ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি, চেতনার রঙে রাঙানো

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি, চেতনার রঙে রাঙানো

মোরসালিন মিজান ॥ পূর্ণতা পেল অমর একুশে গ্রন্থমেলা। একুশ এসে পূর্ণতা দিয়ে গেল। বাঙালীর ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আয়োজন শুরু হয়েছিল ১ ফেব্রুয়ারি আর মঙ্গলবার ছিল মাসের ২১তম দিন। ১৯৫২ সালের এই দিনে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় রাজপথে নেমে এসেছিল বাঙালী। হাসিমুখে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিল। রক্ত শিমুল তপ্ত পলাশ দিল ডাক সুনীল ভোরে...। এখনও কি ডাকে সে ভোর? হয়ত ডাকে। তা না হলে কেন এই দিনে মানুষের সবচেয়ে বড় স্রোতটি নামবে বইমেলায়? অন্যদিনও লোকসমাগম কম হয় না। তবে অমর একুশের স্বতন্ত্র আবেদন। এদিন বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপস্থিতিতে ভরে উঠেছিল বিশাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রতিটি কোণ। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। প্রতিবারের মতোই ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে মানুষের ঢল নামে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেই ঢল এসে মিশে যায় বইয়ের মেলায়। এদিন মেলার প্রবেশদ্বার খুলে দেয়া হয় বেলা ১১টায়। তারও আগে থেকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন বইপ্রেমী মানুষ। অধিকাংশ মানুষের গায়ে ছিল শোকের কালো রং। সাদা-কালো রঙের মিশেলে সুন্দর সাজে এসেছিলেন নারীরা। এমনকি ছোট্ট শিশুটি একুশের রং গায়ে মেখে মেলায় আসে। তবে দৃশ্যমান রঙের চেয়ে মনের ভাব ও ভাষা বেশি মুগ্ধ করেছে। একুশের মেলায় এদিন ভাব-গাম্ভীর্যটা চোখে পড়েছে। শুধু বই বিক্রি আর কেনা নয়, আড্ডা গল্প নয়, আত্মদানের ইতিহাসটাও স্মরণে রেখেছিলেন পাঠক। বেলা যত বাড়ছিল, ততই বাড়ছিল ভিড়। ভিড়, ভ্যাপসা গরম, হাঁটা দীর্ঘপথÑ কোনটিই বাধা হতে পারেনি। বইয়ের সঙ্গে ভাষা দিবস পালন করেছেন নগরবাসী। মেলায় লোকসমাগম বাড়ায় বেড়েছিল বিক্রিও। প্রতিটি স্টল ও প্যাভিলিয়ন ঘুরে পছন্দের বই কিনেছেন পাঠক। সকালে অন্বেষা প্রকাশনীর সামনে কথা হচ্ছিল আমিরুল ইসলামের সঙ্গে। স্ত্রী ও পাঁচ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে মেলায় এসেছিলেন তিনি। বললেন, জানি আজ খুব ভিড় হবে। তবু এসেছি। কারণ আজ অমর একুশে। এই দিনে ঘরে বসে থাকা যায় না। মৌলবাদীরা এখন যেভাবে হুঙ্কার ছাড়ছে, ঘরে বসে থাকা উচিতও নয়। সন্তানের হাতে বই তুলে দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলার সঙ্গে আগে পরিচিত হতে হবে। অন্য ভাষায় মনের সুখ মিলবে না। কবির সঙ্গে কথা ॥ বিকেলে মেলায় এসেছিলেন কবি মুহাম্মদ সামাদ। জার্নিম্যান বুকস’র স্টলে বসেছিলেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে বললেন, একুশের দিনে মেলায় না এসে পারলাম না। ভিড় ঠেলে ঢুকতে হয়েছে। তবু চলে এলাম। এবারের মেলায় এসেছে তার অনুবাদ করা একটি কবিতার বই। বিভিন্ন দেশের কবিদের কবিতা অনুবাদ করেছেন তিনি। বললেন, প্রতি বছর মেলায় প্রকাশিত নতুন বইগুলো থেকে কয়েকটি বেছে নিয়ে সেগুলোর ওপর আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমিকে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। প্রকাশকের কথা ॥ ভাষা আন্দোলনের ওপর বৃহৎ প্রকাশনা আছে অ্যাডর্নের। