ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মহাজীবনের আরেক অধ্যায় ‘কারাগারের রোজনামচা’

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৭ মার্চ ২০১৭

মহাজীবনের আরেক অধ্যায় ‘কারাগারের রোজনামচা’

মোরসালিন মিজান ॥ মহাজীবনের আরও একটি অধ্যায় উন্মোচিত হলো। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জেলজীবনের কথা ওঠে এলো এবার। অত্যন্ত ঘটনাবহুল সময়ের স্মৃতি, যখন যেটুকু সম্ভব, নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন জাতির জনক। প্রিয় পতœী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের পরামর্শ ও অনুপ্রেরণায় লেখা। অমূল্য এই সম্পদ রক্ষার বিপুল সংগ্রাম করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে। এবং আশার কথা যে, তাঁরা যারপরনাই সফল। জানা যায়, ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়ার সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ডায়েরি দুটো যথারীতি জব্দ করেছিল। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে এবং পুলিশের বিশেষ শাখার সহায়তায় উদ্ধারকৃত একটি ডায়েরি ‘কারাগারের রোজনামচা’ শিরোনামে প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। আজ ১৭ মার্চ জাতির জনকের জন্মের শুভক্ষণ থেকে গ্রন্থটি সংগ্রহ করা যাবে। উন্নত মানের দৃষ্টিনন্দন প্রকাশনা। শিল্পী রাসেল কান্তি দাশ অঙ্কিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি অবলম্বনে গ্রন্থটির চমৎকার প্রচ্ছদ ও নক্সা করেছেন তারিক সুজাত। কিছুকাল আগে প্রকাশিত হয় জাতির জনকের মৌলিক রচনা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী।’ অনেকে মনে করতে পারেন নতুন গ্রন্থটি পূর্বে প্রকাশিত গ্রন্থের দ্বিতীয় খ-। আদতে তা নয়। একদমই নতুন। একদমই ভিন্ন প্রেক্ষাপট এই গ্রন্থে। অন্ধকার কারাগারে বসে লেখা ডায়েরির পাতায় ইতিসের আলোকিত অধ্যায়। জেলের ভেতরের জীবন নয় শুধু, ষাটের দশকের উত্তাল সময় আর ঘটনাবহুল রাজনীতির কথা লিখেছেন কিংবদন্তি নেতা। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ কালপর্বের বয়ান এত সরল এত প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করেছেন যে, এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলার ইচ্ছে হবে। গ্রন্থ প্রণয়নের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরেই পা-ুলিপি সংরক্ষণ করছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একটি নাতিদীর্ঘ ভূমিকাও লিখেছেন তিনি। কৌতূহলী পাঠকের জন্য সেখানে রয়েছে বইয়ের আগে পরের খুঁটিনাটিগুলো জানার চমৎকার সুযোগ। প্রথমেই বলতে হয় ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দূরদৃষ্টির কথা। সে কথা জানিয়ে কন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধে আব্বা লিখতে শুরু করেন। যতবার জেলে গেছেন আমার মা খাতা কিনে জেলে পৌঁছে দিতেন আবার যখন মুক্তি পেতেন তখন খাতাগুলি সংগ্রহ করে নিজে সযতেœ রেখে দিতেন। তাঁর এই দূরদর্শী চিন্তা যদি না থাকত তাহলে এই মূল্যবান লেখা আমরা জাতির কাছে তুলে দিতে পারতাম না।’ একইভাবে তিনি জানিয়েছেন, গ্রন্থটি নিয়ে বিশেষ আবেগ ও ভালবাসা ছিল ছোট বোন শেখ রেহানার। গ্রন্থের নামকরণের কাজটিও রেহানা করেছেন বলে ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন শেখ হাসিনা। আর তার নিজের আবেগটুকু অনুমান করা যায় যখন তিনি লিখেন, ‘এতটা বছর বুকে আগলে রেখেছি যে অমূল্য সম্পদ-আজ তা তুলে দিলাম বাংলার জনগণের হাতে।’ খুব সহজেই অনুমান করা যায়, জেলখানায় বসে লেখার কাজটি খুব সহজ ছিল না। একদমই নির্বিঘœ ছিল না। শেখ হাসিনাও সে কথার উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন, ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যে খাতা দেয়া হতো, তার পাতাগুলি গুনে নম্বর লিখে দিত। প্রতিটি খাতা সেন্সর করে কর্তৃপক্ষের সই ও সিল দিয়ে দিত।’ এতকিছুর পরও এই সম্পদ আজ ঠিকই পৌছে যাবে পাঠকের হাতে। বইয়ে বঙ্গবন্ধুর কারাগারের স্মৃতি। একই লেখা হয়ে ওঠেছে কালের সাক্ষী। ইতিহাসের অমূল্য স্মারক। বার বার এসেছে জেল জীবনের দুঃখ-কষ্টের কথা। মহান নেতা লিখেছেন, ‘জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটে নাইÑতারা জানে না জেল কি জিনিস। বাইরে থেকে মানুষের যে ধারণা জেল সম্বন্ধে ভিতরে তার একদম উল্টা। জনসাধারণ মনে করে চারদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা, ভিতরে সমস্ত কয়েদি এক সঙ্গে থাকে, তাহা নয়। জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে। কারাগার যার একটা আলাদা দুনিয়া। এখানে আইনের বইতে যত রকম শাস্তি আছে সকল রকম শাস্তিপ্রাপ্ত লোকই পাওয়া যায়। খুনী, ডাকাত, চোর, বদমায়েশ, পাগলÑ নানা রকম লোক এক জায়গায় থাকে।’ এর পর কিছুটা যেন বেদনার সুর। লিখেন, ‘রাজবন্দিও আছে।’ নিজের জেল জীবনের আরও একটু ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন, ‘রাজবন্দি হিসেবে জেল খেটেছি, সশ্রম কারাদ-ও ভোগ করতে হয়েছে। আবার হাজতি হিসেবেও জেল খাটতে হয়েছে। তাই সকল রকম কয়েদির অবস্থা নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছি।’ বঙ্গবন্ধুর জেল জীবন ছিল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। এরপরও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাঁর কখনও সখনও দেখা সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে। সেইসব স্মৃতি বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করেছেন তিনি। এক জায়গায় ভীষণ আবেগী মনে হয় পিতা শেখ মুজিবকে। সর্ব কনিষ্ট সন্তান রাসেলের সঙ্গে দেখা হওয়ার স্মৃতির কথা জানিয়ে তিনি লিখেছেনÑ ৮ ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি চলো’। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! বঙ্গবন্ধু নিজে ছাড়া না পেলেও কয়েদিদের অনেকেই জেল জীবন থেকে মুক্ত হতে বঙ্গবন্ধুর সাহায্য চাইতেন। নেতার প্রতি অঘাদ আস্থা ছিল তাদের। নেতা সুপারিশ করলেই ছেড়ে দেয়া হবেÑ এমন বিশ্বাস নিয়ে আসতেন তাঁর কাছে। ১৯৬৬ সালের ৪ জুনের স্মৃতির কথা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘সকালে বাইরে বসে আছি। একজন লোক, ঝাড়ুদফায় কাজ করত, অসুস্থ হয়ে জেল হাসপাতালে গিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে এসেই আমার কাছে এল। এসে বলল, ‘আমাকে আপনি ছেড়ে দেন, আপনি বললেই জেল থেকে বের করে দিবে।’ আমি বললাম, ‘আমি তো তোমার মতো একজন কয়েদি, আমার ক্ষমতা থাকলে আমিই বা জেলে আসব কেন?’ সে বলে: ‘আপনি কলম মাইরা দিলেই কাজ হয়ে যায়।’ বললাম, ‘কলম আছে, কিন্তু মাইরা দিবার ক্ষমতা নাই।’ অনেকে জেনে অবাক হবেন যে, বঙ্গবন্ধু নিজের জন্য জেলে রান্নাও করেছেন নিজ হাতে। লিখেছেন, ‘ডাল আগেই পাকাইয়াছে। পটল ভাজি করলাম। ইলিশ মাছ পাক করলাম। নিজেই পাক করেছি, সে জন্য মন্দ লাগল না।’ বইতে আছে ছয়দফার কথা। ’৬৬ সালে নেতা জেলে বসেও রাজনীতি নিয়ে ভাবছিলেন। সক্রিয় ছিলেন। ওই বছলের ৬ জুন ডায়রির পাতায় তিনি লিখেছেন, ‘আগামীকাল ধর্মঘট। পূর্ব বাংলার জনগণকে আমি জানি, হরতাল তারা করবে। রাজবন্দিদের মুক্তি তারা চাইবে। ছয়দফা সমর্থন করবে।’ জেলের ভেতরে থেকে লেখা বর্ণনায় খুঁজে পাওয়া যায় বাইরের উত্তপ্ত রাজনীতির চিত্রটি। পরদিন ৭ জুন বঙ্গবন্ধু লিখেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। কি হয় আজ? আবদুল মোনায়েম খান যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয় কিছু একটা ঘটবে আজ। কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে খবর এলো দোকানপাট, গাড়ি, বাস, রিক্সা সব বন্ধ। শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল চলছে।’ পরের অংশে আপডেট। লিখেন, ‘আবার খবর এল টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে। লাঠিচার্জ হইতেছে সমস্ত ঢাকায়।’ এভাবে ষাটের দশকের রাজনীতির ইতিহাস হয়ে ওঠে গ্রন্থটি। একই বছরের ২৩ জুনের পাতাটি থেকেও জানা যায়, জেলে থেকেও দেশ এবং দেশের মানুষের সব খবর রাখতেন বঙ্গবন্ধু। নেতা লিখেন, ‘বন্যা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। চালের দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা মণ হয়ে গেছে। জনগণের আর শান্তি নাই।’ বইতে এসেছে সে সময়ের বহু রাজবন্দিদের কথা। নানা প্রসঙ্গে তাদের কথা উল্লেখ করেছেন বঙ্গবন্ধু। আছে দেশ রাজনীতি অর্থনীতি সমাজ এবং ভবিষ্যতের আশাবাদের কথা। তবে ছোট পরিসরে এই গ্রন্থের আলোচনা করা অসম্ভব ব্যাপার। বইটি অবশ্য পাঠ্য। তবেই প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব। সকার পরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্যোগ এক কথায় অনন্য সাধারণ ঘটনা। প্রকাশনার সঙ্গে থাকা বাংলা একাডেমিও প্রশংসার যোগ্য। বুধবার বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে গ্রন্থটি হস্তান্তর করেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। লেখাগুলো ছাপানোর জন্য প্রস্তুত করতে একাডেমির ডিজি শামসুজ্জামান খান সার্বক্ষণিক কষ্ট করেছেন বলে বইতে উল্লেখ করেছেন শেখ হাসিনা। সব মিলিয়ে অনেক বড় একটি পাওয়ার নাম ‘কারাগারের রোজনামচা’। ৩৩২ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির মূল্য রাখা হয়েছে মাত্র ৪০০ টাকা।
×