ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পিচঢালা পথে চক দিয়ে লেখেন জীবনের গল্প-চান আর্থিক সাহায্য

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

পিচঢালা পথে চক দিয়ে লেখেন জীবনের গল্প-চান আর্থিক সাহায্য

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘বইমেলায় আগত সিটি স্যার, সিটি ভাই ও বোন, আমি ল্যাংড়া মামুন, বাঁচার মতো বাঁচতে চাই পাঁচটি জীবন নিয়ে, একটু সাহায্য ও সহায়তা করুন, এ্যাক্সিডেন্টে আজ আমার সব লণ্ড ভণ্ড।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদসংলগ্ন পিচঢালা কালো পথে চক দিয়ে নিজ জীবনের কথা এভাবেই লিখে প্রকাশ করছেন মামুন-আল-মামুন নামের এক ব্যক্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের বিপরীত দিকে টিএসসি থেকে শাহবাগগামী রাস্তায় প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বসে তিনি জীবনের গল্প লেখেন। হাতে তার চক। নিচু হয়ে তিনি লিখে চলেছেন। পথলেখক তিনি। ময়লা তেল চিটচিটে শরীরে একটি জ্যাকেট ও থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরা। তার একটি পা হাঁটু পর্যন্ত কাটা। অপরটিও অচল। অনেকটা কৌতূহলী চোখে রাস্তা দিয়ে চলাচলরত লোকজন একটু দেখে নিচ্ছেন তিনি কী লিখছেন। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী, রিক্সাচালক ও পথচারী ফুটপাথে থমকে দাঁড়িয়ে মামুনের লেখা মনোযোগসহকারে পড়ে দেখছেন। কেউ কেউ আবার লেখাগুলো পড়ে দুই, পাঁচ ও দশ টাকার নোট লোকটির সামনে রাখা প্লাস্টিকের বাটিতে ছুড়ে দিচ্ছেন। রবিবার বইমেলা থেকে শাহবাগ যাওয়ার পথে চোখে পড়ল মামুনের এ পথলিখন। দুপুর ২টা। কৌতূহলবশত এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল, আনুমানিক চার-পাঁচ ফুট জায়গাজুড়ে দক্ষ কারু শিল্পীর মতো নিপুণ হাতে বাংলা ও ইংরেজীতে জীবনের গল্প লিখে বসে আপন মনে নিজের দুঃখের কথা বলছেন তিনি। জানালেন, বিশ বছর আগে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় তার পা কাটা পড়ে। বিএ পাস করতে পারেননি তিনি। চাকরি করার ইচ্ছায় পড়ালেখা শিখেও তিনি পায়ের জন্য চাকরি করার কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। তিনি বাঁচার মতো বাঁচতে চান। পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে বাঁচার জন্য তাই তিনি নগরবাসীর কাছে আর্থিক সাহায্য চান। আগ্রহ নিয়ে রাস্তায় উপস্থিত অনেকেই তার লেখা পড়েন। কেউ সাহায্য হিসেবে পাঁচ-দশ টাকা দেন আবার অনেকেই দেখে চলে যান। তার লেখাগুলো মার্জিত হওয়ায় অনেকে আবার উপস্থিত প্রশংসাও করে যান। লক্ষ্য করে দেখা গেল, প্রথমেই ইংরেজীতে লেখা রয়েছেÑ সিটি ব্রাদার এ্যান্ড সিস্টার, স্ট্যান্ড আপ, আই এ্যাম ভেরি টায়ার্ড মামুন, প্লিজ স্যার, প্লিজ ব্রাদার, হেলপ মি এ্যান্ড হেলপ মি, সিটি সিস্টার, বাই দ্য কজ অব ট্রেন এ্যাক্সিডেন্ট। বাংলা ও ইংরেজীতে নিজের জীবনের গল্প লিখে তিনি অনেকের সহানুভূতিও পান। বইমেলায় আগত এক ব্যক্তি তার পরিবারের সঙ্গে এ রাস্তা দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মামুনের কর্মগুণটি দেখে হচকচিয়ে এগিয়ে আসেন। লেখাগুলো পড়ে ৫০ টাকা দিয়ে সাহায্য করেন তিনি। তার পাশে দাঁড়ানো বন্ধুটিকে বললেন, দেখেছ লোকটির হাতের লেখা কী চমৎকার। লোকটি জীবনধারণের জন্য ভিন্ন একটি উপায় বেছে নিয়েছেন। