ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতা দিবসে লাখো শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা

নতুন প্রজন্মের গণজাগরণ

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৭ মার্চ ২০১৭

নতুন প্রজন্মের গণজাগরণ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বাংলাদেশের ৪৬ বছর পূর্তির দিন রবিবার এক অন্যরকম স্বস্তি, আনন্দ ও শপথে জেগে উঠেছিল বাঙালী। সারাদেশেই নতুন প্রজন্মের অভূতপূর্ব গণজাগরণ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবারের স্বাধীনতা দিবসে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তস্নাত লাল-সবুজের পতাকা হাতে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের কণ্ঠেই ধ্বনিত হয়েছে জঙ্গীবাদমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রত্যাশার কথা। কালরাতের আঁধার পেরিয়ে আত্মপরিচয় অর্জন ও পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গার দিনটি বাঙালী জাতি হৃদয়ের গভীরতা থেকে শ্রদ্ধার সঙ্গেই পালন করেছে নানা অনুষ্ঠানমালায়। স্বাধীনতা দিবসে জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের। এবার জাতীয় স্মৃতিসৌধে যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত লাখো মানুষের স্রোত, তখন সিলেটে একটি জঙ্গী আস্তানা ঘিরে অভিযানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে চলা এই অভিযানের মধ্যেই শনিবার রাতে পর পর দুটি বিস্ফোরণে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জন নিহত হয়েছে। গুরুতর আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে র‌্যাবের দুই সিনিয়র কর্মকর্তা। উন্নয়ন-অগ্রগতি ও দেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধ্বংস করে দিতে প্রগতিবিরোধী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আবারও শেষ কামড় দিতে উদ্যত। তাই এবারের স্বাধীনতা দিবসে জঙ্গীবাদ রুখতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ করার আহ্বান ফিরে এসেছে শ্রদ্ধা জানাতে আসা হাজার হাজার সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। সাম্প্রদায়িক জঙ্গীগোষ্ঠী ও তাদের মদদদাতা স্বাধীনতাবিরোধীরা চেয়েছিল আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে প্যানিক সৃষ্টির মাধ্যমে স্বাধীনতাকামী দেশের জনগণকে ঘরে আটকে রাখবে। কিন্তু পরাজিত অপশক্তিরা জানে না, বীর বাঙালীরা কোন অপশক্তির কাছে কোনদিনই মাথা নামায়নি, আগামীতেও নামাবে না। তারই বহির্প্রকাশ ঘটে রবিবার স্বাধীনতা দিবসে। দেশ মাতৃকার জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবারও মানুষের স্রোত ছিল চোখে দেখার মতো। জঙ্গীবাদের মূলোৎপাটনের দৃপ্ত শপথে লাখো মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে বীর শহীদদের প্রতি। রাস্তায় বের হওয়া শিশু-কিশোর ও তরুণদের হাতে, কারও গালে কিংবা কপালে আঁকা ছিল রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা, প্রিয় মাতৃভূমির মানচিত্র। তরুণ প্রজন্মের ছেলেদের গায়ে জাতীয় পতাকা সদৃশ্য শর্ট পাঞ্জাবি বা গেঞ্জি এবং মেয়েদের পরনে লাল-সবুজের মিশ্রণে জাতীয় পতাকার মতো শাড়ি। সবাই অংশ নিয়েছিলেন এবারের স্বাধীনতার আনন্দ-উৎসবে। রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা কণ্ঠে তরুণ প্রজন্মরা শুনেছে তাঁদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস, জেনেছে একাত্তরে রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের গণহত্যা, মা-বোনদের সম্ভ্রমহরণ ও বুদ্ধিবীজীদের হত্যার কালো ইতিহাস। তাই শুধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সাধারণ মানুষই নয়, তরুণ প্রজন্মের চোখে-মুখে স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গীদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা-ধিক্কারের বহির্প্রকাশ ঘটেছে সর্বত্র। তবে এবারের স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীনতাবিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে বেশ জোরেশোরেই। একই সঙ্গে নানা অনুষ্ঠানেই স্বাধীনতার সাড়ে চার দশকের মাথায় এসে একাত্তরের শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের সমালোচনাই মুখর ছিলেন সবাই। আর যাতে ভবিষ্যতে কোন অপশক্তি মহান মুক্তিযুদ্ধ, বীর শহীদ ও বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে কটাক্ষ করার দুঃসাহস দেখাতে না পারে সে জন্য দ্রুত হলোক্যাস আইনের মতো কঠোর আইন প্রণয়নের সোচ্চার দাবি ছিল প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেই। রাজধানী থেকে শুরু করে শহর-বন্দর-গ্রামে দেশের জন্মদিনের প্রতিটি অনুষ্ঠানে নতুন প্রজন্মের ঢল, তাদের চোখে-মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখার দৃপ্ত শপথ আর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার প্রচ-তা