ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী

ভারত-বাংলাদেশ সম্মেলন

প্রকাশিত: ০৬:১২, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ভারত-বাংলাদেশ সম্মেলন

(গতকালের পর) মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. শ্রী রাধা দত্ত বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের (বঙ্গবন্ধু) নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়াতেই বাংলাদেশ স্বাধীনতার আলো দেখেছে। বাংলাদেশের কিছু পথভ্রষ্ট যুবক মৌলবাদী রাষ্ট্র তৈরির পাঁয়তারা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন আলিয়া মাদ্রাসার পাঠ্যসূচীর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। তিনি বলেন, তিস্তার পানি বণ্টনসহ অন্যান্য অমীমাংসিত বিষয়ে সমাধান অবশ্যই অনতিবিলম্বে করতে হবে। ভারতের ইকোনমিক টাইমস পত্রিকার সহকারী সম্পাদক দীপাঞ্জন রায় ব্যক্ত করেন আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধীরা শেখ হাসিনার নব্য প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উৎখাত করার জন্য পিলখানা হত্যাকা- ঘটায়। তিনি মনে করেন পশ্চিম বাংলায়ও জামায়াতের তহবিলের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার। অনুষ্ঠানের একমাত্র উপমহাদেশের বাইরের বক্তা কানাডীয় মানবাধিকার আইনজ্ঞ উইলিয়াম স্নোন বলেন, ভারত এবং বাংলাদেশ একই পরিবারভুক্ত। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, যদিও ভারত এবং অন্য ক’টি দেশ বাংলাদেশের গণহত্যায় সোচ্চার ছিল এবং রয়েছে, তবুও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। তিনি মনে করেন, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা উভয় দেশের জন্যই মঙ্গলকর। মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ শ্রোতাদের মনে করিয়ে দেন, বাংলাদেশের মানুষ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা সব সময়ই অনেক উঁচু করে দেখে। দু’দেশের মানুষের অভিন্ন সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করে জেনারেল রশিদ বলেন, উভয় দেশকেই একত্রে এগুতে হবে। তিনি আরও বলেন, ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম নীতি’ সহযোগিতার নবদিগন্তের উন্মোচন ঘটিয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছিটমহল সমস্যা, নৌসীমা সমস্যা এবং সীমান্তে সন্ত্রাসী সমস্যার ইতি ঘটিয়েছে, দু’দেশের নিবিড় বন্ধুত্বের নীতির কারণে। রূপান্তর বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, সুন্দরবন এলাকা হচ্ছে অসাম্প্র্রদায়িকতার এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্তের এলাকা, যেখানে কোন কোন ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রীস্টান একই ধরনের উপাসনায় লিপ্ত থাকেন। অনুষ্ঠানে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুলও উপস্থিত ছিলেন। রামপাল বিদ্যুত সম্মেলনে রামপাল বিদ্যুত প্রকল্প বেশ জোরালো আলোচনায় আসলে সব বক্তাই বলেন, প্রকল্প এলাকা সুন্দরবন থেকে অনেক দূরে। মেজর জেনারেল রশিদ বলেন, এটি বন এলাকার শেষ বিন্দু থেকে ১৪ কিলোমিটার এবং জাতিসংঘ ঘোষিত ঐতিহ্য এলাকা থেকে ৬৯ কিলোমিটার দূরে। তাই এর কারণে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। দিল্লীর টেলিকম লাইভ এ্যান্ড ইনফ্রা লাইভের সম্পাদক ড. রশমি সিং বলেন, রামপাল প্রকল্প ভারত-বাংলাদেশ যৌথ সহযোগিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যাতে ১০০% অর্থ প্রদান করছে ভারত এবং যা বাস্তবায়ন হলে এর পুরো সুফল ভোগ করবে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে পর্যাপ্ত গ্যাস নেই বলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র করতে হয়েছে এবং চট্টগ্রামের নদী অগভীর হওয়ায় তা চট্টগ্রামে সম্ভব ছিল না। তিনি বলেন, এর ফলে সুন্দরবন, যা ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ের সম্পদ, কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। হিন্দু বিজনেস লাইনের উপ-সম্পাদক শ্রী প্রতিম রঞ্জন বসুও একই মত ব্যক্ত করেন। ভারতীয় দূত এবং মন্ত্রীবৃন্দ সম্মেলনে বাংলাদেশে নিযুক্ত দু’জন প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এবং এম জে আকবর ছাড়াও দু’জন ভারতীয় মন্ত্রী বক্তব্য রাখেন। প্রাক্ত রাষ্ট্রদূত শ্রী দেব মুখার্জী বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভিত্তি, যে সম্পর্কের পেছনে নিহিত রয়েছে উভয় দেশের