ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অস্বাভাবিক বৃষ্টি লাখ লাখ টন আলু বিনষ্টের আশঙ্কা

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২৩ মার্চ ২০১৭

অস্বাভাবিক বৃষ্টি  লাখ লাখ টন আলু বিনষ্টের আশঙ্কা

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ কান্দার বাড়ি চরের বাসিন্দা জামাল শেখ। এ বছর চার কানি (সাড়ে ৫ একর ৬০ শতাংশ) জমিতে আলু চাষ করেন। এ পর্যন্ত তিনি দু’কানি জমির আলু ঘরে তুলতে পারলেও বাকি আলু এখন মাঠে। মাঠের এই আলুতে বৃষ্টি পানি জমে নাজুক অবস্থা। এই দু’কানি জমিতে প্রায় ১ হাজার মন আলু ঘরে তোলার কথা। কিন্তু এর অধিকাংশই বিনষ্ট হয়েছে। গত কয়েক দিনে তিন দফায় ৯ দিন বৃষ্টিতে আলুর উঠতি মৌসুমে কৃষকের সর্বনাশ হয়েছে। কান্দরবাড়ি চকের বিস্তীর্ণ জমিতে এখন বিনষ্ট হওয়ার করুন চিত্র। ক’দিন আগেও এই চকের দিকে তাকিরে আলুর সবুজ বাগান দেখের কৃষকের বুকে ছিল অনেব বড় আশা। আর মুখে হাসি। কিন্তু এখন এর উল্টো চিত্র। চকের দিকে তাকাতেই হাহাকার। জামাল শেখ বৃষ্টি পানি সরাতে গত শনিবার রাতভর পাম্প লাগিয়েও রক্ষা করতে পারেনি। পরদিনই রবিবার আবার বৃষ্টি। এরপর রোদ উঠলে আশার আলো উকি দেয়। সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার বৃষ্টি হয়নি। এই সুযোগে মাঠ শুকানোর পর বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার আলু তুলে উচ্চ মজুরির শ্রমিক লাগিয়ে। কিছু আলু উত্তেলান করতেই আবার আকাশ ভেঙ্গে শানিবার বৃষ্টি। এই বৃষ্টি রবিবার আবার সোমবারও। শ্রমিকের অভাবে আরও দুই কানি জমির আলু তুলতে পারলেন না। এখন ভারি বৃষ্টিতে পানি জমে আলে আলুর কেইলে কেইলে। তাই অধিকাংশ আলু পচে যাচ্ছে। জামাল শেখের মতো বহু কৃষক এখন দিশেহারা। এই চকের বনি শাহ, রাসেল শেখ, আসলাম হালদারের কষ্টের যেন সীমা নেই। রাত-দিন জমির পানি সরিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। কৃষকরা সোনার ফসল রক্ষার জন্য কত চেষ্টা যে করছেন, এই চকে তাকালে তা বোঝা যায়। পাম্প ছাড়াও ক্যানেল করে পানি সরানোর চেষ্টা করছেন। আর যেখানে তাও সম্ভব নয় সেখানে বালতি, মগ এবং কলসি ভরে ভরে কৃষক কৃষাণীরা পানি সরাচ্ছেন। দিঘিরপাড় ইউপির নির্বাচিত সদস্য আসলাম হালদার জানান, অন্য বছরও বৃষ্টি হয়। তবে এ রকম বৃষ্টি নয়। মাত্র এক দফা হালকা বৃষ্টি। এতে আলু তোলার পর এই বৃষ্টি কৃষকের পাট, ধান, তিল ভুট্টা ও ধইঞ্চাসহ অন্য ফসল রোপণে সহায়ক হয়। কিন্তু এবারের বৃষ্টি একেবারেই অস্বাভাবিক। স্মরণকালের কোন সময়ই এই ফাল্গুনের শেষে এবং চৈত্রের প্রথম সপ্তাহে এমন বৃষ্টি কখনই হয়নি। এছাড়া আলু রোপণের সময়ও ছিল অস্বাভাবিকতা। বৃষ্টি নেমে যাওয়ায় গড়ে অন্তত এক সপ্তাহ লামি (বিলম্ব চাষ) হয়েছে। আর সে কারণেই আলু উত্তোলনের মৌসুমও বিলম্বিত হয়। আর সেই সুযোগ কড়ায়গ-ায় গুনতে হচ্ছে। এই বৃষ্টি লামি আলুর তুলতে আরও বিলম্বিত করে। আবার অধিকাংশ জমিতে এখন আলু তোলার সুযোগই সৃষ্টি করতে দেয়নি। এ ক্ষেতে আরেক সমস্যা শ্রমিক সঙ্কট। বৃষ্টির কারণে রোদ উঠতেই একযোগে সব চাষী আলু তোলার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই পরিমাণ শ্রমিক নেই। এতে শ্রমিকে বাজারেও আগুন। ৩শ’ টাকার দিন প্রতি মজুরি দিতে হচ্ছে সাড়ে ৫শ’। তারপর ও শ্রমিক পাওয়া যেন সোনার হরিণ। চড়া মজুরিতেও শুধু শ্রমিক না পাওয়ার কারণে অনেকের আলু পচে গেছে। তবে আলু তোল জন্য আধুনিক কোন যন্ত্র ব্যবহার করা যায়নি। বৃষ্টি হলে যাতে দ্রুত পানি নেমে যেতে পারে সে লক্ষ্যে জমিগুলোতে ড্রেনেজ ব্যবস্থাও নেই। বরং আশপাশের খাল-বিল-পুকুর এমনভাবে ভরাট হয়েছে আমান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা। হামিদ সরকার বলেন, যত ভারি বৃষ্টিই হউক বিশাল স্টেডিয়ামে কোন পানি জমছে না। অথচ আলুর মাঠে বৃষ্টি মানেই জলাবদ্ধতা। ঘন ঘন এই বৃষ্টির কারণে আলুর ব্যাপক ক্ষতিতে আলুর বাজারেও বড় পরিবর্তন এসেছে। আলু তোলার শুরুতে মার্চের প্রথম সপ্তাহে মণপ্রতি আলুর দাম ছিল গড়ে ৩শ’ ৮০ টাকা। কিন্তু ২ সপ্তাহের ব্যবধানে এই দর এখন ৫শ’। মণপ্রতি ১২০ টাকা বেড়ে যাওয়া বড় রকমের প্রভাব। এদিকে আলুর সংক্ষেণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই হিমাগারগুলোতে এখন আলুর অভাবে দৌড়ঝাঁপ করছে। অথচ অন্যান্য মৌসুমে থাকে এর উল্টো চিত্র। কৃষক আলুর রাখার জন্য হিমাগারের দারে দারে ঘোরে। মুন্সীগঞ্জের ৬৯ হিমাগারের আলু সংরক্ষণের ধারণক্ষমতা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ ৪২ হাজার টন। মুন্সীগঞ্জে গত মৌসুমে আলু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৩ লাখ ৫১ হাজার টন। চলতি মৌসুমে রেকর্ডসংখ্যক ৩৯ হাজার ৩শ’ হেক্টর জমিতে আরও চেয়ে বেশি আলু উৎপাদনের কথা ছিল। উৎপাদন হয়েও ছিল। কিন্তু তুলে আনতে না পারার কারণে মাঠে বিনষ্ট হচ্ছে লাখ লাখ টন আলু। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ হুমায়ুন কাবর আলুর মাঠ ঘুরে এসে জানান, মঙ্গলবার খড়া থাকায় আলু উত্তোলন সম্ভব হয়েছে। ৩০ হাজার ৩১০ হেক্টর জমির আলু উত্তোলন সম্ভব হয়েছে। এখনও প্রায় ৯ হাজার হেক্টর জমির আলু তোলা বাকি রয়েছে। উত্তোলনের হার প্রায় ৭৭ শতাংশ। তিনি সোমবারও দুর্গম এলাকায় অবস্থান করেন। সদর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল আধারায় অবস্থান করেন। সারাদিন ধরে তিনি মাঠ ঘুরে বিকেলে শিলই ইউপির পদ্মার চর পূর্ব রাখি গ্রাম ঘুরে রাতে শহরে ফিরেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বলেন, ২৩০ হেক্টর জমি এই বৃষ্টির কারণে দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে, তবে ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য সব চেষ্টা চলছে। তিনি জানান, কৃষি বিভাগের সকলেই আলুর মাঠে। কৃষকদের পাশে থেকে ক্ষতি কমিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে আলুর ক্ষতি যেগুলো হয়েছে, সেই ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। এদিকে আলু তুলে আনতে না পারার কারণে আলু উৎপাদনের সর্ববৃহত জেলা মুন্সীগঞ্জের আলুভিত্তিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পরেছে। এখানকার বহু কৃষক সর্বস্বান্ত হওয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। অনেক প্রান্তিক কৃষক স্ত্রীর স্বর্ণালঙ্কার বা গরু-ছাগল বন্ধক রেখে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আলু চাষ করে এখন পুজিই উঠাতে পারেনি। যে কারণে এই বৃষ্টি ॥ বৃষ্টিপাতের ধরনের পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। এ বছর ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি কোন বৃষ্টিই হয়নি। যা ছিল অস্বাভাবিক। তেমনি মার্চের প্রথমদিকেই ভারি বৃষ্টিপাত আগাম বর্ষার আলামত দেখাচ্ছে। এই বৃষ্টি অভাবেই এবার শীত ঋতুও অপেক্ষাকৃত আগে বিদায় নেয়। এই বিষয়ে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মোঃ আরিফুর রহমান জানান, সাধারণরত ডিসেম্বরে এক দফা বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু তা হয়নি। একইভাবে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতেও ২ থেকে ৫ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। কিন্তু এই তিনমাসেই কোন বৃষ্টিপাত হয়নি। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের কারণেই বৃষ্টি পাত হয়নি শীতের শেষদিকে। সোমবারের বৃষ্টিও হয়েছে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয়বাষ্প থেকে। আর এই বৃষ্টির কারণেই বসন্তেও শীত। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছেÑ যেন শীত ঋতু। কখনও প্রচ- গরম আবার কখন শীতের কাঁপন। অনেকের ঘর থেকে বের হচ্ছেনÑ গরম কাপড় নিয়ে। আর ঘরে লেপ-কম্বল তুলে রাখলেও আবার নামাতে হচ্ছে। এই আবহাওয়ার অস্বাভাবিকতায় চাষবাসে ক্ষতি ছাড়াও মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমনটি হচ্ছে। এভাবেই বৃষ্টিপাত চলতে থাকলে আলু পরবর্তী ফসলেও ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া আগাম বন্যারও আশঙ্কা করা যাচ্ছে। অকালের এই বৃষ্টি আরও সময় ভোগাতে পারে বলেও পরিবেশবিদরা জানান। গত বর্ষায় হালকা বন্যা হলেও এ বছর বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। নানা কারণেই ১৯৮৮ সালের বন্যার কথা স্মরণ করছে স্থানীয় কৃষক। দীঘিরপাড়ের কৃষক শহিদুল হালদার জানান, ’৮৮ তে ১৫০ টাকা বস্তা (দু’মণ) দরে আলু সংরক্ষণ করে পরে ১ হাজার টাকা দরে বিক্রি করেন।
×