প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ। নতুন প্রজন্মের এমন গণজাগরণ আশাবাদী ও সাহসী করে তুলেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে। রাজনীতিক থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই দৃঢ় আশাবাদীÑ ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নতুন প্রজন্মের এমন বিস্ফোরণ জানান দিচ্ছে, যতই ফণা তোলার চেষ্টা করুক, জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রবিরোধী অন্ধকারের শক্তির দিন শেষ। যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের নির্মূল করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন এক জন্মভূমির যাত্রা শুরু হবেই। আনন্দ, বেদনা ও বিনম্র শ্রদ্ধায় মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণ এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদমুক্ত অসাম্প্রদায়িক স্বনির্ভর সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে রবিবার বাঙালী জাতি অন্যরকম স্বস্তি ও উৎসবের আমেজে পালন করলো মহান স্বাধীনতার ৪৬ বছর পূর্তি ও জাতীয় দিবস। শ্রদ্ধাবনত জাতি ফুলে ফুলে ভরে দেয় সাভারস্থ জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ধানম-ির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি এবং টুঙ্গিপাড়ার বঙ্গবন্ধুর মাজারের বেদিমূল। লাল-সবুজ পতাকা হাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের কণ্ঠেই ধ্বনিত হয়েছে একই সেøাগান- ‘মুজিবের বাংলায়, স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গীদের ঠাঁই নাই, জামায়াত-শিবির-রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়।’ তবে স্বাধীনতা দিবসে আনন্দমুখর এ উৎসবে বরাবরের মতো এবারও অন্তঃস্রোতে বয়ে গেছে স্বজন হারানোর বেদনা। আর বাঙালীর জাতীয় জীবনে আনন্দ-বেদনার এমন দ্বৈরথের ঘটনা খুব বেশি নেই। বাঙালী জাতি আনন্দ আর বেদনার মহাকাব্য স্বাধীনতার সংগ্রামে একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অসম সাহসিকতা আর হাজারো নারীর আত্মত্যাগের বীরত্বগাঁথা। অন্যদিকে বর্বর পাকসেনা আর রাজাকার-আলবদরদের নীচুতা, শঠতা ও হিংস্রতার কলঙ্কময় ইতিহাস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় ৪৬ বছর আগের এ দিনে পাকিস্তানী বাহিনীর দমন অভিযানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ ভূখ-ের মানুষ। তার পরের ৯ মাস পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর চক্র চালিয়েছে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। তাই স্বাধীনতা দিবসের এই দিনে দেশবাসী শ্রদ্ধা আর বেদনায় স্মরণ করে যুদ্ধে নিহত স্বজনদের আর অসম লড়াইয়ে বিজয়ী রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। রবিবার পুরো রাজধানী থেকে শুরু করে সাভার স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত পরিণত হয়েছিল উৎসবের সেøাগানে বজ্রভূমিতে। যেখানে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা লাল-সবুজে সজ্জিত হয়ে পথে নেমেছিলেন জাতির প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের দাবিতে। পথে পথে ব্যান্ড বাজিয়ে, গলা ছেড়ে দেশের গান গেয়ে, সেøাগানে সেøাগানে আশপাশ সচকিত করে তরুণরা প্রাণস্পন্দিত করে রেখেছিল স্বাধীনতার এ দিনটিকে। রবিবার প্রত্যুষে তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে সূচনা হয় স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানমালার। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সশস্ত্র বাহিনীর একটি সুসজ্জিত চৌকস দল এ সময় গার্ড অব অনার প্রদান করে। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। পরে রাষ্ট্রপতি স্মৃতিসৌধের পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করেন। জাতীয় সংসদের স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিচারপতি, তিন বাহিনীর প্রধানসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে দলীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। প্রায় ১৫ মিনিট সময় প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে অবস্থান করেন। রাষ্ট্রপতি স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করার পর উপস্থিত সকলের সঙ্গে করমর্দন করেন। সকাল ৭টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানম-ি ৩২ নম্বর সড়কে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে শিশু-কিশোরদের সমাবেশে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন এবং বক্তব্য রাখেন। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রবিবার ছিল সরকারী ছুটি। স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বেতার, টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হয়। