ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ৪ এপ্রিল ২০১৭

স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি

বিশ্বের ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত সত্য হচ্ছে বাঙালী জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রামের সমন্বিত ফসল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং রক্তের বিনিময়ে সংঘটিত এই মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে ছিল বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের বিশাল ও বিস্তৃত এক ঐতিহাসিক ধারা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাত্র ৬-৭ বছর পর থেকে এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে অতি কুৎসিত এবং অশোভন মিথ্যাচারের মোড়কে এক ভিন্ন ও বিভ্রান্ত খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা অব্যাহত ছিল, যা এখনও পরিপূর্ণভাবে মুক্ত হতে পারেনি। দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলে সৃষ্ট জনযুদ্ধের পরিবর্তে এই মহান মুক্তিযুদ্ধকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের কাঠামোয় সামরিক যুদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রও হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য হচ্ছে যে, ইতিহাসকে সাময়িকভাবে পাল্টানো যায়; কিন্তু কালক্রমে ইতিহাসের অধ্যায় নিজের অবস্থানকে নিজেই সুদৃঢ় করে নেয়। এটি সর্বজনবিদিত যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে মানবসভ্যতার ইতিহাসের নিষ্ঠুর ও নৃশংসতম বর্বর হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক কালো অধ্যায় সূচিত হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত বাহিনীর কূট প্ররোচণায় তৎকালীন সামরিক রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৮ সালের ২য় ঘোষণাপত্র আদেশ নং- ৪-এর দ্বিতীয় তফসিল বলে সন্নিবেশিত সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে অতি জঘন্য ও ন্যক্কারজনকভাবে ইতিহাসের সাবলীল এবং শাশ্বত ধারাকে পাল্টানোর অশুভ প্রয়াস চালানো হয়েছিল। পবিত্র সংবিধানের শুরুতেই যে প্রস্তাবনা লিপিবদ্ধ ছিল তার দ্বিতীয় লাইনে ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম (ধ যরংঃড়ৎরপ ংঃৎঁমমষব ভড়ৎ হধঃরড়হধষ ষরনবৎধঃরড়হ)’ সন্নিবেশিত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভুমিতে ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল আন্দোলন-সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেয়ার এক অসাধারণ যুক্তি ও চেতনা সক্রিয় ছিল। যৎসামান্য বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন যে কোন ব্যক্তি সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করলে সংবিধানে উল্লেখিত জাতীয় মুক্তি ও ঐতিহাসিক সংগ্রাম অর্থাৎ ‘মুক্তি’ ও ‘সংগ্রাম’ শব্দ দুটোর তাৎপর্য, গভীরতা এবং বিশালতা অনুধাবন করতে পারবেন। ১৯৭২ সালে প্রণীত ও গৃহীত পবিত্র সংবিধানের এই মৌলিক বিষয়ের পরিবর্তন সাধন করে ১৯৭৮ সালে সংযোজিত হয় - ‘জাতির স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ।’ পাঠকদের উপলব্ধির জন্য সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম অংশটুকু তুলে ধরা হলো। ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া ২ [জাতীর স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের] মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি; (ডব, ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ইধহমষধফবংয, যধারহম ঢ়ৎড়পষধরসবফ ড়ঁৎ রহফবঢ়বহফবহপব ড়হ ঃযব ২৬ঃয ফধু ড়ভ গধৎপয, ১৯৭১ ধহফ ঃযৎড়ঁময ২ [ধ যরংঃড়ৎরপ ধিৎ ভড়ৎ হধঃরড়হধষ রহফবঢ়বহফবহপব], বংঃধনষরংযবফ ঃযব রহফবঢ়বহফবহঃ ংড়াবৎবরমহ চবড়ঢ়ষব’ং জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ইধহমষধফবংয;)’। বস্তুতপক্ষে ১৯৭২ সালে সংবিধানে ‘জাতীর মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’র স্থলে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ সন্নিবেশিত করে ১৯৭১ সালে চূড়ান্তভাবে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামকে শুধুমাত্র নয় মাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ের ফ্রেমে গন্ডিভূত করা এবং পরবর্তীতে ইতিহাস বিকৃতির কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। অত্যন্ত চতুরতা ও অশুভ চক্রান্তের আড়ালে ইতিহাসের ধারা পাল্টানোর যে