ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেশ হারাচ্ছে মৎস্যভাণ্ডার

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৬ মার্চ ২০১৭

দেশ হারাচ্ছে মৎস্যভাণ্ডার

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ৫ মার্চ ॥ কলাপাড়ার উপকূলীয় সাগর ও নদীতে বাগদা চিংড়ির রেণু পোনা নিধন চলছে। চিংড়ির রেণু পোনার সঙ্গে অন্য প্রজাতির কোটি কোটি পোনা মাছ মারা যাচ্ছে। ফ্রি-স্টাইলে অন্তত অর্ধশত স্পটে সূক্ষ্ম ফাঁসের মশারি নেটের হাজার হাজার বেহুন্দি ও বক্স আকৃতির জাল পেতে পোনা মাছ নিধনের ভয়াবহ তা-ব চলছে। প্রতিদিন শুধু কলাপাড়ার উপকূলীয় নদী ও সাগরবক্ষে কোটি কোটি পোনা নিধন হচ্ছে। স্থানীয় পুলিশ, মৎস্যবিভাগ, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ডসহ কারও নাকের ডগায় আবার কোথাও গোপনে চলছে মৎস্যসম্পদ নিধনের এমন তা-ব। পোনা ধরা নিষেধÑ এমন প্রচার চালিয়ে আবার আড়ত মালিকরা আহরণকারী দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে লোনা পানির পোনা কিনছে পানির দরে। মাত্র সর্বোচ্চ ৩০ টাকায় একশ’ রেণু পোনা বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছে গরিব এ জনগোষ্ঠী। এসব পোনা আবার প্রকাশ্যে বিভিন্ন হাট-বাজারের আড়তে পাইকারি ক্রয়-বিক্রয় চলছে। মোট কথা যে যেভাবে পারছে কৌশলে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু দেশ হারাচ্ছে মাছের বিশাল ভান্ডার। কোস্টগার্ডসহ মৎস্য প্রশাসন অভিযান চালালে তখন পোনা ধরার প্রবণতা কিছুটা কমে। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। গরিব জনগোষ্ঠী আবার পেটের যোগান দিতে রাতের বেলা পোনা আহরণ করছে। তবে পোনা আহরণের পরিমাণ এখন অনেকটা কমেছে বলে প্রশাসনের দাবি। সরেজমিনে দেখা গেছে, কুয়াকাটা সৈকতের খাজুরা থেকে কাউয়ারচর পর্যন্ত শত শত মশারি নেটের বানানো জাল পাতা রয়েছে। সাগর কিংবা নদীর পাড় থেকে আড়াআড়ি খুঁটি গেড়ে একটি দড়ির সঙ্গে অন্তত কুড়িটি বেহুন্দি জাল পেতে রাখা হয়েছে। মাইলের পর মাইলজুড়ে শত শত জাল পাতা রয়েছে। কুড়িটি বেহুন্দি ছোট্ট নেটে অন্তত একেক বারে দুই-তিনশ’ বাগদার রেণু ধরা পড়ছে। কেউ কেউ আবার মশারি নেট পানির নিচে ডুবিয়ে রাখছে। আর এ রেণু উপকূলে বসে গণনার কারণে মারা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের কোটি কোটি পোনা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এসব দেখার কেউ নেই। রামনাবাদ নদীর শেষপ্রান্তে সাগর মোহনা চরধুলাসার সৈকতে অন্তত পাঁচশ’ জাল পাতা রয়েছে। সারি সারি করে দুই-তিনশ’ গজ নদীর মধ্যে খুঁটি গেড়ে ২০-২৫টি ছোট সাইজের বেহুন্দি মশারি নেট পাতা হয়েছে। কতক্ষণ পর পর জেলেরা জাল থেকে রেণু পোনা গামলা কিংবা অন্য পাত্রে এনে বেলাভূমে বাগদার রেণু বাছাই করে বালুতেই অন্য প্রজাতির পোনাসহ সব ফেলে দেয়। পানির