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জন্মভিটা মামুনের। ২০ বছর আগে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকায় আসার পথে ট্রেন থেকে নামার সময় পিছলে পড়ে চাকার নিচে পা দুটি চলে যায়। পরে একটি পা হাঁটু পর্যন্ত কাটা পড়ে। অপরটি না কাটতে হলেও পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় তাকে। এখন তিনি চিরকালের মতো পঙ্গু। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের কাছে এ পঙ্গু ব্যক্তিটির মূল্য অনেক। কারণ পাঁচ সদস্যের পরিবারের একমাত্র ভরসা তিনি। ট্রেন দুর্ঘটনার পর জীবনের মায়া ছেড়ে দিলেও পরিবারের সদস্যদের দিকে তাকিয়ে জীবন সংগ্রাম শুরু করেন তিনি। জানালেন, গত ১০ বছর ধরে নগরীর বিভিন্ন রাজপথে প্রতিদিন চক দিয়ে জীবনের গল্প লিখে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন তিনি। প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও সরকারীভাবে কোন সাহায্য-সহযোগিতা পাননি মামুন। নিজের পায়ে জোর নেই, তাই কারও কাছে গিয়ে সাহায্য চাওয়ার ক্ষমতাও নেই তার। বললেন, শুনেছি বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধীদের চাকরি কিংবা অর্থ সহায়তা প্রদান করছে। কার মাধ্যমে আমি সরকারের কাছে সাহায্য চাইব? নিজের পায়েই তো জোর নেই। পা নেই বলে আমিও দমে থাকতে চাইনি। তাইত বাঁচার মতো বাঁচতে চেয়ে ঢাকামুখী হয়ে পড়ে আছি। মানুষের সাহায্য নিয়ে চলছি। সরকারীভাবে মাসিক প্রতিবন্ধী ভাতা পেলেও হয়ত আমি একটু বেঁচে যেতাম। বয়স হয়েছে, এখন শরীরটাও বেশ দুর্বল। মামুনের চলাফেরার সঙ্গী একটি দু’চাকার হুইল চেয়ারের মতো গাড়ি। তাতে চড়েই তিনি রাস্তার বিভিন্ন ফুটপাথ ধরে চলাফেরা করেন। রাতে তিনি থাকেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাঠে। রাস্তাতেই তার খাওয়া-দাওয়া, সেখানেই তার বসবাস। সংসারের দীনতায় বাধ্য হয়ে তাকে ঢাকায় থাকতে হয়। দুই সন্তান, তার স্ত্রী ও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য বাড়িতে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা পাঠাতে হয় তাকে। এভাবেই পথে লিখে যা উপার্জন করেন তা থেকে বিকাশের মাধ্যমে বাড়িতে টাকা পাঠান তিনি। বইমেলা উপলক্ষে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর জমজমাট। প্রচুর মানুষের সমাগম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাস্তায়। সে উপলক্ষে মামুন এখন সাহায্যও বেশি পাচ্ছেন বলে জানালেন। গত দশ বছর তিনি বাড়িতে যাননি বলে আক্ষেপ করেন। ‘বাড়ির লোকজন মাঝেমধ্যে এসে চোখের দেখা দেখে যান। আমি ল্যাংড়া মানুষ। চলাফেরা করতে সমস্যা। অত দূরের পথে কিভাবে যাতায়াত করব? তাই আর যাওয়া হয় না। এভাবেই হয়ত কোন একদিন রাস্তায় মরে থাকব।’
×