ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী নিধনে পুলিশের কমান্ডো ইউনিট, কঠিন প্রশিক্ষণ

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৪ মার্চ ২০১৭

জঙ্গী নিধনে পুলিশের কমান্ডো ইউনিট, কঠিন প্রশিক্ষণ

আজাদ সুলায়মান ॥ চারদিকে গহীন অরণ্য। কোথাও লোকালয় নেই। গা ছম ছম পরিবেশ। খাবার-দাবার পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি সুপেয় পানিও। এমন পরিবেশেই টানা ৪২ ঘণ্টা কাটাতে হবে। ঘুম, খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম কতটা দুর্লভ যারা এই প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন- কেবল তারাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। এরই নাম সারভাইভাল কোর্স। কঠোর অনুশীলন। জীবন বাজি রেখেই এ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। যদি পুলিশের কমান্ডো ইউনিটে চাকরি করতে হয়Ñ তবে এমন কঠোর পরীক্ষায় পাস করতেই হবে। যারা টিকবে না তারা বাদ। কোন দয়া অনুকম্পার প্রশ্নই ওঠে না। এ ধরনের কঠোর অনুশীলনেই খাগড়াছড়িতে আর্মড পুলিশের তত্ত্বাবধানে চলছে দেশের প্রথম কমান্ডো ইউনিটের প্রশিক্ষণ। এখানে সারা বছরই চলবে প্রশিক্ষণ। বিশ্বমানের এ প্রশিক্ষণে কোর্স থাকবে যুগোপযোগী। ভারতের শীর্ষ পুলিশ প্রশিক্ষণের বিভিন্ন ইউনিটের কারিকুলাম অনুযায়ী কোর্স মডিউল তৈরি করা হয়েছে। এখানে রয়েছেন দেশের বিভিন্ন সামরিক প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষকও। তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছেÑ প্রথম ব্যাচের ৪২ জনকে। এদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ইতোমধ্যে ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের মানেশ্বর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কাউন্টার টেরোরিজম থেকে বাংলাদেশ পুলিশের ৪০ জন সদস্যকে দুই সপ্তাহের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে। তারাই প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করবেন খাগড়াছড়ির এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। তাদেরই একজন আর্মড ব্যাটালিয়ন পুলিশের এএসপি তানজিনা আক্তার জানান- তিনি আগামী ১২ মার্চ ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগ দেবেন। অতিরিক্ত ডিআইজি আওরঙ্গজেব মাহবুব জনকণ্ঠকে বলেন, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট থেকে বাছাই করে তারুণ্যদীপ্ত ও চৌকস কর্মকর্তাদের আনা হয়েছে এখানে। কনস্টেবল থেকে দারগা ও পরিদর্শক পদমর্যাদার জনবলও রয়েছে। কঠোর অনুশীলন ও অনুশাসনে যারা দৈহিক ও মানসিকভাবে শক্তি সামর্থ্যরে পরিচয় দিচ্ছে তারাই টিকবে কমান্ডো ইউনিটে। ৮ সপ্তাহের এ প্রশিক্ষণের শুরু থেকে যারা শেষ পর্যন্ত উতরাবে, তাদের আবার চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। সেখানে যারা পাস করবে, তারাই যোগ দিবেন কমান্ডো উইনিটে। এ নিয়ে বিন্দুমাত্র অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ নেই। হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ার মতো অভিজ্ঞতার আলোকেই পুলিশের এই নতুন ইউনিট গড়া হচ্ছে। এ ধরনের হামলা জিম্মিদশা থেকে কিভাবে মুহূর্তেই সফল অভিযান চালানো যায়, কিভাবে হতাহতের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রেখে জঙ্গীদের কতল করা যায়, সেই