পাত্রে সংরক্ষণ করায় মারা পরছে না বাগদার রেণু পোনা। কিন্তু অন্যসব পোনা মরে যাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যেই। এদেরই একজন শাহীন। কুড়িটি জালে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অন্তত ৭০০ বাগদার রেণু পোনা পেয়েছেন। এজন্য অন্য প্রজাতির সাদা মাছের রেণু পোনা মারা গেছে কমপক্ষে ৪৯ হাজার। একেকটি বাগদার রেণু শিকার করতে গড়ে অন্য প্রজাতির পোনা মারা পড়ছে ৭০-৭২টি। একটি উন্নয়ন সংস্থার প্রাপ্ত তথ্য এটি। গুনেও পাওয়া গেছে একই পরিসংখ্যান। এভাবে গোটা উপকূলে প্রতিদিন বিভিন্ন প্রজাতির কোটি কোটি পোনা মাছ মেরে ফেলা হচ্ছে। বাগদার রেণু পোনা আহরণ নিষিদ্ধ-এমন অজুহাত দেখিয়ে আহরণকারী গরিব মানুষের কাছ মাত্র ৩০ টাকায় একশ’ বাগদার রেণু পোনা কেনা হচ্ছে। বাবলাতলা বাজারের একটি আড়তে শত শত মাটির পাতিলে বাগদার রেণু পোনা বিক্রির জন্য মজুদ করা রয়েছে। গণনাকারী জানান, আড়তটির মালিক মাসুদ রানা। চর ধুলাসার গ্রামের আব্দুল হামেদের ছেলে ক্লাস ফোরে পড়া সবুজ জানায় রাতভর ৯০০ পোনা তারা ধরেছে। ৩০ টাকায় একশ’ পোনা বিক্রি করছে। আড়তের ঘাটে একটি ট্রলার বাধা রয়েছে জমাকৃত পোনা কেনার জন্য। অথচ আড়ত মালিকরা একশ’ রেণু পোনা বিক্রি করছে ৭০ থেকে একশ’ টাকায়। এ যেন জালিয়াতি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আড়ত মালিক ও পাইকাররা জানান, এখন ট্রলারে ওপেনভাবে পোনা চালান করা যায় না। বিআরটিসিসহ বিভিন্ন বাসের বাঙ্কারে কিংবা ছাদে প্লাস্টিকের বয়ামে। পলিথিনে অক্সিজেন সংরক্ষণের মাধ্যমে পোনা চালান করা হয়। এজন্য আবার ঘাটে ঘাটে রাজনৈতিক কর্মী, পুলিশ প্রশাসনসহ কথিত মিডিয়াকর্মীদের পর্যন্ত বখড়া দিতে হয়। এজন্য প্রচুর টাকা ব্যয় হয়। মাদ্রাসা ছাত্র নাজমুল ও স্কুলছাত্র লিমন বক্স নেটে পোনা আহরণ করছিল। তারা জানায়, লেখাপড়ার ফাঁকে সংসারের বাড়তি যোগানে তারা প্রতিদিন বাগদার রেণু পোনা ধরছে। এমনদৃশ্য সর্বত্র। বাবলা তলা বাজারের মাসুদ রানার রয়েছে বিরাট আড়ত। প্রকাশ্যে বাগদা চিংড়ির রেণু পোনা কেনাবেচা চলছে। একই অবস্থা চাপলী বাজার, লক্ষ্মীর হাট, আলীপুর, খালগোড়া, খাজুরা, আশাখালী, বানাতি বাজার, চারিপাড়া, হাজিপুরসহ সর্বত্র। প্রকাশ্যে পোনা কেনা-বেচা চললেও আড়তগুলো বন্ধ হয়নি। এ ব্যাপারে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম জানালেন তাদের লোকবল সঙ্কটসহ বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতার কথা। এছাড়া প্রতিনিয়ত অভিযান চালানো হচ্ছে, পোড়ানো হচ্ছে সব ধরনের সূক্ষ্ম ফাঁসের জাল। তবে সচেতন মহলের মতে বাগদার রেণু পোনা আহরণের সঙ্গে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের রেণু পোনা নিধনের তা-ব ঠেকাতে না পারলে সাগর কিংবা নদী মাছশূন্য হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
×