প্রাতিষ্ঠানিক অপপ্রয়াস এবং তারই ধারাবাহিকতায় দেশের দরিদ্র, নিরীহ এবং অধিকাংশ অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী তথা বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত ইতিহাস বিকৃতির হীন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আবদ্ধ করার অপচেষ্টাকে জোরদার করার প্রক্রিয়াকে দেশবাসী ঘৃণাভরে পর্যবেক্ষণ করেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া এবং ভাড়াটে লেখকদের সমাবেশ ঘটিয়ে সর্বস্তরে মিথ্যাচার ও বিবেকবর্জিত ইতিহাস বিকৃতির নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন, জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করা এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার যে গৌরবগাথা, তাকে ম্লান ও আড়াল করার লক্ষ্যে ইতিহাস বিকৃতির যে অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত ও অশুভ ধারা সৃষ্টি হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া এবং দেশ, জাতি ও দেশবাসীকে এই বিকৃত ইতিহাসের নগ্ন থাবা থেকে কোনভাবেই উদ্ধার করা যেত না। বাংলাদেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রগতিশীল সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী আবুল ফজলের ভাষায়, ‘বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও সর্বাধিক উচ্চারিত নাম : শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের ইতিহাসের তিনি শুধু নির্মাতা নন, তার প্রধান নায়কও। ঘটনাপ্রবাহ ও নিয়তি তাঁকে বার বার এ নায়কের আসনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বলা যায়, যেন হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হতে পারে না। শত চেষ্টা করেও তাঁর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। ইতিহাস দেয় না তেমন কিছু করতে। ইতিহাস নিজের অঙ্গ নিজে করে না ছেদন। শেখ মুজিব ইতিহাসের তেমন এক অচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলাদেশের শুধু নয়, বিশ্ব-ইতিহাসেরও।’ দেশে এবং দেশের বাইরে সকল বিবেকবান ব্যক্তি, রাষ্ট্রনায়ক, লেখক ও বুদ্ধিজীবী, যে কারও লেখনীতে বঙ্গবন্ধুকে সাহিত্যিক আবুল ফজলের মতোই বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বনামধন্য কৃতী সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার আবুল মনসুর আহমদের মতে, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ১৯৪০-এ লাহোরে যা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে তা সমাপ্ত করেছেন। স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ফল। এই মুক্তিযুদ্ধ একটি আকস্মিক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই ঘটনার একটা উরধষবপঃরপ আছে। এই ঘটনার একটি ধারাবাহিকতা আছে। সে ধারাবাহিকতা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ থেকে প্রতিষ্ঠিত। সেই বস্তুবাদের ঘটনা পরম্পরা মাইলস্টোনের মতো সুস্পষ্ট। আমাদের এই স্বাধীনতা অতীত সংগ্রাম ও ঘটনাসমূহের সমষ্টিগত ফল। উল্লিখিত এসবের পিছনে রয়েছে সিপাহী বিপ্লব, স্বরাজ ও খেলাফত আন্দোলন, কৃষক-প্রজা আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬’র ছয় দফা ও ৬৯’র গণআন্দোলন এবং ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচন। অতএব উল্লিখিত আন্দোলন-ঘটনাসমূহের বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে কোনভাবেই সঠিক উপলব্ধিতে আনা যাবে না। এইসব উজ্জ্বল পটভূমিকে আড়ালে রেখে ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সামরিক যুদ্ধের ফসল হিসেবে আখ্যায়িত করা শুধু নির্লজ্জ অপপ্রয়াস নয়; বঙ্গবন্ধুকেও আড়াল করার একটা বিকৃত অভিলাস ও দুঃস্বপ্ন মাত্র। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, বাংলাদেশে শেখ মুজিবই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যার সম্বন্ধে আবুল ফজলের ভাষায় ঊধৎহবংঃ ঐবসসরহমধিু’র উক্তিটি পুনরাবৃত্তি করা যায় : গধহ রং হড়ঃ গধফব ভড়ৎ ফবভবধঃ. গধহ পধহ নব ফবংঃৎড়ুবফ, নঁঃ হড়ঃ ফবভবধঃবফ. সকলের জানা আছে যে, ১৯৪০ সালে বাঙালী নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকই পাকিস্তান আন্দোলন নামে খ্যাত লাহোর প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম বাংলার ভোটাররা প্রায় এক বাক্যে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। তৎকালীন ভারতে মুসলিম প্রাধান্য প্রদেশসমূহের মধ্যে এটিই ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। তথাপি