ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লুৎফর রহমান

ষাট পূর্ণ করলেন মঞ্চকুসুম

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২৩ মার্চ ২০১৭

ষাট পূর্ণ করলেন মঞ্চকুসুম

ষাট পূর্ণ করলেন মঞ্চকুসুম। বাংলাদেশের থিয়েটারে শিমুল ইউসুফ মঞ্চকুসুম অভিধায় খ্যাত। এ দেশে মঞ্চনাটকের লতা যখন আলোর ভুবনে মাত্র বিকাশমান শিমুল ইউসুফ তখন কুঁড়ি হয়ে সঞ্চরমান ছিলেন। ঢাকা থিয়েটার তার মৃত্তিকা, রস, চেতনার অনুকূল জল-হাওয়া, পরিবেশ এবং আবশ্যকীয় পরিচর্যা দ্বারা তাকে করেছে পূর্ণবিকশিত মঞ্চকুসুম। ঢাকা থিয়েটার বাঙালী সংস্কৃতির শিকড় সন্ধানী অভিযাত্রায় বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার নামক সংগঠনের আওতায় যে কর্মযজ্ঞ আরম্ভ করে, সেই সাধনার ফসল শিমুল ইউসুফ। শিমুল একা নন, সেই যজ্ঞানীর সৃষ্টি আরও অনেকে। তার হয়ে ওঠাকে কোন অবস্থায়ই তাই এককভাবে দেখবার অবকাশ নেই। এর সঙ্গে যুক্ত সেলিম আল দীন শিল্পীসত্তার বিকাশ, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ নির্দেশকসত্তার বিকাশ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, হুমায়ুন ফরিদী, আফজাল হোসেন, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সবর্ণা মুস্তাফা এবং আরও অনেকের অভিনয়শিল্পীসত্তার বিকাশের সম্পর্ক। শিমুল ইউসুফ সকলের মধ্যে শীর্ষস্পর্শী এ কারণে যে, তার সব প্রয়াস মঞ্চালোকে বর্ণিল, উজ্জ্বল, লোকচক্ষুর সম্মুখে দেদীপ্যমান। তিনি অভিনয় করেন নানা রঙের নানাগুণের, নানা বয়সের, ভিন্ন ভিন্ন সময়ের, সমাজের ও সামাজিক অবস্থায় বসবাসকারী নারীর চরিত্রে। সে সব চরিত্রের দুঃখ-সুখের বেলোয়ারি কাঁদন-হাসনের আলো-ছায়ায় উদ্ভাসিত তার অভিনেত্রীসত্তা। সেখানে নিয়ত ভাঙ্গা-গড়ার লীলা, আছে আত্মাবিষ্কার, আত্মনির্মাণ ও আত্মপ্রকাশের আকাক্সক্ষা এবং উপায় উদ্ভাবনের সাধনা। পরিপূর্ণ ও পরিণত শিল্পবোধ একজন অভিনয়শিল্পীর মূল পাথেয়। অভিনয় কলার ওপর রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ, পৃথিবীর বিভিন্ন তাত্ত্বিকের অভিনয়তত্ত্বে বুৎপন্ন কিন্তু তিনি উন্নত শিল্পবোধের অধিকারী নন; অভিনয়শিল্পী হিসেবে তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ নাট্যকারের টেক্সট পাঠ, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, আখ্যানের অন্তর্গত চরিত্রের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অবস্থানটি যথার্থরূপে শনাক্ত করতে হয় একজন অভিনয়শিল্পীকে। আরও জানতে হয়, চরিত্রের শিক্ষাগত যোগ্যতা, তার মানসিক যোগ্যতা, সমাজ সম্পর্ক এবং উৎপাদন সম্পর্কের ধরন ও পর্যায়টি। এখানে থামলেই চলে নাÑ নাটকটি কোন্ শিল্পমতবাদের অধীন, কোন্ আঙ্গিকের, রসগত বিচারে কোন্ রসের তাও উপলব্ধি করার যোগ্যতা থাকা চাই অভিনয়শিল্পীর। শিমুল বিল্লাহ পরবর্তীকালে শিমুল ইউসুফ হন সৃজনশীল নির্দেশক