ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার সোনালি দিন

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২ এপ্রিল ২০১৭

একুশ শতক ॥ প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার সোনালি দিন

॥ প্রথম পর্ব ॥ হাজার বছরের প্রাচীন বাংলা ভাষার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা নিয়ে আমি আলোচনা করেছি অনেক। এই সক্ষমতা অর্জনে আমাদের লড়াইটা মোটেই সহজ ছিল না। বাঙালী একদিকে রক্ত দিয়ে তার ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছে, অন্যদিকে নিজের মেধা দিয়ে এর প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও তৈরি করেছে। আমরা আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দেশে জননেত্রী শেখ হাসিনার শাসনকালে বাংলা ভাষার একটি সোনালি সময় আনতে সক্ষম হচ্ছি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বলে এই ভাষা সচরাচর রাজ-রাজড়াদের পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে ছিল। কেউ কেউ বাংলা সাহিত্যকে কিছুটা পৃষ্ঠপোষকতা দিলেও এর বর্ণমালা ও প্রযুক্তিগত বিষয় কচুরিপানার মতো ভাসতে ভাসতে সামনে এগিয়েছে। পাকিস্তান আমলের বাংলা টাইপরাইটার প্রকল্প, বাংলাদেশ আমলে টাইপরাইটারের বৈদ্যুতিকীকরণ প্রকল্প, নির্বাচন কমিশন ও এটুআই-এর ফন্ট প্রকল্প, আরডিআরসির ব্যাক প্রকল্প, এটুআই-এর ইউনাইটেড প্রকল্প ও আইসটি ডিভিশনের বঙ্গ ও.সি.আর প্রকল্প বাংলার প্রযুক্তিগত সক্ষমতার জন্য পরিকল্পিত হলেও আমরা সেই সফলতা অর্জন করতে পারিনি। আমরা জানি, প্রাকৃতজনের এই ভাষার ভিত্তিতে দুনিয়ার প্রথম রাষ্ট্রটি জন্ম নেয় ’৭১ সালে। আজ অবধি বাংলার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা মানে হচ্ছে ৭২ সালে অপটিমা মুনীর টাইপরাইটার পাওয়া এবং ৮৮ সাল থেকে বিজয় দিয়ে বাংলা লেখা। আমরা ভাগ্যবান যে, ১৭ সালে আমরা এর প্রযুক্তিগত সক্ষমতার সেরা সময়ে দাঁড়িয়ে আছি। কৃতজ্ঞ জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে। অবাক তাকিয়ে রয় : ২০১৭ সালের স্বাধীনতার মাস মার্চের শেষ দিনে দুটি খবর বিশ্বের সকল বাংলা ভাষাভাষীকে বিস্মিত করে থাকবে। প্রথমটি হচ্ছে মাইক্রোসফট বাংলা-ইংরেজী-বাংলা অনুবাদক প্রকাশ করেছে। এই অ্যাপটি দিয়ে উইন্ডোজ ফোন, আইফোন, এন্ড্রয়েড ফোন ইত্যাদিতে বাংলাকে ইংরেজীতে ও ইংরেজীকে বাংলায় অনুবাদ করা যাবে। কাজটি একেবারেই নতুন নয়। গুগলও এর আগে এমন কাজ করার সুবিধা প্রকাশ করেছে। গুগলের ও মাইক্রোসফটের অনুবাদক বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। গুগলের খবরটি হচ্ছে প্রযুক্তিতে বাংলাকে আরও সমৃদ্ধ করার। তারা ২০১২ সালে নলেজ গ্রাফ নামক একটি প্রযুক্তি প্রকাশ করে, যার সহায়তায় গুগলের অনুসন্ধানকে আরও সহজ করা হয়। এবার গুগল বাংলাকেও নলেজ গ্রাফের আওতায় এনেছে। ২৯ মার্চ ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত গুগলের খবরটি এরকম : বাংলায় অনুসন্ধান করা আরও সহজ শিরোনামে প্রকাশিত গুগলের ব্লগে বলা হয় যে, দুনিয়ার ৭ হাজার জীবিত ভাষার মাঝে ষষ্ঠ ভাষা বাংলা ২০ কোটি লোক ব্যবহার করে থাকে। বোঝা যায় যে, গুগলের বাংলা ভাষাভাষীর তথ্যটা ভুল। বাংলাদেশের ১৬ কোটি, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমপরিমাণ, ত্রিপুরা ও প্রবাসী জনগোষ্ঠীকে গণনায় নিয়ে আমরা ৩৫ কোটি লোক যে বাংলায় কথা বলি সেটি প্রমাণ করার কিছু নেই। গুগল এটিকে বলছে যে, এর ফলে স্ট্রিং নয়, বিষয়বস্তু খুঁজে আনা হচ্ছে। When someone conducts a search, they want an answer, not trillions of webpages to scroll through. To help Bengali speakers discover nwe information quickly, weÕre nwo making the Google Knowledge Graph available in Bengali language. So next time when youÕre searching for cricket legend Sourav Ganguly in Bengali, weÕll shwo you things, not strings– and youÕll instantly get information thatÕs relevant to your query such as SouravÕs date of birth, his number as an active cricket player, or links to his profile on social media. The Knowledge Graph