পাকিস্তানের ২৫ বছরের শাসনামলে এই পূর্ব বাংলার প্রতি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর যে নির্মম, আত্মঘাতী ও অদূরদর্শী ঔপনিবেশিক দুর্ব্যবহার করা হয়েছে, তা সকলের জানা আছে। প্রকৃতপক্ষে সাবেক পাকিস্তান গণসমর্থিত কোন রাষ্ট্র ছিল না। এই তথাকথিত রাষ্ট্রে ২৩ বছরে কোন সাধারণ নির্বাচন এবং রাষ্ট্রের একটি শাসনতান্ত্রিক সংবিধান রচিত হয়নি। নয় বছরের চেষ্টায় যে একটি শাসনতন্ত্র রচিত হয়েছিল একদিনের সামরিক আঘাতে তা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে ফেলা হয়। পুরো ইতিহাসে সৃষ্টি হয়েছে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক চক্রান্ত ও নৈরাজ্য। এরই প্রেক্ষিতে আমরা দেখতে পাই দীর্ঘ এই সময়কাল ধরে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সংগ্রামী কর্মকা-। নিখিল ভারত (বঙ্গ) মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে ছাত্রদের মধ্যে দুটো গ্রুপ বিদ্যমান ছিল। একটি গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন জিন্নাহ সাহেব এবং সমর্থক ছিলেন খাজা নাজিম উদ্দিন এবং অন্যটি ছিল প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শে উজ্জ্বল, যার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী এবং তার সমর্থক শেখ মুুজিব। সে সময় থেকে বাংলার জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম ভালবাসা সুস্পষ্ট হয়েছে। কথিত আছে যে, ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় শেখ মুজিব তাঁর পিতার অনুপস্থিতিতে নিজেদের ধানের গোলা খুলে দিয়েছিলেন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য। ১৯৪৩ সালে বঙ্গদেশে মুসলিম লীগ শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল তার পিছনে ছিল বঙ্গবন্ধুর বিশাল অবদান। শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর সঙ্গে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। ক্রিপস্ কমিশন মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৪৬ সালে ১৬ আগস্ট খাজা নাজিম উদ্দিন, চৌধুরী খালেকুজ্জামান এবং ঈসমাইল খানের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের ডাইরেক্ট এ্যাকশন কর্মসূচীর ফলস্বরূপ কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার যে সূত্রপাত হয়, সোহ্রাওয়ার্দীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থেকে শেখ মুজিব সেই উন্মত্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রশমনে এক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। কংগ্রেস প্রস্তাবিত বঙ্গদেশকে পূর্ব-পশ্চিম হিসেবে ভাগ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার যে দাবি উত্থাপিত হয়েছিল, তার বিপক্ষে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসু এই তিন নেতা অখ- বাংলাদেশ দাবি করেন। অখ- বাংলাদেশের সমর্থনে নেতৃত্বদানকারী সোহরাওয়ার্দী সাহেব এবং তাঁর বিপরীতে বঙ্গদেশ বিভক্তির সমর্থক খাজা নাজিম উদ্দিনের মধ্যে নেতৃত্বের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ও কতিপয় প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ছাড়া সেই সময় সোহ্রাওয়ার্দীর নেতৃত্বের প্রতি আর কারও সমর্থন তেমন স্পষ্ট ছিল না। পরবর্তীতে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ সৃষ্টির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়ে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর সেই সাংগঠনিক দক্ষতা আরও বেগবান হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার সময় তিনি সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। আরও পরে নিজস্ব আদর্শ ও ভূমিকার ভিত্তিতে ১৯৬৩ সালে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব অভূতপূর্ব গ্রহণযোগ্যতা পায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে শেখ মুজিবসহ অন্যদের চরমভাবে দ-িত করার যে নীল নক্শা প্রণীত হচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানীর জনসভায় সংগ্রামী জনতার উচ্চারণ ধ্বনিত হলো ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’ তার পরবর্তী ইতিহাস ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভূতপূর্ব বিজয়- পূর্ব পাকিস্তানে ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০ আসনে জয়লাভ, যার ফলে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতার কর্ণধার