প্রশিক্ষণই দেয়া হচ্ছে খাগড়াছড়ির এই কেন্দ্রে। চারদিকে দুর্গম ও প্রতিকূল প্রতিবেশে চলছে প্রশিক্ষণ। দুর্ধর্ষ জঙ্গী ভিত গুঁড়িয়ে দিতে পুলিশের এই কমান্ডো হবে বিশ্বমানের। খাগড়াছড়িতে গড়ে ওঠা এ কেন্দ্রের প্রথম ব্যাচ বের হবে আগামী মে মাসের, মাঝামাঝির দিকে। এটি হবে বাংলাদেশ পুলিশের সবচেয়ে মর্যাদাশীল ও চৌকস ইউনিট। এ প্রশিক্ষণের যোগ্যতার প্রথম শর্ত শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতা। এত কঠিন অুনশীলন টিকে থাকার জন্য চাই শক্ত সবল লোক, যাদের বয়স পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে। চরম এ্যাডভেঞ্চারিজম বলতে যা বোঝায়- তা এখানে যারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, তারাই কেবল অনুধাবন করতে পারছেন। আওরঙ্গজেব মাহবুব জানালেন, এরই মধ্যে প্রশিক্ষণে টিকতে না পেরে ৪ জন ঝরে গেছেন। এখন যারা আছেন চূড়ান্ত পরীক্ষায় কতজন টিকে সেটা বলা মুশকিল। কারণ এ প্রশিক্ষণের মান নিয়ে বিন্দুুমাত্র ছাড় দেয়া হয় না। প্রতিদিন ১০ মিনিটের মধ্যে বিশ কেজি ওজনের সাজ-সরঞ্জামাদি নিয়ে পাঁচ কিলোমিটার পথ দৌড়ে, আবার ফিরে আসার মতো পরিশ্রমে যিনি টিকবেন, তারাই সফল বলে বিবেচিত হবেন। এটা অনেক অনুশীলনের একটি। এ রকম প্রতিটি কঠোর অনুশীলন রয়েছে। যা ধাপে ধাপে উত্তীর্ণ হতে হয়। প্রশিক্ষণের প্রথম ব্যাচ দিয়ে চালু করা হবে খুলনা ও রংপুর ইউনিট। এ দুটো ইউনিট হবে পাইলট প্রজেক্ট। পরবর্তী পর্যায়ে ধাপে ধাপে দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে প্রতিষ্ঠা করা হবে কমান্ডো ইউনিট। একজন অতিরিক্ত ডিআইজি থাকবেন এর প্রধান। প্রাথমিক ন্যূনতম ২০ জন লোকবল থাকছে প্রতিটি ইউনিটে। এতে রাখা হবে নিজস্ব অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ। দূর নিয়ন্ত্রিত অপারেশান ইউনিটও রাখা হবে। যা দিয়ে জঙ্গীর মতো দুর্ধর্ষ অপরাধীদের মোকাবিলা করা যায় মুহূর্তেই। এ ফোর্সের জন্য থাকছে আলাদা ইউনিফর্ম। এ সম্পর্কে পুলিশ সদর দফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, কমান্ডো ইউনিট হবে বাংলাদেশ পুলিশের সবচেয়ে চৌকস ইউনিট। পুলিশের সেরা মেধাবী, সাহসী ও তরুণ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত এ ইউনিট হলি আর্টিজানের মতো দুনিয়া কাঁপানো জিম্মিদশা কয়েক মিনিটেই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হবে। সে রকম সক্ষমতাই থাকবে এর প্রতিটি ইউনিটে। মূলত এ দেশে আর কখনওই দ্বিতীয় হলি আর্টিজান বা শোলাকিয়ার মতো জঙ্গী অপারেশন ঘটানানোর সুযোগ দেবে না কমান্ডো ইউনিট। যেখানেই জঙ্গীর ঘ্রাণ পাবেÑ সেখানেই হানা দেবে এ ফোর্সের সদস্যরা। চোখের পলকেই ক্ষিপ্রগতিতে গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম কমান্ডো ইউনিটের স্পেশাল এসাইনমেন্টের খসড়া ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে। একজন প্রশিক্ষণার্থী বলেন, এখানে আসার আগে ধারণা করতে পারিনি এ ধরনের কঠিন প্রশিক্ষণ বাংলাদেশে হতে পারে। পুলিশের প্রধান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সারদায় যখন বেসিক কোর্স হাতে-কলমে শিখানো হয়Ñ এত সময় ধরে, তাতেও কষ্ট হয়নি। কিন্তু এই খাগড়াছড়ির গহীন অরণ্যে যখন বিনা খাবারে ৪২ ঘণ্টার জন্য ছেড়ে দেয়া হয়, তখন জীবন কত কঠিন সেটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করা