enables you to search for things, people or places that Google knows about—landmarks, celebrities, cities, sports teams, buildings, geographical features, movies, celestial objects, works of art and more. ItÕs not just rooted in public sources such as Freebase, Wikipedia and the CIA World Factbook, itÕs also augmented at a much larger scale—because weÕre focused on comprehensive breadth and depth. The Knowledge Graph is currently available in 41 languages, mapping out hwo more than 1 billion things in the real world are connected, and over 70 billion facts about them. And itÕs tuned based on what people search for, and what we find out on the web, improving results over time. (https://india.googleblog.com/2017/03/making-it-easier-to-search-in-bengali.html) একই সঙ্গে গুগল বাংলা টাইপিং ভুল বা বানান ভুলকেও সহায়তা করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে বলে জানিয়েছে। ব্লগে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় যে, কম্পিউটার টাইপ বাংলা কিপেড ভুল করে লেখার পরও এই সংক্রান্ত সকল নির্দিষ্ট বিষয়ের পাশাপাশি কিভাবে বিজয় কীবোর্ডে বাংলা লিখব সেটিও খুঁজে বের করা হয়েছে। গুগলের ব্লগে বলা হয়েছে ÒSearch is a lot about discovery–learning something nwe about the world, having fun, and getting inspired. But especially when youÕre on the go or in a rush, itÕs all too easy to misspell that thing you were searching for. To help you get answers even when you misspelled a word, we nwo support spell correction for Bengali queries. So whenever a typo made its way into your search query, weÕll be there to help, suggesting similar queries. অনেকেই জানেন যে-এর আগে গুগল কথা থেকে লেখায় ও লেখা থেকে কথায় বাংলা প্রকাশ করার প্রযুক্তির পাশাপাশি বাংলা ও.সি.আর প্রকাশ করেছে। সেই ও.সি.আরটি বেশ ভালই কাজ করে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, গুগল এরই মাঝে বাংলা করপাশের একটি বিশাল ভা-ারও তৈরি করেছে। এই মাসেরই আরও একটি খবরের কথা উল্লেখ করতে হয়। সেটি হচ্ছে দুনিয়ার বিখ্যাত কম্পিউটারের আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক সুইজ কোম্পানি লজিটেক এবার তাদের কীবোর্ডে বিজয় বাংলা লেআউট যুক্ত করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের আর কোন ভাষায় তারা লজিটেক কীবোর্ড প্রস্তুত করে না। স্মরণযোগ্য যে, ১৯৯৮ সালে বিজয় বাংলা মুদ্রিত কীবোর্ড বাজারে আসে এবং এখন দেশের সকল কীবোর্ডের প্রায় সিংহভাগই বিজয় বাংলা লেআউটসহ আমদানি হয়ে থাকে। একই সঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি যে, বাংলাদেশ সরকার বাংলা ভাষার প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ১৫৯.০২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখে অনুমোদিত এই প্রকল্পটির বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে জানলাম যে, বাংলা এখন আর দুঃখিনী বাংলা নেই। বাংলাদেশের অনেক মানুষ বাংলা ভাষার প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ব্যাপকভাবে কাজ করছেন। তবে আমরা সেইসব খবর হয়ত রাখি না। আমরা হয়ত এখনও ভাবছি যে, আমরা মুদ্রণ যন্ত্র পেয়েছিলাম ৩২৪ বছর পরে। আমরা এটাও হয়ত ভাবছি যে, টাইপরাইটার পেয়েছি ১৮৭০ সালের বদলে ১৯৭২ সালে এবং কম্পিউটারের কীবোর্ড পেলাম মাত্র ১৯৮৮ সালে। বাংলা ভাষার প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতা সামনেও থাকবে সেটি মনে করেই একদল লোক বাঙালীকে ইংরেজ বানানোর চেষ্টা করছে। সম্ভবত এজন্য বাংলা ভাষার যে মর্যাদা সারা দুনিয়াতে আছে, প্রযুক্তি দুনিয়া যে বাংলাকে প্রবলভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে সেটিও সম্ভবত আমরা বাংলা ভাষাভাষীদের একাংশ বুঝতে পারছি না। নিজের ভাষার সক্ষমতার বিষয়গুলোই যেন এর ভাষাভাষীদের মাঝে নেই। কদিন আগে আমি ফেসবুকে বাংলায় নাম লেখার আবেদন করেছিলাম। শত শত বাঙালী এই