ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতি আস্থা প্রকাশ;###;সম্মেলন সফল হওয়ায় ভূয়সী প্রশংসা

পাঁচ দফা ঢাকা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আইপিইউ সম্মেলন শেষ ॥ সম্পদ বৈষম্যে উদ্বেগ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৬ এপ্রিল ২০১৭

পাঁচ দফা ঢাকা ঘোষণার মধ্য দিয়ে আইপিইউ সম্মেলন শেষ ॥ সম্পদ বৈষম্যে উদ্বেগ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বৈষম্য হ্রাস, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বন্ধ, পার্লামেন্টকে আরও প্রতিনিধিত্বশীল করা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধিসহ পাঁচ দফা ঢাকা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বুধবার শেষ হয়েছে পাঁচদিনব্যাপী ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সম্মেলনের শেষ দিনে বর্ণাঢ্য ও সফল সম্মেলন আয়োজনের জন্য বিশ্বনেতারা যেমন বাংলাদেশকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন, আয়োজকরা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বের গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের আস্থার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছে সফলতম এই সম্মেলনকে। পাঁচদিনব্যাপী এই সম্মেলনের শেষ দিনে আরপিইউ’র সাধারণ এ্যাসেম্বলিতে ‘ঢাকা ঘোষণা’ সর্বসম্মতিক্রমে ঘোষণা করা হয়। গত শনিবার এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নানা শঙ্কা ও নিরাপত্তার অজুহাতকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এতবড় একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো, যাতে বিশ্বের ১৩২টি দেশ এই সম্মেলনে অংশ নেয়। সম্মেলনের সমাপনী ঘোষণা শেষে আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলনে জাতীয় সংসদের স্পীকার এবং ১৩৬তম আইপিইউ সম্মেলনের সভাপতি ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ যে সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, উন্নয়নের রোল মডেলÑ তা বিশ্বের জনপ্রতিনিধিরা সম্মেলনে এসে প্রত্যক্ষ করলেন। এত সফলতম আয়োজন বাংলাদেশের জন্য এবং জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত সম্মানের ও গৌরবের বিষয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বের গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের পরিপূর্ণ আস্থা রয়েছে, এই সম্মেলনই তার বড় প্রমাণ। দশম জাতীয় সংসদের ওপর যে তাদের আস্থা রয়েছে সেটা প্রমাণিত হলো। অন্যদিকে আইপিইউ সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, দেশের ইতিহাসে এতবড় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন সফলভাবে সম্পন্ন করা সত্যিই বাংলাদেশের জন্য একটি গর্বের বিষয়। বাংলাদেশ যে পারে, উন্নয়নে এ দেশটি যে অনেক এগিয়ে গেছে এটাও প্রমাণ হয়েছে। এই সম্মেলনের মাধ্যমে জাতি হিসেবে যেমন আমাদের মর্যাদা বিশ্বের সামনে বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি বিশ্বের নেতারা এ দেশের গণতন্ত্রের সফলতাও প্রত্যক্ষ করলেন। আর বাংলাদেশের সক্ষমতাও আমরা প্রমাণ দিতে সক্ষম হয়েছি। এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ছিলÑ ‘রিড্রেসিং ইনইকুয়ালিটিজ ঃ ডেলিভারিং অন ডিগনিটি এ্যান্ড ওয়েল বিং অপর অল’। এই প্রতিপাদ্যের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নোবেল বিজয়ী শিশু মানবাধিকারকর্মী কৈলাস সত্যার্থী। পরে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা এই প্রতিপাদ্যের ওপর আলোচনা করেন। এর বাইরে আইপিইউ’র বিভিন্ন কমিটিতে বেশকিছু প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আরেক দেশের হস্তক্ষেপ বন্ধের প্রস্তাব এবং কয়েকটি দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান। এই সম্মেলনের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো ওয়েব টিভি চালু এবং গ্রিন এ্যাসেম্বলির আয়োজন করে সংস্থাটি। পাঁচ দফা ঢাকা ঘোষণা ॥ ঢাকা ঘোষণায় বলা হয়েছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৈষম্য কমাতে মানবাধিকার সুরক্ষায় আইনী কাঠামো শক্তিশালী এবং বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সকলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্থান হিসেবে আইনসভাকে শক্তিশালী করতে হবে। সকল জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। রাজস্ব আহরণের আইনী কাঠামো শক্তিশালী করা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দেয়ার কথা বলা হয়েছে ঘোষণায়। এছাড়া শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে। ঘোষণায় আরও বলা হয়েছে, আইপিইউ বিশ্বব্যাপী সম্পদ বৈষম্য বেড়ে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। আইপিইউ বলেছে, বিশ্বের বর্ধনশীল তরুণ প্রজন্ম বেকারত্ব, সম্পদহীনতা, এবং স্বল্প মজুরিসহ নানা সমস্যায় ভুগছে। বৈষম্য কমাতে আইপিইউ এসব বিষয়ের সমাধানে সদস্যভুক্ত দেশগুলোর উদ্যোগ আশা করছে। এছাড়া নারী শ্রমিকের মজুরি বৈষম্যের বিষয়টিতেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সেবা, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে অল্প কিছু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের বাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের উদ্যোগ কমে আসায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই সংসদীয় ফোরামটি উদ্বেগ জানিয়েছে। যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন ॥ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা ঘোষণা পাঠ করেন আইপিইউ’র ১৩৬তম সম্মেলনের সভাপতি ও জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এ সময় আইপিইউ প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী, সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন চুনগং, ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া, প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা ঘোষণা উত্থাপনকালে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, বৈষম্য নিরসন করে মর্যাদা সম্পন্ন জীবন নিশ্চিত করতে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মূল প্রতিপাদ্যের ওপর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কিভাবে বৈষম্য নিরসন করা যায় সে বিষয়ে সুনির্দ্দিষ্ট প্রস্তাব উঠে এসেছে। তার ভিত্তিতে বিশ্বের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আইপিইউ’র সদস্য দেশগুলো এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। আইপিইউ সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, এখান থেকে যেসব প্রতিনিধি ফেরত গেছেন তারা এখন নিজ নিজ দেশে গিয়ে ঢাকা ঘোষণার বাস্তবায়নের নিজেদের পার্লামেন্টকে অন্তর্ভুক্ত করবেন। এর আগে যখন ভিয়েতনামের হ্যানয়ে আমরা সম্মেলন করেছিলাম তখন সেখানকার পার্লামেন্টও হ্যানয় ঘোষণার বাস্তবায়নে কাজ করেছে। সে হিসেবে আমোদের জাতীয় সংসদেরও এখানে ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে। এই সম্মেলন আইপিইউ টিভি ও সবুজ সম্মেলনের জন্য স্মরণীয় থাকবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। আইপিইউ সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন চুংগং বলেন, এ সম্মেলনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে পার্থক্য থাকে তা কমে আসবে। সহযোগিতার মনোভাব দেখাতে হবে। ঢাকা আমার জন্য ভাগ্যবান শহর। কোন ধরনের বিরোধিতা ছাড়াই আমাকে আরও চার বছরের জন্য পুনঃনিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই সম্মেলনে নতুন দুটি দেশকে সদস্যপদ দেয়া হয়েছে। বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যা বাস্তবায়নে তিনি সক্রিয় থাকবেন বলে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। ঢাকা ঘোষণায় আরও যা আছে ॥ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৈষম্য কমাতে মানবাধিকার সুরক্ষায় আইনী কাঠামো শক্তিশালী এবং বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সকলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্থান হিসেবে আইনসভাকে শক্তিশালী করতে হবে। সকল জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। রাজস্ব আহরণের আইনী কাঠামো শক্তিশালী করা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দেয়ার কথা বলা হয়েছে ঘোষণায়। আরও বলা হয়, বৈষম্যের কারণে সমাজকে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ক্ষুণœ হচ্ছে। এর ফলে সংঘাত ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। আরও বলা হয়, কঠিন বৈষম্য ব্যক্তিকে তার পরিপূর্ণ বিকাশে বাধাগ্রস্ত করে। তার মানবাধিকারও বাধাগ্রস্ত করে। জনগণের একটি বড় অংশ তাদের ক্রয় ক্ষমতা হারায়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়। ক্ষমতা ও সম্পদ যদি মাত্র কয়েকজন ব্যক্তির কাছ কুক্ষিগত থাকে তাহলে সামাজিক সম্প্রীতি হেয়প্রতিপন্ন হয়। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য সুবিধাজনক নয়। এ রকম বৈষম্য সংঘাত ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ায়। পৃথিবীর অনেক দেশ ইতোমধ্যেই এ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। আমরা যদি এটির পরিবর্তন ঘটাতে চাই তাহলে একটি সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার। ঘোষণায় বলা হয়, এসডিজির ১০ নম্বর লক্ষ্যমাত্রায় যেখানে বলা হয়েছে, দেশে দেশে বৈষম্য কমাতে হবে। সেই প্রসঙ্গে আমরা অঙ্গীকার করতে চাই সকল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য নিরসন করবো। আমরা লিঙ্গ বৈষম্য যেটি একটি বহুমুখী সমস্যা। তার মূলোৎপাটন করতে চাই। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি যে, পৃথিবীর সম্পদের এক থেকে দশ শতাংশ প্রথম সারির জনগণের হাতে আছে। যার কারণে বেকার জনগোষ্ঠী আছে, অনেকেই চাহিদা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছে না। অনেকেই কাজের অনুপাতে স্বল্প বেতন পাচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সুযোগ কমে আসে। তারা প্রায়ই পরিবেশ দূষণ, বৈশ্বিক জলবায়ু দূষণের শিকার হয়। তারা সহিংসতা এবং বৈষম্যের শিকার হয়। ঘোষণায় বলা হয়, মহিলারা সাধারণত পুরুষের তুলনায় একই কাজ করার পরও কম বেতন পায় এবং তাদের কাজের জন্য অনেক বাধা পেরুতে হয়। কাজের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। গৃহকার্য করার জন্য কোন বেতন পায় না। আর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে বিশেষ করে মহিলা, তরুণ, আদিবাসী, অভিবাসী, প্রতিবন্ধী এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে যায়। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটনা হবে। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। ঘোষণায় আরও বলা হয়, পৃথিবীর অল্প কিছু বহুজাতিক কোম্পানি বাজারে এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে প্রাধান্য বিস্তার করে। এর কারণে প্রতিযোগিতায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তরা টিকে থাকতে পারে না। বেকার ও দারিদ্র্য বাড়ছে। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো দরকার। ঢাকা ঘোষণায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সম্মেলন চলাকালে রাশিয়ার পিটার্সবার্গে বোমা হামলার নিন্দা জানিয়ে প্রস্তাব নেয়া হয়েছে। সেখানে হতাহতদের ঘটনায় এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়েছে। সম্মেলনে শোক প্রস্তাব নেয়া হয়েছে। এ সময় সিরিয়ায় রাসায়নিক আক্রমণের নিন্দা জানানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে রাসায়নিক অস্ত্র যে নিষিদ্ধ, তা বিশ্ববাসীকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া এক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ বন্ধে প্রস্তাব নেয়া হয়েছে।
×