ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢিলে হয়ে পড়েছে গুলশান এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৫ মার্চ ২০১৭

ঢিলে হয়ে পড়েছে গুলশান এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ঢিলে হয়ে পড়েছে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গীদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পর কূটনৈতিক পাড়া হিসেবে পরিচিত এলাকাটি ঘিরে কড়া নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছিল। এখন নিরাপত্তার সেই কড়াকড়ি আর লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এতে সেখানকার বাসিন্দা এবং বিদেশীরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। তবে তাঁরা আতঙ্কিত নন। বিদেশীরা বলছেন, হলি আর্টিজানে হামলার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোন জঙ্গী গোষ্ঠী জড়িত নয়, সেটি প্রায় নিশ্চিত। কারণ আন্তর্জাতিক কোন জঙ্গী গোষ্ঠী এ ধরনের হামলায় জড়িত থাকলে আবারও হামলার ঘটনা ঘটত। কিন্তু সেটি হয়নি। তবে আবারও এ ধরনের ঘটনা ঘটলে বেশিরভাগ বিদেশীই বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবেন। গুলশান এলাকা প্রায় শতভাগ বিদেশী শূন্য হয়ে যেতে পারে। যদিও পুলিশ দাবি করেছে, গুলশানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বাড়ানো হয়েছে। সোমবার দুপুর সোয়া দুইটার দিকে পঞ্চাশোর্ধ বয়সী এক জাপানীকে বনানীর দিক থেকে হেঁটে গুলশান-২ নম্বরের দিকে আসতে দেখা গেল। পরনে নীল জিন্স প্যান্ট আর আকাশী রঙের পলো গেঞ্জি। পায়ে সাদা কেডস। মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে হাঁটছিলেন। কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। বলছিলেন, তিনি জাপান সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত একটি প্রজেক্টে কর্মরত। একা একা হাঁটতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি নাম পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি না। তবে হলি আর্টিজানে হামলার পর খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছি। ওই সময় আমি ছাড়াও আমার পরিচিত বিদেশীদের ধারণা ছিল, হামলার সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোন জঙ্গী গোষ্ঠী জড়িত। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, যে ধারণা তত কমে আসছে। কারণ আন্তর্জাতিক কোন জঙ্গী গোষ্ঠী জড়িত থাকলে, ওই ধরনের হামলার ঘটনা আরও ঘটত। তা যেহেতু হচ্ছে না, তার অর্থ একেবারেই স্পষ্ট। হলি আর্টিজানে হামলার সঙ্গে বিদেশী জঙ্গী গোষ্ঠী জড়িত নয়। বাংলাদেশের জঙ্গীরা জড়িত। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের আন্তর্জাতিক কোন জঙ্গী গোষ্ঠী মদদ বা সহায়তা করেছে বলেও মনে হয় না। তিনি আরও বলেন, আগের চেয়ে গুলশান, বনানী, বারিধারাসহ আশপাশের এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কমে গেছে। এতে তিনি আতঙ্কিত নন। তবে এটি উচিত নয়। কারণ কাজে ও নানা কারণে বিভিন্ন দেশের বিদেশীদের সঙ্গে তার আলাপ আলোচনা হয়। তারাও এমন নিরাপত্তা ব্যবস্থায় খানিকটা অসন্তুষ্ট। ভবিষ্যতে আবারও এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটলে অনেক বিদেশী বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবেন বলে তার পরিচিত বিদেশীদের সঙ্গে আলাপে প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি গুলশানের কূটনৈতিক পাড়া প্রায় বিদেশী শূন্য হয়ে পড়তে পারে। আরও কয়েকজন বিদেশীর সঙ্গে আলাপ করেও প্রায় এমন তথ্যই মিলেছে। তারা বলেছেন, আবারও যদি বিদেশীদের ওপর হলি আর্টিজানের মতো জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটে, তাহলে তারা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবেন। এটি বিদেশীদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত। এমনকি অনেক দেশের দূতাবাসের তরফ থেকেও বিদেশীদের এমন আভাসই দেয়া হয়েছে। সোমবার গুলশানের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ঢিলেঢালা