আবেদনে সাড়া দিলেও কেউ কেউ আন্তর্জাতিকতার দোহাই দিয়ে ইংরেজীর প্রাধান্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কেউ কেউ নানা অজুহাত তুলেছেন। কেউ কেউ প্রযুক্তিগত সমস্যার কথাও বলেছেন। কিন্তু যারাই ভাবছেন যে, দুনিয়া একেবারেই ইংরেজীমুখী তাদের হিসাবটা বোধ হয় প্রযুক্তিই বদলে দিচ্ছে। এমন দিন সামনে আসবে যেদিন মানুষ ইংরেজীতে যোগাযোগ করার জন্য ইংরেজী শিখবে না। সম্ভবত ইংরেজীতে নিজেকে প্রকাশ না করে মাতৃভাষায় সে নিজেকে প্রকাশ করবে এবং ইংরেজীর জন্য বা অন্য ভাষার জন্য তারা নিজের মাতৃভাষাই ব্যবহার করবে। এমনও দিন আসবে যে দিন ইংরেজী বলার জন্যও মানুষের দরকার হবে না। কেমন হবে যদি আমরা বাংলায় লিখি আর সেটি দুনিয়ার যে কোন ভাষায় লিখিত বা কথ্য যে কোনরূপে প্রকাশিত হয়? আমার নিজের মতে ইংরেজী বা বিদেশী ভাষার দাসত্বের যুগের অবসান সম্ভবত খুব কাছেই। যন্ত্রপাতি যখন কথা বলা শুরু করবে তখন ভাষা কার কোন্টা সেটি ভাবারও প্রয়োজন হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। মোদের গরব মোদের আশা : বাংলা ভাষা ও বর্ণমালার সহস্রাধিক বছরের ইতিহাসে প্রথম এবং একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কায়িক যন্ত্রে একে ব্যবহার করা। তবে এই চ্যালেঞ্জ কেবল বাংলার একার ছিল না। যন্ত্রযুগের আগে পর্যন্ত দুনিয়ার সকল লেখন পদ্ধতির মতোই বাংলা ভাষা হাতে লিখে বিকশিত হতে থাকে। বাংলার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ পুঁথি আকারে হাতে লেখা। বাংলা প্রাচীন বা পুঁথি সাহিত্য তালপাতায় লেখা শুরু হয়। কালক্রমে সেটি কাগজে হাতে লেখা আকারে বিকশিত হয়। তবে বিশ্বের অন্য ভাষা- বিশেষত রোমান হরফের ভাষাগুলো যন্ত্রযুগে পা দিলেও বাংলার যন্ত্রযুগ অনেক দেরিতে শুরু হয়। রোমান হরফে মুদ্রণ যন্ত্র ও টাইপরাইটার চালু হলেও আমরা বাংলাকে এর কাছাকাছি কোন সময়ে যন্ত্রযুগে প্রবেশ করাতে পারিনি। কিন্তু বাঙালী তার অসাধারণ মেধাকে কাজে লাগিয়ে শত শত বছর পেছনে পড়ে থাকা বাংলাকে আজকের বিশ্বে ইংরেজী ও অন্যান্য ভাষার প্রায় সমকক্ষভাবে যন্ত্রে ব্যবহার করার শিখরে তুলতে সক্ষম হয়েছে। দুনিয়াতে এখন এমন কোন ডিজিটাল যন্ত্র নেই যাতে বাংলা লেখা যায় না। অবশ্য এই কথাটিও সত্য যে, তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা প্রয়োগের চ্যালেঞ্জগুলোকেও অস্বীকার করা যাবে না। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় বাংলা এখনও রোমান হরফের সমকক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, বাংলাকে এমন সমকক্ষতা প্রদানের জন্য তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টাও অতীতে ছিল না। সম্প্রতি আমরা সেই দুর্নাম ঘুচানোর উদ্যোগ নিয়েছি। বছরের পর বছর লড়াই করে আমাদের সামনে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার বিকাশের একটি সুবর্ণ সময় উপস্থিত হয়েছে। ১৭ সালের জানুয়ারি মাসে অনুমোদিত তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের ১৫৯.০২ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। ২০১০ সাল থেকে শুরু করে ১৭ সালে প্রকল্প অনুমোদিত হতে পারাটাকেও আমি একটি বড় বিজয় মনে করছি। কারণ, এর আগে ব্রিটিশ বা পাকিস্তানী কিংবা বাংলাদেশ আমলে বাংলা ভাষার তথ্যপ্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য কোন সরকারী আনুকূল্য পাওয়া যায়নি। অথচ আমরা এখন টের পাচ্ছি যে, বিশ্ববাসী বাংলাকে অসাধারণ মর্যাদা দিচ্ছে। আমাদের একুশে যে কেবল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বা সিয়েরালিওনের রাষ্ট্রভাষা কিংবা জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষার মর্যাদা পাওয়ার অপেক্ষায় আছে কিংবা আমরাই যে ডট বাংলার অধিকারী সেটাই নয়, বস্তুত বিশ্বজুড়ে ৩৫ কোটি মানুষের ভাষা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম ভাষার কাতারে দাঁড়াতে যাচ্ছে। আসুন, একটু পেছনে তাকাই। আবার বর্তমান এবং সামনেও তাকাই। ঢাকা, ৩১ মার্চ, ১৭ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা ও কর্মসূচীর প্রণেতা ॥ ই-মেইল : [email protected], ওয়েবপেজ : www.bijoyekushe.net
×