ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির পথে নওগাঁর ঐতিহ্য

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৬ মার্চ ২০১৭

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির পথে নওগাঁর ঐতিহ্য

বিশ্বজিৎ মনি ॥ অতীত ঐতিহ্যের স্মৃতি বিজড়িত উত্তরের নওগাঁ জেলার বিভিন্ন রাজা-জমিদারদের প্রাসাদসহ বিভিন্ন সম্পদ আজ বিলুপ্তির পথে। রক্ষণাবেক্ষণে সরকারী কোন নজরদারি না থাকায় ওইসব রাজা-জমিদারের জমিসহ প্রাসাদের ইটও লুটপাট হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে দেখার মতো কেউ আছে এমন অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না। এখনও সরকারী হস্তক্ষেপে সেখানে জমিদার বাড়ির সম্পদ দখলমুক্ত করে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলে ভ্রমণ পিপাসুদের মনের খোরাক যোগানোর পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো যেতে পারে বলে স্থানীয়দের অভিমত। কাশিমপুর জমিদার বাড়ির নদীর ধারে ঘরের মতো সুচালো চালাবিশিষ্ট বিশ্রামাগার এবং রাজপ্রাসাদের কক্ষগুলোর দেয়ালে গ্লেজড্ টাইল বা মিনা করা অলঙ্কৃত টালিগুলো দর্শকের আনন্দ ও বিনোদনের বস্তু। কিন্তু এ সবের প্রতি সরকারের রাজস্ব বিভাগ বা প্রতœতত্ত্ব বিভাগের কোন যতœ বা সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় আজ সেখানে বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ছোট যমুনা নদীর বাম কোল ঘেঁষে কাশিমপুর মৌজায় এই জমিদার বাড়ির অবস্থান। ১ একর ৯১ শতাংশ জমির ওপর অবস্থিত এই কাশিমপুর জমিদার বাড়িটি। রাণীনগর উপজেলার একমাত্র ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে পরিচিত এই কাশিমপুর জমিদার বাড়ি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দায়িত্বশীল মহল নজর না দেয়ায় পুরো জমিদার বাড়িটি দিনদিন স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে। লুটপাট করে নেয়া হচ্ছে এই জমিদার বাড়ির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি। ইতোমধ্যেই সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল বিশাল চাতাল, মিল-কলকারখানা, বসতবাড়িসহ উঁচু জমি কেটে সমতল করে সেখানে ধান চাষ করা হচ্ছে। জমিদার বাড়ির প্রাচীন ঐতিহ্য নিদর্শনসমূহ দীর্ঘদিন যাবত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে সকল কারুকার্য আজ ধ্বংস প্রায়। প্রাসাদের মূল ভবনের সামনের চারটি গম্বুজ, উত্তর পাশে মন্দিরের কিছু অংশ এখনও কালের সাক্ষী হিসেবে স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। জানা গেছে, অন্নদা প্রসন্ন লাহিড়ী ছিলেন এই কাশিমপুর জমিদারীর শেষ জমিদার। তার ৪ পুত্র ও ১ কন্যা ছিল। কাশিমপুরের জমিদার নাটোরের পাগলা রাজার বংশধর ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর রাজবংশের সকলেই এই রাজত্ব ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে যান। শুধু ছোট জমিদার শ্রী শক্তি প্রসন্ন লাহিড়ী বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই কাশিমপুর রাজবাড়িতেই বসবাস করতেন। সময়ের বিবর্তনে তিনিও একসময় কিছুটা চুপিসারে জমিদার বাড়ির স্টেটের অঢেল সম্পদ রেখে ভারতে চলে যান। এই কাশিমপুর জমিদারের শত শত বিঘা জমি ও পুকুর স্থানীয় প্রভাবশালীরা বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় আসা রাজনীতির ছত্রছায়ায় দখলে নিয়েছে। জমিদারের সেইসব সম্পত্তি স্থানীয় দখলবাজদের অত্যাচারে আজ সবই প্রায় বেদখল। জমিদার বাড়ির বৈঠকখানার কিছু অংশ এখন কাশিমপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বেশিরভাগ জায়গা স্থানীয়রা অবৈধভাবে দখলে নিয়ে বিভিন্ন পন্থায় উপজেলা ভূমি অফিস ও জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে লিজ নিয়ে চাতাল তৈরি করে ব্যবসা করছে। দায়িত্বশীল মহল জমিদার বাড়ি ও জমিদারের সম্পদগুলোর ওপর নজর না দেয়ায় সরকার কোটি কোটি টাকার সম্পদ ও রাজস্ব দু’টো থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে। স্থানীয় প্রবীণদের মতে, সরকার যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে এসব অবৈধ স্থাপনা, জমি ও পুকুরগুলো উদ্ধার করে সংস্কারের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে প্রতিবছর জমিদার বাড়ির বিশাল সাম্রাজ্য থেকে অনেক টাকার রাজস্ব আয় করতে পারবে রাষ্ট্র। এছাড়াও এই প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন সংস্কার করা হলে এটি পর্যটকদের জন্য একটি দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। সরকার যথাসম্ভব দ্রুত এই জমিদার বাড়ির অবশিষ্ট অংশগুলো সংরক্ষণ ও সংস্কার করে তা পর্যটকদের জন্য এবং স্থানীয়দের জন্য একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি এলাকার সর্বস্তরের মানুষের। এ ব্যাপারে রাণীনগর উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মকলেছুর রহমান বাবু জানান, স্বাধীনতার পর কাশিমপুর জমিদারের বংশধররা কয়েক দফায় ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকেই স্থানীয় কিছু ভূমিখেকো ব্যক্তিরা ইচ্ছেমতো জমিদারের এই বিশাল সম্পত্তি জবরদখল করে নেয়। একসময় বিভিন্ন কায়দায় উপজেলা ভূমি অফিস থেকে লিজ নেয়ার কথা আমি শুনেছি। এমনকি বড় বড় দালানকোঠা ঘেরা প্রাচীর ও জমিদারের প্রাসাদের ইট খুলে প্রকাশ্য দিবালোকে ও রাতের আঁধারে স্থানীয়রা লুটপাট করে বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। যতটুকু নির্মাণ শৈলী কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, তা যদি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের মাধ্যমে দৃষ্টিনন্দন করলে এখানেও গড়ে উঠতে পারে ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য দর্শনীয় স্থান। বাড়তে পারে সরকারের রাজস্ব আয়।
×