ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শরীফ খান

মুক্তিযোদ্ধা হাড়গিলা

প্রকাশিত: ০৫:১২, ১০ মার্চ ২০১৭

মুক্তিযোদ্ধা হাড়গিলা

দেশবরেণ্য শিল্পী হাশেম খান ১৯৯১ সালে আমাকে বলেছিলেন একটি হাড়গিলা পাখির সত্যি ঘটনা- পরবর্তীতে তার লেখা বইয়ে আমি বিস্তারিত জেনেছিলাম চারুকলা ইনিস্টিটিউটের সেই মুক্তিযোদ্ধা হাড়গিলা পাখিটি সম্পর্কে। হাশেম খান লিখেছেন, “ষাটের দশকের প্রায় নয় বছর ধরে একটি হাড়গিলা পাখি চারুকলা ইনিস্টিটিউটের বাসিন্দা ছিল। ছাত্রদের ছবি আঁকা; বিশেষ করে ড্রইং নকশা করার জন্য শিল্পাচার্য জয়নূল আবেদিন পাখিটিকে নিয়ে এসেছিলেন। ওটি ছিল পোষা পাখি। বর্তমান বকুল তলার মাঠে হাড়গিলাটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত। ধীরে পা ফেলে একটু এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করত। উড়া-উড়িতে তার আগ্রহ দেখিনি। নাকি সে উড়তে জানত না!” “২৫ মার্চ ’৭১-এর কালরাত্রে হানাদার পাকবাহিনী বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইপিআর কেন্দ্র, রাজারবাগ পুলিশ কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক হলসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও লোকালয় আক্রমণকালে চারুকলা ইনিস্টিটিউটও আক্রান্ত হয়। মালি নোনামিয়ার তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে। সেই রাতের অনেক ভয়ঙ্কর ঘটনার বিবরণ পরে জানতে পারি চারুকলার পুরনো ঝাড়–দার ও মালী সাধুর কাছে।” বইটির নাম ছিল ‘স্বাধীনতা ও জরিনারা’। প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স। প্রকাশকাল ১৯৯৯ সাল। ওই বইটি তার উত্তরার বাসায় বসে একটি সৌজন্য কপি হাশেম খান আমাকে দিয়েছিলেন। যেহেতু সামান্য একজন পাখিপ্রেমী আমি, সেহেতু হাড়গিলা নিয়ে লেখা ‘১৯৭১-এ এক হাড়গিলা পাখি’ শিরোনামের লেখাটি আমি বার কয়েক পড়েছিলাম। তখনই মনে এসেছিল- চারুকলার গেটে কিংবা ভিতরে একটি হাড়গিলা ভাস্কর্য করলে খুবই ভাল হয়- যেহেতু ওটি ছিল একটি মুক্তিযোদ্ধা হাড়গিলা। এরপরের ঘটনা হলো- যে হাড়গিলা পাখিটি ওড়েনি কখনও, প্রচ- গোলাগুলি উপেক্ষা করে দু’পাখায় ঝড়ের আওয়াজ তুলে উড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সৈন্যদের উপরে। আচমকা ধাক্কা খেয়ে দু’জন পাক-হানাদার মাটিতে পড়ে যায়। পাখিটাও ঠোক্কর দিতে লাগল। পরে অন্য হানাদারদের গুলিতে পাখিটি মারা যায়। এটি হলো সাধুর প্রত্যক্ষ দর্শন। এখানে আমার যৎকিঞ্চিত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে চাই যে, হাড়গিলার ওজন হয় প্রায় আট কেজি। শরীরের মাপ ১৫০ সেমি। একফুট লম্বা ঠোঁটটিকে অনায়াসে মিলিয়ে নেয়া যাবে ৩০৩ রাইফেলের বেয়োনেটের সঙ্গে- শক্ত চোখা ও ধারালো ওই ঠোঁট দিয়ে ওরা যেমন জোরে জোরে ‘ঠোঁটতালি’ বাজাতে পারে, তেমনি ঠোকর দিয়ে ছোট আকারের কচ্ছপের পিঠ ফুটো করে ফেলতে পারে। এরা হাঁটে পেশাদার সৈন্যদের মতো মার্চ করে করে, হাঁটে দাপটের সঙ্গে। বিপদ বুঝলে দুর্দান্ত সাহসে শত্রুকে আক্রমণ করে, বিশাল দুপাখা মেলে থাপ্পড় মারে দোর্দ- প্রতাপে। ১৯৬০ সালেও হাড়গিলা ছিল কলকাতা পৌরসভার প্রতীক। পাখিটির গলায় আছে একটি ‘গলথলি’, আকারে যেটা ছোট লাউ, ছোট পেঁপে, বেগুন, বেলুন বা ‘সাগরকই’ মাছের ফুলকার মতো- ঝুলে থাকে বুকে, ইচ্ছে করলে থলেটা ভেতরে টেনেও নিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা- সেই কালরাতে পাখিটার গলায় যেন ঝুলানো ছিল হ্যান্ডগ্রেনেড- এরকম কল্পনা করতেও দোষ নেই। পাখিটা প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল পাক-হানাদারদের। অতএব, ওটা ছিল মুক্তিযোদ্ধা হাড়গিলা। পাখিটি ছিল প্রতিরোধ যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক।
×