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সৈয়দ জাকির হোসেন দুপুরে নিজের স্টলের সামনেই বসেছিলেন। বেশ ক্লান্ত চেহারা। কেন- জানতে চাইলে বললেন, আজ একেবারে সকাল থেকেই মেলায়। শেষ পর্যন্ত থাকব। সারাদিনে কী কী ঘটে দেখতে চাই। প্রচুর মানুষের আসা-যাওয়া। বই কেমন সংগ্রহ করছেন পাঠক- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের আগের বইগুলো বেশি যাচ্ছে। নতুন বই পরিচিত হতে একটু সময় চলে যায়। তার পর থেকে চলতে থাকে। নির্বাচিত বই ॥ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্যের বিভিন্ন অংশ বই আকারে প্রকাশ করেছে ঐতিহ্য। নালন্দা থেকে এসেছে এমআর মাহবুবের ‘একুশের স্মারক’। অমর একুশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্মারক নিয়ে লিখেছেন তিনি। মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাকের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা ‘কথা ’৭১’। এসেছে কথাপ্রকাশ থেকে। স্মৃতিকথায় সেই দুর্বিষহকালের বয়ান। সুবর্ণ প্রকাশ করেছে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ‘জনতার মঞ্চ ও অন্যান্য’। প্রবন্ধ সংকলনে মোট ১৮টি রচনা। হুমায়ূন আজাদের বাণীনির্ভর একটি পুস্তিকার অনুবাদ ‘এ্যাফারিজম অব হুমায়ূন আজাদ’। প্রকাশ করেছে আগামী। নতুন বই ॥ মেলার ২১তম দিনে নতুন বই এসেছে ২৬১টি। এগুলোর মধ্যে গল্প ৩৪, উপন্যাস ৩৪, প্রবন্ধ ১৪, কবিতা ৭৯, গবেষণা ৭, ছড়া ৪, শিশুসাহিত্য ১১, জীবনী ৫, মুক্তিযুদ্ধ ৮, নাটক ১, ভ্রমণ ১২, ইতিহাস ৩, রাজনীতি ১, চিকিৎসা/স্বাস্থ্য ২, কম্পিউটার ২, অনুবাদ ১, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ৩ এবং অন্যান্য বিষয়ে রয়েছে ৪০টি বই। মোড়ক উন্মোচন ॥ মেলার মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে ৪৩টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। মূলমঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘ধর্মীয় বহুত্ববাদ : বাঙালির গৌরবময় উত্তরাধিকার’ শীর্ষক বক্তৃতানুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইতিাহাসবিদ ড. আবদুল মমিন চৌধুরী। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। ড. আবদুল মমিন চৌধুরী বলেন, সহিষ্ণুতা ও সাম্যভাবনা প্রসূত ‘ধর্মীয় বহুত্ববাদ’-এর ধারণা প্রাচীন বাংলার অতি প্রশংসনীয় ঐতিহ্য। অতীতের উত্তরাধিকার ভবিষ্যতে পথচলার দিকনির্দেশনা দেবে। অতীতকে অবলম্বন করেই আগামীর প্রস্তাবনা সৃষ্টি করতে হবে। আর এ প্রস্তাবনাকে ধারণ করেই ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমান প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে, সমাজদেহে যতদিন জীবনীশক্তি থাকে ততদিন ভেতর থেকে বা বাইরে থেকে যত আঘাতই আসুক না কেন, সমাজ আপন শক্তিতেই তা প্রতিরোধ করবে। সমাজ এ শক্তি পাবে তার অতীতের ঐতিহ্য থেকে। অতীতের উত্তরাধিকার সম্পর্কে গভীর সচেতনতাই সৃষ্টি করবে এ প্রাণশক্তি। ধর্মীয় উগ্রতার উদীয়মান শক্তিকে প্রতিহত করতে প্রয়োজন অতীতের উত্তরাধিকার সচেতনতা সমৃদ্ধ দৃঢ় আত্মোপলব্ধি। সভাপতির বক্তব্যে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ধর্মীয় বহুত্ববাদ বিষয়ে আলোচনা আজকের এ সময়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও ধর্মীয় উগ্রবাদ প্রতিরোধে বাঙালীর বহুত্ববাদী মানবিক ইতিহাস বিশেষ করে আলোচনার দাবি রাখে। সন্ধ্যায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী আবদুল জব্বার, ফকির আলমগীর, নমিতা ঘোষ, শিবু রায়, আবদুল হালিম খান এবং স্বর্ণময়ী ম-ল। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী।
×