ভাব নজরে এসেছে। এমনকি গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনেও একই অবস্থা। হোটেলটিতে প্রতিদিন অন্তত দুই শতাধিক বিদেশী যাতায়াত করেন। শুধু পর্যটক হিসেবে আগত বিদেশীদের পুলিশের তরফ থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। আর বাংলাদেশে বসবাসরত অন্য বিদেশীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শুধু কোন বিদেশী স্বেচ্ছায় নিরাপত্তা চাইলে তাদের সঙ্গে পুলিশ দেয়া হয়। অন্যথায় দেয়া হয় না। এছাড়া গুরুত্ব বিবেচনা করেও পুলিশের তরফ থেকে বিদেশীদের নিরাপত্তা দেয়া হয়ে থাকে। এছাড়া না চাইতেই কোন বিদেশীর নিরাপত্তা দেয়ার নজির খুব একটা নেই। তবে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও পুলিশ বলছে, অনেক বিদেশী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হওয়ার পরও তারা নিরাপত্তা নিতে রাজি হন না। এর কারণ যে বিদেশী নিরাপত্তার জন্য পুলিশ নিয়ে থাকে, তারা টার্গেট হতে পারেন। এজন্য অনেক বিদেশী ইচ্ছে করেই নিরাপত্তা নেন না। এমন নিরাপত্তা দেখা গেছে, ওয়েস্টিন হোটেলে আগত বিদেশীদের ক্ষেত্রেও। সেখানে একজন বিদেশীকে দূতাবাসের একটি দামী গাড়ি থেকে নামতে দেখা গেল। অথচ তার নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে কোন গানম্যান বা পুলিশ নেই। আর হোটেলের সামনে তিনজন পুলিশকে অস্ত্র হাতে দায়সারা গোছের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। হোটেলের পেছনের দিকে একেবারেই ফাঁকা। পেছনের দক্ষিণ দিকের কোণায় একজন আনসার সদস্যকে অস্ত্র কাঁধে ঝুঁলিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেছে। তবে হোটেলের চারদিকে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। তবে হোটেলের আশপাশের রাস্তায় কোন সিসি ক্যামেরা লক্ষ্য করা যায়নি। হোটেলের পেছনের অংশ অনেকটাই অরক্ষিত। এমনকি যে হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটেছিল, সেখানেও নিরাপত্তা ব্যবস্থার বালাই নেই। হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ আর লেক ভিউ ক্লিনিক একই জায়গার ওপর নির্মিত। রেস্তরাঁটি বন্ধ হয়ে গেছে। সেটি এখন গুলশান-২ নতুন জায়গায় চালু করা হয়েছে। তবে অনেক দিন ধরেই লেক ভিউ ক্লিনিকের কার্যক্রম চলছে। ক্লিনিকের নিরাপত্তা কর্মীরা বলছিলেন, ক্লিনিকটিতে মূলত নারীদের চিকিৎসা হয়। সেখানে অনেক বিদেশী মহিলা এবং ওইসব মহিলাদের সঙ্গে পুরুষরাও যাতায়াত করেন। অথচ আশপাশে কোন পুলিশী নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। একেবারেই খোলামেলা। তবে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সামনে পুলিশের নিরাপত্তা চোখে পড়েছে। এছাড়াও রাস্তায়ও পুলিশের চেকপোস্ট দেখা গেছে। তবে যানবাহন বা সন্দেহভাজনদের তল্লাশি করতে দেখা যায়নি। এমনকি রাস্তায় পুলিশের তেমন কোন টহলও চোখে পড়েনি। রাতেও একই অবস্থা বলে সেখানকার অনেক বাসিন্দাদের দাবি। এ ব্যাপারে কূটনৈতিক পাড়ার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের চ্যান্সারি বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, আগের যে কোন সময়ের চেয়ে কূটনৈতিক পাড়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৬ শতাধিক সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। কূটনৈতিকপাড়ায় থাকা ৪৮টি দেশের দূতাবাসে নিয়মিত পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য বিদেশী অফিস আদালতেও নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় এক হাজার পুলিশ সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে। এছাড়া নিয়মিত দূতাবাসগুলোর সঙ্গে পুলিশের বৈঠক হচ্ছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাস পুলিশের টহল বাড়ানোর জন্য ১৭টি মোটরসাইকেল দিয়েছে। রাস্তায় বাড়তি চেকপোস্ট বসিয়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও যানবাহনে তল্লাশি অব্যাহত আছে। বিদেশী পর্যটকদের পুলিশী নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে।
×