নাসিরউদ্দীন ইউসুফের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে এসে। তাদের ব্যক্তি সম্পর্কের পরিণতি বাংলা দেশের থিয়েটারের জন্য পরম আশীর্বাদ হয়েছিল নিঃসন্দেহে। নাসির উদ্দীন ইউসুফের প্রিয়তম বন্ধু এ কালের যুগস্রষ্টা নাট্যকার বাংলা নাটকের প্রকৃত মুক্তি দাতা নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনকে তিনি অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন। এই দুই যুগন্ধর প্রতিভার সংশ্লেষ তাকে মঞ্চকুসুম হয়ে প্রস্ফুটিত করেছে যথাবিধি ও যথাসময়ে। তারও আগে তাকে শিল্পভুবনের পরকাষ্ঠা যে সঙ্গীত তাতে দীক্ষা দান করেছিলেন অমর সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ। জাগ্রত বাঙালী চৈতন্যের অন্যতম অকুতোভয় সৈনিক, দেশপ্রেমে উজ্জ্বল, দুঃসাহসী ব্যক্তিত্ব আলতাফ মাহমুদ নিহত হন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে। বড় বোন ঝিনু আপার স্বামী আলতাফ মাহমুদÑ পিতৃস্নেহে শিমুল ইউসুফের শিল্পীসত্তাকে গড়ে দিয়েছেন। অভিনয়শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী শিমুলের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ অবিস্মরণীয় শোকস্থান, অনিরাময়যোগ্য সজীব ক্ষত; তার জীবনের সর্বাপেক্ষা স্পর্শকাতর বিষয়। শিমুলকে বুঝতে হলে তার এই অকৃত্রিম আবেগের গভীরতা উপলব্ধি করা অবশ্যই জরুরী। অতএব উপরি-বর্ণিত আলোচনার আলোকে যৌক্তিক কারণেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় যে, শিমুল ইউসুফ অভিনেত্রীসত্তার উদ্ভাসনে তিন যুগস্রষ্টা শিল্পীরÑ আলতাফ মাহমুদ (সুরস্রষ্টা), সেলিম আল দীন (বাংলা নাটকের স্রষ্টা এবং দ্বৈত-অদ্বৈতবাদের স্রষ্টা), নাসিরউদ্দীন ইউসুফের (বাংলাদেশের আধুনিক থিয়েটারের ইতিহাসে সৃজনশীল নাট্যনির্দেশকÑ যার নাট্যনির্দেশনার বিভিন্ন স্তরকে একটি তাত্ত্বিক কাঠামোদান করা যেতে পারে এবং তিনি দক্ষ চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিজ্ঞ কুশলী সংগঠক এবং বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সভাপতি) রয়েছে অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আলতাফ মাহমুদের নিকট শিক্ষালব্ধ সঙ্গীতজ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে শিমুল সুরস্রষ্টা হয়ে ওঠেনÑ থিয়েটারে সঙ্গীতের ধরনটি আত্মস্থ করে। ঢাকা থিয়েটারের নাটকে সঙ্গীত আবহ সঙ্গীত নয়, আরও কিছু; নাটকের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্ণনা-কথা-নৃত্য-বাদ্য-সঙ্গীত এই পঞ্চ উপাদানের অন্যতম উপাদান সঙ্গীত। অন্য সব উপাদানের সঙ্গে সমগুরুত্বেই শুধু নয়, বরং অধিকতর গুরুত্বে বিচার্য সঙ্গীত। আখ্যান, পরিবেশ পরিস্থিতি উপস্থাপিত হয় সঙ্গীতে। চরিত্রের সংলাপ ও তার মানসিক অবস্থা আবেগ, অনুভূতি, অনুরাগ, বিরহ, অভিপ্রায় ইত্যাদি বর্ণিত হয় সঙ্গীতের মাধ্যমে। ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের আধুনিক মঞ্চরূপটি গড়ে ওঠে সেলিম আল দীনের হাতেÑ তাত্ত্বিক কাঠামোটিও। মহাকাব্যিক আখ্যান বর্ণনার ধারায় এ রীতির আশ্রয়ে নাট্যকারগণ নাটক রচনা করেন। এক কালের সঙ্গীতশিল্পী শিমুল বিল্লাহ সঙ্গীতের সুর ও বিচিত্র রাগের বাঁধনে মঞ্চের অভিনয়কলাকে আপন দক্ষতায় বেঁধেছেন আঙ্গিক, বাচিক ও সাত্তিক অভিনয়ের ছাঁদে। উপস্থাপনায় সাধারণেরও বোধগম্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে বিনোদিনী এবং তার অভিনীত বিপরীতধর্মী বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের অধিকারী ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের আত্মার জীবন্ত ছবি সর্বসম্মুখে মূর্ত করেন অবলীলায়। প্রত্যেকটি চরিত্র অভিনেত্রীর অস্তিত্বের এক একটি প্রতিফলন হিসেবে মঞ্চভূমিতে দর্শকের দৃষ্টি জুড়ে থাকে। মঞ্চে চরিত্রের ব্যাখ্যা তাই লেখক সৃষ্ট চরিত্র নয়, নাট্যকার সৃষ্ট চরিত্রটি অভিনয়শিল্পীর জীবনবোধ, সামাজিক চেতনা, পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধিতে যে রূপে মূর্ত হয় সেই রূপে উপস্থাপন, সেই বিশেষ রূপটিকে উপস্থাপন। অভিনয় শিল্পীর এ এক দুর্লভ সৃজন ক্ষমতা। শিমূল ইউসুফ শুধু অভিনয় শিল্পী হলে তিনি অন্য দশজন অভিনেত্রীর মতোই চরিত্র রূপায়ণের চিন্তায়ই নিমগ্ন থাকতেন। কাব্যিক বর্ণনা সমৃদ্ধ বিশেষ ধরনের আখ্যান, নিজস্ব ধারার নৃত্য, কথা (চরিত্রের উক্তি, প্রত্যুক্তি), নানা রাগের সুরে বাঁধা সঙ্গীত এবং নানা বাদ্যযন্ত্রের সহযোগে ঐকতান সৃষ্টির উপযোগী ঐতিহ্যবাহী বাংলার নাট্যের বিচিত্র ও বৈচিত্র্যপূর্ণ আঙ্গিক, এ সব আঙ্গিকের বিশিষ্টতা, স্বাতন্ত্র্যকে তাত্ত্বিকভাবে উপলব্ধি করতে ও আয়ত্ত করতে প্রয়াসী ছিলেন। নাট্য আঙ্গিকের মতো ঐতিহ্যবাহী বাংলা অভিনয় রীতিটিও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের ওপর প্রতিষ্ঠিতÑ হাজার বছর ধরে পরম্পরায় তাকে চলমান রেখেছেন আমাদের লোকগায়েন অভিনেতৃবর্গ। উপরি-কথিত আঙ্গিকের বাংলা নাটকের ধারক, বাহক বাংলার লোকগায়েনরা তাই তার কাছে নমস্য। তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক উভয় দিক থেকে সমৃদ্ধ শিমুল ইউসুফ তাই একাধারে, অভিনয়শিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, পোশাক পরিকল্পনা শিল্পী, নৃত্যশিল্পী, কোরিওগ্রাফ শিল্পী এবং সফল নাট্যনির্দেশক। ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের আঙ্গিক ও অভিনয় রীতিকে আধুনিক নাগরিক থিয়েটারে শিক্ষিত পরিশীলিত শিল্পরুচিসম্পন্ন দর্শকের সম্মুখে পৌঁছে দেয়ার সংগ্রামে তিনি অন্যতম অগ্রণী। তার পরিণত শিল্পজ্ঞান, অভিজ্ঞতা আরও সোনার ফসল ফলাবে আমাদের মঞ্চের ইতিহাসে ষাট বছর পূর্তির দিনে এটাই একমাত্র প্রত্যাশা। শ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্তে শিমুল ইউসুফের নিরোগ কর্মময় জীবন প্রত্যাশা করছি।
×