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন ভবনে, বাড়িঘর, যানবাহন ও দোকানে উড়েছে জাতীয় পতাকা। সরকারী গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলোতে আলোকসজ্জা করা হয়। সারাদেশে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মসজিদে বিশেষ মোনাজাতে শহীদদের আত্মার মাগফেরাত, দেশের শান্তি ও অগ্রগতি কামনা করা হয়। মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাতেও অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ প্রার্থনা সভা। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন-প্রতিষ্ঠান আনন্দ শোভাযাত্রা, আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মহান স্বাধীনতা দিবস পালন করে। টুঙ্গিপাড়াতেও নেমেছিল স্বাধীনতার পক্ষের মানুষের ঢল। অজস্র মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলির ফুলে ফুলে ভরে উঠে স্বাধীনতার মহান স্থপতির মাজারের বেদিমূল। সশস্ত্র বাহিনীও যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্র, হাসপাতাল, জেলাখানা, সরকারী শিশুসনদসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিপুল সংখ্যক সাংবাদিকরা রবিবার দেশের জন্মদিনে জাতীয় প্রেসক্লাবে স্থাপিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেছেন। ক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে সাংবাদিকরা শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্ট ও মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাতে অংশ নেন। বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণ জনারণ্য ॥ দেশের জন্মদিনে ধানম-ির ৩২ নম্বর ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণ রবিবার ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল জনারণ্য। অজস্র কৃতজ্ঞ বাঙালী বিনম্র শ্রদ্ধা জানান স্বাধীন রাষ্ট্রের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাগরণী দেশাত্মবোধক গান, সেøাগান আর মিছিলে মিছিলে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন প্রাঙ্গণ দিনভর ছিল মুখরিত। হাজার হাজার মানুষ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ঘুরে ঘুরে দেখেন। সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধানম-িস্থ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিকৃতির সামনে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে দলের নেতাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরী, এ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুর রাজ্জাক, আবদুল মান্নান খান, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, ড. আবদুস সোবহান গোলাম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রমুখ। প্রধানমন্ত্রীর পর জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধানমন্ত্রী এলাকা ত্যাগ করলে সর্বসাধারণের জন্য স্থানটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এরপর দুপুর অবধি দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অজস্র সংগঠন বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে উপস্থিত হাজারো জনতার ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’Ñ সেøাগানে পুরো এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, আওয়ামী যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, তাঁতী লীগ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, জাতীয় মহিলা শ্রমিক লীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, বঙ্গবন্ধু আইন পরিষদসহ বিভিন্ন দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বঙ্গভবনে এক অন্যরকম মিলনমেলা ॥ বাংলাদেশের জন্মদিনে সরকার প্রধান থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, কূটনীতিক, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবার, শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতিতে সত্যিই এক অন্যরকম মিলনমেলা পরিণত হয়েছিল রবিবার বঙ্গভবনে। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের আমন্ত্রণে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবার উপস্থিতিতে সরগরম ছিল বঙ্গভবনের সবুজ প্রাঙ্গণ। লাল-সবুজ পাতা দিয়ে তৈরি একটি পতাকা অনুষ্ঠানে আনে ভিন্নমাত্রা। খ্যাতনামা শিল্পীদের দেশাত্মবোধক ও লোকগান এবং শিশুশিল্পী ও সশস্ত্র বাহিনীর বাদক দলের সঙ্গীতের মূর্ছনায় এই অনুষ্ঠানে আনে মনোমুগ্ধকর আমেজ। স্বাধীনতা দিবসে অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ; তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকেলে পৌনে ৫টায় স্ত্রী রাশেদা খানমকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনের মাঠে আসেন রাষ্ট্রপতি। তার কিছুক্ষণ আগেই বঙ্গভবনে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি সস্ত্রীক মঞ্চে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীত। এরপর পরস্পর কুশল বিনিময় করেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। পরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবারের সদস্যসহ আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তারা। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেয়ার পাশাপাশি তাদের সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দেন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান দুইজনই। এরপর বঙ্গভবনের মাঠে ভিভিআইপি এনক্লোজারে স্বাধীনতা দিবসের কেট কাটেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। এরপর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ঘুরে ঘুরে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, বিদেশী অতিথি, সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি, সংসদ সদস্য, গণমাধ্যমের সম্পাদক, খেতাবপ্রাপ্ত দেশের বিশিষ্টজন, তিন বাহিনীর প্রধানসহ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সংরক্ষিত এলাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে বসেন জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। বঙ্গভবনের এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, ড. গওহর রিজভী প্রমুখ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা, এ্যাটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলম, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, সিপিবির মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, ফখরুল ইমাম, এনডিএফের চেয়ারম্যান শেখ শওকত হোসেন নিলু, শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু, হুইপ শাহাব উদ্দিনও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির কোন নেতাকে দেখা না গেলেও এই দলটি ছেড়ে আসা শমসের মবিন চৌধুরীও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রীংলা, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট, ব্রিটিশ হাইকমিশনার এলিসন বেইক, পাকিস্তানের হাইকমিশনার রাফিউজ্জামাস সিদ্দিকীসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। দেশের খ্যাতনামা শিল্পী শাহীন সামাদ, খুরশিদ আলম, এস আই টুটুল, রাজীব, অনুপমা মুক্তি ও দেবলীনা গানের সুরে সুরে মোহিত করেন সবাইকে। স্মারক ডাকটিকেট অবমুক্ত প্রধানমন্ত্রীর ॥ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে ১০ টাকা মূল্যমানের স্মারক ডাকটিকেট, উদ্বোধনী খাম এবং পাঁচ টাকা মূল্যমানের ডাটা কার্ড প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। এ উপলক্ষে একটি বিশেষ সিলমোহরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিকেলে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ডাকটিকেট, উদ্বোধনী খাম ও ডাটা কার্ড অবমুক্ত করেন। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব শ্যাম সুন্দর শিকদার, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মহাপরিচালক সুশান্ত কুমার ম-ল, স্ট্যাম্পস পরিচালক মুনছুর রহমান মোল্লা প্রমুখ। ডাকটিকেট, উদ্বোধনী খাম ও ডাটা কার্ড রবিবার থেকেই ঢাকা জিপিও-এর ফিলাটেলিক ব্যুরো কার্যালয় থেকে বিক্রি হচ্ছে। পরবর্তীতে দেশের সব ডাকঘর থেকে এ স্মারক ডাকটিকেট বিক্রি করা হবে। দিনভর নানা অনুষ্ঠানে শহীদদের স্মরণ ॥ ‘আঁধার কাটুক হাজার আলোয়’Ñ শিরোনামে গণহত্যা দিবস স্মরণে শনিবার রাত ১২টা ১ মিনিটে এক হাজার মোমবাতি প্রজ্বলন ও আলোচনা সভার আয়োজন করে বেসরকারী টিভি চ্যানেল আরটিভি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তি পাকিস্তানের প্রতি দরদ দেখিয়ে গণহত্যা দিবসে কোন কর্মসূচী পালন করেনি বিএনপি। তিনি বলেন, বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধীদের লালনকারী, আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা। গণহত্যা দিবস পালন করলে পাকিস্তান কষ্ট পাবে বলে বিএনপি কোন কর্মসূচী পালন না করে ঘরে বসেছিল। অথচ অন্য সময় প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন কর্মসূচীতে বক্তব্য রাখেন দলটির নেতারা। গণহত্যা দিবসে বিএনপির এই আচরণ বাঙালী জাতি বিস্মিত হয়েছে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যারা ২১টি বছর ক্ষমতায় ছিল তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করেছিল। শেখ হাসিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন। জাতির পিতাসহ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির বহু চেষ্টা করেছে বিএনপি। কিন্তু সফল হয়নি। আগামী নির্বাচনে একাত্তরের পরাজিত শক্তির দোসরদের বিরুদ্ধে গণরায় দেবে জনগণ। আগামী নির্বাচন হবে পাকিস্তানী দোসরদের পরাজিত করার নির্বাচন। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু, কাজী ফিরোজ রশিদ ও নূর জাহান বেগম মুক্তা, আরটিভির নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আশিক রহমান প্রমুখ।
×