যায়। খাবার ছাড়া কিভাবে থাকেন জানতে চাইলে সুদর্শন এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এটা অবিশ্বাস্য। আমার এক সহকর্মী ঘটনাক্রমে একটা কলাগাছের সন্ধান পেয়ে যায়। তিনি সেটাই হাতে নিয়ে কাঁচা খেয়ে খিদে নিবারণ করেছেন। কেউ হয়তো অন্য কোন ফল বা লতা পাতা চিবিয়ে খায়। কেউ শুধু দূরের কোন কুয়া থেকে পানি এনে জীবনধারণ করে। অর্থাৎ দুর্যোগ সংগ্রামে কখনও কখনও যদি এ রকম অভিযানের নেতৃত্ব দিতে হয়, তখন দু’একদিন খাবার না পেলে, কিভাবে বাঁচতে হবে, কিংবা সে রকম পরিস্থিতিতে কি ধরনের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা হবে তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই সারভাইভাল কোর্স। এএসপি পদমর্যাদার অপর এক প্রশিক্ষণার্থী বলেন, কমান্ডো প্রশিক্ষণে যিনি উত্তীর্ণ হবেন তিনি আসলেই গোটা পুলিশের একটা সম্পদে পরিণত হবেন। এখানে যে ধরনের কায়িক পরিশ্রমের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, অনেকে শুরুতেই ড্রপ আউট হয়ে যান। যেমন কমপক্ষে ২০ কেজি ওজনের সাজ-সরঞ্জামাদি অস্ত্র ও গোলাবারুদ পিঠে নিয়ে দীর্ঘ বন্ধুর পথ দৌড়াতে হয়। প্রথম রাউন্ডে পাঁচ কিলো, দ্বিতীয় রাউন্ডে ১০, তারপর পনের হয়ে বিশ কিলোমিটার পর্যন্ত দৌড়ানোর মতো কোর্স করা অসম্ভব ব্যাপার। এমনই সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে হচ্ছে এখানে। এ ধরনের প্রশিক্ষণের মধ্য একজন সদস্যের যে ধরনের মনোবল তৈরি হয়Ñ তখন তার সামনে দুর্ধর্ষ জঙ্গীরাও নস্যি হয়ে যাবে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়Ñ খাগড়াছড়ির ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এ ধরনের শতাধিক কোর্সের কারিকুলাম রয়েছে। শুধু যে হলি আর্টিজানের মতো কোন একটা হোটেলে জঙ্গীরা ঢুকে পড়ে জিম্মিদশা মোকাবিলা করার হবে তা নয়। আশকোনার মতো কোন বাসাবাড়ি বা বহুতল ভবনেও এমন জিম্মি দশার সৃষ্টি করে জঙ্গীরা তখন কিভাবে ওই বাড়িতে ঢুকবে তারও কাউন্টার প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে এখানে। এমনকি কোন যানবাহন বা উড়োজাহাজে জঙ্গীরা ঢুকে জিম্মিদশার সৃষ্টি করলে কিভাবে সেখানে নিরাপদে ঢুকে কম হতাহতের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সে কৌশলও শেখানো হচ্ছে। কোন বহুতল ভবনে নিচ দিয়ে ভেতরে প্রবেশের উপায় না থাকলে ওপর দিয়েই ওঠতে হয়। দড়ি দিয়ে পাইপ বেয়ে ওপরের পাঁচতলায় পৌঁছার পর নিচে নেমে এসে চুপিসারে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকার কৌশলটাও রপ্ত করতে হচ্ছে। একটি রুমের দরজা ভেঙ্গে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে অক্ষত অবস্থায় জিম্মি উদ্ধার বা বোমা উদ্ধার করার মতো প্রশিক্ষণতো আসলেই কঠিন কাজ। এখানে আরও শেখানো হচ্ছেÑ হাউস ক্লিয়ারিং ড্রিল কোর্স। এ কোর্স যিনি করবেন তিনিই ভাল বুঝবেন ভেতর থেকে লাগানো দরজা বাইরে থেকে কয়েক সেকেন্ডে নিঃশব্দে খুলতে। কমান্ডো ইউনিটের অন্যতম কোর্স রেইড এ্যান্ড এ্যাম্বুশ, সার্চ এ্যান্ড ডেসট্রয়, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমেও রয়েছে এক ধরনের শিহরণ জাগানো অনুভূতি। জানা যায়Ñ আপাতত বছরে অন্তত ৪০ করে তিনটে ব্যাচকে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে যাতে একেকটি ব্যাচ সমাপ্তির পর দুটো করে ইউনিট চালু করা যায়।
×