেউ থাকেনি, বরং তারা ঢাকা বা অন্য যেসব শহরে আস্তানা গেড়েছে সর্বত্রই কোন না কোন বিল্ডিংয়ে এক বা একাধিক বাসা ভাড়া করে তারা উঠেছে। এতেই স্পষ্ট হয়, জঙ্গীদের তৎপরতার পেছনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগে কোন না কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবর্গ রয়েছে যারা জঙ্গী কর্মকা- জিইয়ে রাখতে সচেষ্ট। এর পেছনে তাদের বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিকল্পনা অবশ্যই রয়েছে, যা তারা অর্জনের জন্য তরুণ-যুবক এমনকি তাদের পরিবারকেও ব্যবহার করছে। জঙ্গীবাদ নিয়ন্ত্রণ, নির্মূল বা উপড়ে ফেলার জন্য অর্থ ও অস্ত্রের উৎস ও নেপথ্য শক্তি ও তাদের রাজনীতি উন্মোচন না হওয়ার কারণেই দেশ জঙ্গীমুক্ত হচ্ছে না।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সিলেটের জঙ্গীবিরোধী ৮০ ঘণ্টার ম্যাক্সিমাস অভিযান শেষে বলেছেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল তাদের (জঙ্গী) ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো, সেটা আমরা পারিনি। আত্মঘাতী হওয়ার কারণে জঙ্গীদের জীবিত উদ্ধারের চেষ্টা সফল হয়নি। জঙ্গীদের জীবিত ধরার ইচ্ছা ছিল, তাদের সারেন্ডার করতে বলা হয়েছিল। তারা সারেন্ডার না করে উল্টো আমাদের... আপনারা বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন অনেকবার। যখন আমরা তাদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, তখন তারা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। শক্তিশালী বিস্ফোরণের পর আমরা ভবনে ধোঁয়া উড়তে দেখেছি। তখন ধারণা হয়েছে, ভবনে আগুন ধরে গেছে। জঙ্গীরা আত্মঘাতী হয়ে নিহত হয়েছে।
তদন্তে দেখা যাচ্ছে, সিলেটসহ সাম্প্রতিক যেসব স্থানে জঙ্গীদের আস্তানার সন্ধান পাওয়ার পর অভিযানের সময়ে জঙ্গীরা আত্মঘাতী হওয়ার আগে তাদের সকল কাগজপত্র, প্রমাণাদি পুড়িয়ে ফেলছে। একদিকে আত্মঘাতী হয়ে নিহত হওয়ার ঘটনা, অপরদিকে প্রমাণাদি পুড়িয়ে ফেলায় জঙ্গীদের নিত্যনতুন তথ্যভা-ার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত হওয়া যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম ও সিলেটের আস্তানাগুলোতে জঙ্গীরা আত্মঘাতী হয়ে নিহত হওয়ার আগে তাদের প্রমাণাদিও পুড়িয়ে ফেলেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা পদক্ষেপের পরও দেশে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-ে অর্থায়ন বন্ধে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। দেশী ও বিদেশী উভয় উৎস থেকেই এসব অর্থায়ন হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও বিশেষ করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বাংলাদেশে জঙ্গীদের অর্থায়ন ও মদদ দিচ্ছে। সম্প্রতি দেশে জঙ্গী আস্তানাগুলোর সন্ধানলাভের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় জঙ্গী অর্থায়নের উৎস নিয়ে আবার আলোচনা হচ্ছে। তবে সরকারী সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করতে না পারায় জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অর্থায়ন অব্যাহত আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে সম্প্রতি ব্যাংকিং চ্যানেলে জঙ্গী অর্থায়ন কমেছে। কিন্তু ব্যাংকবহির্ভূত চ্যানেলে জঙ্গীরা এখন অর্থ আদান-প্রদান করছে।