স্বর্ণোজ্জ্বল ভবিষ্যত। যেসব সমস্যা রয়েছে তার কোনটিই দুরূহ নয়। শ্রীমতী বীণা সিক্রি বলেন, অভিন্ন সংস্কৃতি অবশ্যই দু’দেশকে গভীর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে জড়িয়ে রাখতে বাধ্য এবং কোন শক্তিই এ বন্ধন ক্ষুণœ করতে পারবে না। ভারতের পেট্রোলিয়াম এবং খনিজসম্পদ সংক্রান্ত প্রতিমন্ত্রী শ্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান দু’দেশের অভিন্ন কৃষ্টির কথা উল্লেখ করে বলেন, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে রবীন্দ্র চর্চা অধিক হয় এবং পহেলা বৈশাখও বাংলাদেশে অধিক তাৎপর্যের সঙ্গে পালিত হয়। তিনি দু’দেশের সম্পর্কে নতুন উদ্ভাবনীকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, নতুন বাণিজ্য যাত্রা এ সম্পর্ক আরও ওপরে নিয়ে যাবে। ভারতের বস্ত্রমন্ত্রী শ্রীমতী স্মৃতি জুবিন ইরানি সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় দেয়া ভাষণে উভয় দেশের সাংস্কৃতিক অভিন্নতা ছাড়াও যৌথ বাণিজ্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি মনে করেন, অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যও দু’দেশের জন্য সুফল আনতে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি বেনাপোল স্থলঘাঁটির উন্নয়নে সকলের সজাগ হওয়ার কথা বলেন। দু’দেশের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নতুন বাণিজ্যিক উদ্ভাবনী সম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন। সমাপনী অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে ভাষণদানকালে এ প্রবন্ধের লেখক বলেন, ’৭১-এর পরাজিত শক্তিরাই বাংলাদেশে প্রথম ভারতবিরোধী প্রচার শুরু করে। কেননা ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বড় সহায়ক শক্তি ছিল, যার সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। এখন ’৭১-এর পরাজিত শক্তিই দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব রক্ত দিয়ে লেখা এবং সময়ের কষ্টি পাথরে পরীক্ষিত। জিয়াউর রহমান এবং পরবর্তীতে তার স্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাকিপ্রেমী উল্লেখ করে তিনি বলেন, উভয়ের আমলেই ভারতীয় সন্ত্রাসী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করতে দেয়া হয়। আইএসআই-এর সাহায্যে তাদের সংগঠিত করার ব্যাপারেও জিয়া এবং খালেদা জিয়ার ভূমিকার অন্ত ছিল না, যার প্রমাণ পাওয়া যায় ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার শুনানিকালে এবং রায় থেকে যে মামলায় খালেদা জিয়ার দুই মন্ত্রী এবং গোয়েন্দা প্রধানের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বলা যাবে না, কেননা আমাদের সুপ্রীমকোর্টই এ কথা বলেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দু’দেশের অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে বন্ধুত্বের আলোকে। যেগুলো বাকি আছে তার সমাধানও অসম্ভব নয়Ñ এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত পরীক্ষিতভাবে বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বোত্তম বন্ধু। তিনি দু’দেশের অভিন্ন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং কৃষ্টির উল্লেখ করে বলেন, কোন শক্তিই দু’দেশের বন্ধন ভাংতে পারবে না- অতীতে এ চেষ্টা যারা করেছিল তারা ব্যর্থ হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ বুঝতে পেরেছে ভারত আমাদের প্রয়োজনে সময়ের বন্ধু। ’৭১-এ ভারতের সহায়তার ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষ মোটেও অকৃতজ্ঞ নয়। সমাপনী সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিমন্ত্রী শ্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান ছাড়াও বক্তব্য রাখেন নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের পরিচালক শ্রী শক্তি সিনহা। সম্মেলনে স্বাগত ভাষণ দেন ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল এ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজের সম্পাদক শ্রী অরিন্দম মুখোপাধ্যায়। বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত বেশ ক’জন সাংবাদিকের মধ্যে ছিলেন প্রথম আলোর সোহরাব হাসান, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব শ্রী রাহুল রাহা, আমাদের সময়ের শ্রী সন্তোষ শর্মা এবং আরও ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সেলিম। (সমাপ্ত) লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপীল বিভাগ
×