তথা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সকল পথ উন্মুক্ত হয়। কিন্তু সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের এই বিজয়কে নস্যাৎ করার পরিকল্পনা করে। এর প্রেক্ষিতে ’৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করেন। মওলানা ভাসানী ’৭১-এর ৯ মার্চ পল্টনে জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার দাবি ২৫ মার্চের মধ্যে যদি মেনে নেয়া না হয় তাহলে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক হয়ে স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করবেন। সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া বিভিন্ন আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে ভুট্টোর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে আবদ্ধ হয়ে ২৫ মার্চ কালরাতে ইপিআর, পুলিশসহ সকল স্তরের নিরস্ত্র জনগণের ওপর ইতিহাসের নির্মম গণহত্যা পরিচালনা করে। মধ্যরাতে তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করার পূর্বেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ওয়্যারলেসযোগে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী প্রেরণ করেন। ঢাকার তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘ডরঃহবংং ঃড় ংঁৎৎবহফবৎ’ গ্রন্থে ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা শ্রবণের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘ঝড়ড়হ ধভঃবৎ ফধৎশহবংং ভবষষ ড়হ গধৎপয ২৫ (১৯৭১) ঃযব াড়রপব ড়ভ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযধসধহ পধসব ভধরহঃষু ঃযৎড়ঁময ড়হ ধ ধিাব ষবহমঃয পষড়ংব ঃড় ঃযব ড়ভভরপরধষ চধশরংঃধহ ৎধফরড়. ওহ যিধঃ সঁংঃ যধাব নববহ ধহফ ংড়ঁহফবফ ষরশব, ধ ঢ়ৎব-ৎবপড়ৎফবফ সবংংধমব, ঃযব ঝযবরশয ঢ়ৎড়পষধরসবফ ঊধংঃ চধশরংঃধহ ঃড় নব ঃযব ‘চবড়ঢ়ষবং জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ইধহমষধফবংয’. ঐব পধষষবফ ড়হ ইবহমধষববং ঃড় মড় ঁহফবৎমৎড়ঁহফ ঃড় ৎবড়ৎমধহরুব ধহফ ঃড় ধঃঃধপশ ঃযব রহাধফবৎং’. (দ্রষ্টব্য ঃ ‘ডরঃহবংং ঃড় ঝঁৎৎবহফবৎ’ নু গধলড়ৎ ঝরফফরয়ঁব ঝধষরশ. ঙীভড়ৎফ টহরাবৎংরঃু চৎবংং. কধৎধপযর. ১৯৭৭. চধমব ৭৫). মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী স্বাধীনতা ঘোষণার একটি কপি এম এ হান্নানকে দেন, যিনি বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি বঙ্গানুবাদ করে ২৬ মার্চ দুপুরের পর সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠ করেন। এরপর স্বাধীনতার এ ঘোষণাটি সংবাদ আকারে পাঠ করেন বিপ্লবী বেতারকর্মী আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। পরদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ সান্ধ্য অধিবেশনে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণাটি পাঠ করেন। এরপর মেজর জিয়াউর রহমানের আরও দুটি ভাষণ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে ২৮ ও ৩০ মার্চ প্রচারিত হয়। মেজর জিয়ার ভাষণ সম্পর্কে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী তৎকালীন মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়া লিখেছেন, তাঁর (জিয়ার) দ্বিতীয় দিনের ভাষণে এ তথ্যই প্রকাশ পায় যে, তিনি মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে (‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস’ মেজর এস এ ভূঁইয়া, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৭৪, পৃঃ ৪৪-৪৫)। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা মুজিবনগরে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী সাংসদদের সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়, যা ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ গণপরিষদের স্বীকৃতি লাভ করে। স্বাধীনতার এই ঘোষণার প্রেক্ষিতেই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে পরবর্তী ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। উল্লিখিত আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, হাজারো অপচেষ্টা করেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনদিন কোনভাবে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো বা আড়াল করা যাবে না, অথবা ইতিহাসের অধ্যায়কে রুদ্ধ করার অপচেষ্টা যে কখনও সফল হয় না বাঙালী তা নতুন করে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ, উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×